দূরদেশের লোকগল্প—সৌদি আরব (এশিয়া)
মায়ের যত্ন নিও
চিন্ময় দাশ
[বেদুইন-এর কথা আমরা জানি অনেকেই। এঁরা হলেন আরবের একটি যাযাবর জাতি। ‘তাঁবুর লোক’ বলে নিজেদের পরিচয় দেন এঁরা। এঁদের মুখ্য অবস্থান সৌদি আরব, ইরাক, জর্ডন, লিবিয়া, মিশরের একটি এলাকায়। আর হ্যাঁ, বর্তমানে যুদ্ধরত ইসরায়েল-এও কিছু বেদুইন আছেন বলে জানা যায়।
বেদুইন শব্দটা এসেছে আরবের একটি উপভাষার ‘বাদিয়া’ শব্দ থেকে। যার ভাবগত অর্থ হোল—মরুভূমিতে অবস্থানকারী। এঁদের স্থায়ী ঘরবাড়ি নাই। ‘মরুভূমির জাহাজ’ উটে চড়ে ঘুরে বেড়ান এঁরা। ভেড়া,ছাগল গবাদি পশু লালন-পালন আর বিক্রি করা এঁদের প্রধান জীবিকা।
এই গবাদিপশু চুরি আর তার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া একটি ঘটনা নিয়ে, এবারের গল্প।]
দামান আর কুয়েত। পারস্য উপসাগরের তীরে, সৌদি আরবের দুটি বিখ্যাত শহর। এই দুটো শহরের একেবারে মাঝামাঝি, একটি গ্রাম। বেশ কিছুকাল এক দল বেদুইন থাকছে সেই গ্রামে। সকলের ছাগল, ভেড়া একসাথেই থাকে তাদের।
একবার তারা খেয়াল করল, তাদের ভেড়া হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে মানে, ভেড়ার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কোন খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না।
দিন কয়েক নজর রাখা হোল। তাতে জানা গেল, রাতের বেলায় ঘটছে ব্যাপারটা। মাঝে মাঝেই একটা করে ভেড়া উধাও হয়ে যাচ্ছে। দলের সর্দার বলল—আমার মনে হচ্ছে, এ নিশ্চয় কোন নেকড়ের কাজ। হঠাৎ হঠাৎ আসছে। আর চুপিসারে একটা করে ভেড়া তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে।
--তাই যদি হয়, আমাদের পেট চলবে কী করে? এদিকে গুলতি ছাড়া, হাতে আর কোন অস্ত্রও নাই আমাদের। সর্দার, কিছু একটা করো তুমি। সবাই সর্দারকে ধরে পড়ল।
একটা যুবক ছেলে ছিল তাদের দলে। মান্ধাতার আমলের একটা গাদা বন্দুকও আছে তার। বন্দুকটা ছিল তার ঠাকুর্দার। বাপের হাত ঘুরে, এখন তার হাতে এসে পড়েছে।
মা বাপ নাই। একাই থাকে ছেলেটা। সে এগিয়ে এসে বলল—সর্দার, নেকড়ের ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দাও। তুমি রাজি হলে, আমি যেতে পারি। দেখি কতবড় সেই নেকড়ে। তাকে নিকেশ করেই ফিরে আসব আমি। তুমি শুধু মাথাটা নেড়ে দাও।
সর্দার কিছু বলার সুযোগই পেল না। সবাই হই-হই করে উঠল—তুমি যাও, তুমি যাও।
সারা দিন বসে বসে বন্দুক সাফ-সুতরো করল ছেলেটা। টোটা থাকতো একটা কাঠের বাক্সে। বাক্সটাও ঠাকুর্দারই। মোছামুছি করে রাখল টোটা কয়েকটাও। পরের দিন বন্দুক, কয়েক মুঠো শুকনো খেজুর আর জল নিয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটা।
কিছু দূর খোঁজাখুঁজি করে বালিতে একটা দাগ চোখে পড়ল ছেলের। সেই দাগ অনুসরণ করে একেবারে সাগরের পাড়ে এসে পড়ল এক সময়। আরও খানিক চলবার পর, একটা পাহাড়। তারই একটেরে গুহার মত একটা খোঁদল।
সেটায় উঁকি দিয়ে, চোখে মুখে আলো জ্বলে উঠল ছেলের। বোঁটকা গন্ধ। আর, ভেতরে হাড়গোড় ছড়ানো। দেখেই চঞ্চল হয়ে উঠল ছেলেটা। এ নিশ্চয় আমাদের ভেড়াগুলোরই হাড়গোড়! তবে রে, শয়তান। তাহলে তুইই সর্বনাশ করছিস আমাদের? আজই ইন্তেকাল করে ছাড়ব তোর। এক গুলিতেই পেট ফুটো করে দেব। তখন তোর সব খেল খতম।
খুঁজে খুঁজে একটা পাথরের আড়াল বের করল ছেলেটা। যেখানে লুকিয়ে থাকলে, ভেতরটা দেখতে পাওয়া যাবে। কিন্তু সে নিজে কারও চোখে পড়বে না।
কত সময় বাদে একটা নেকড়ে এসে ঢুকল। মুখে তার আজকের শিকার। একটা ভেড়া। সাথে সাথে বন্দুর তাক করল ছেলেটা। ট্রিগারে আঙুল চাপতে গিয়েও থেমে যেতে হোল। যা চোখে পড়ল, না থেমে উপায় ছিল না।
রোমাঞ্চকর একটা দৃশ্য তার চোখের সামনে। পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলে ছেলেটা। ভেড়াটাকে খাবলে খুবলে খেতে শুরু করে দিল না নেকড়ে। খুব সাবধানে, বুক ফেড়ে, ভেড়ার কলজে আর যকৃতটা আলাদা করে ফেলল। কাজটা করল ভারি যত্ন করে।
এই দুটো হোল যে কোন শিকারের সেরা আর উপাদেয় অংশ। বের করল বটে, কামড় বসানো দূরের কথা, দাঁতটিও লাগালো না।
ব্যাপারটা কী? ভারি কৌতুহল হচ্ছে ছেলেটার। খানিক বাদে আর একটা নেকড় এসে ঢুকল ভেতরে। দেখলেই বোঝা যায়, নেকড়েটা বেশ বুড়ো, আর চোখে ভালো দেখেও না।
ছেলেটার বুঝতে কিছু বাকি নাই আর। ট্রিগার থেকে আঙুল সরিয়ে নিয়েছে। নামিয়ে নিয়েছে বন্দুকটাও। এ হোল নেকড়েটার মা। বুড়ো হয়েছে। অশক্ত শরীর। শিকারে যেতে পারে না এখন আর। অপেক্ষা করে বসে থাকে, কখন ছেলে ফিরে আসবে খাবার নিয়ে। তাই, মায়ের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য, মাঝে মাঝে ভেড়া তুলে আনে তার যুবক ছেলে। মাকে না খেয়ে মরতে দেয় না।
চোখের কোণা শিরশির করে উঠল ছেলেটার। মন ভরে যাচ্ছে ভীষণ ভালো লাগায়। নিঃশব্দে সেখান থেকে বেরিয়ে, গ্রামের পথে ফিরে চলল।
নেকড়েটাকে ভারি পছন্দ হয়ে গেছে ছেলেটার। একটা বনের পশু, তার বুড়ি মায়ের জন্য এমন কাজ করে যেতে পারে, ভাবতেই নেকড়েটাকে বেশ পছন্দ হয়ে গেল তার।
পরদিন আবার গুহায় ফিরে চলল ছেলেটা। একটা ভেড়া তুলে নিয়েছে ঘাড়ে। নেকড়েটা মায়ের সেবা করে যাচ্ছে। এটা তার অনুভবের পুরষ্কার। এটুকু সম্মান দিতেই হবে নেকড়টাকে।
তাঁবুতে ফিরে এসে দলের সবাইকে জড়ো করল এক জায়গায়। সকলের সামনে বলে গেল, গত দিন কী দেখে এসেছে নিজের চোখে। ঘটনা শুনে, সবাই অবাক। সবাই তাজ্জব। ছেলেটা বলল—শোন সর্দার, একটা কথা বলছি আমি। আজ থেকে ঐ নেকড়ে আমার বন্ধু। আমার ভাই। ধরে নাও, ও আমারই প্রতিনিধি। কেউ কোনদিন অনিষ্ট করবে না ওর। যদি কেউ এ কথা অমান্য করে, বিরাট অনর্থ হয়ে যাবে তাতে।
একটু দম নিল ছেলে। তার পর বলল—কাল বন্দুক নিয়ে গিয়েছিলাম নেকড়ের খোঁজে। কিন্তু একটা গুলিও খরচ করিনি। সবাই কথাটা মনে রেখো। তখন আমাকে যেন দোষ দিও ন।
জমায়েতের একজনও কোন উত্তর করল না। তবে, একজনও ভয় পেল না। কেন না, বেদুইনরা সবাই মায়েদের যত্ন নিতে জানে। বংশপরম্পরায় মায়েদের জন্য গভীর শ্রদ্ধা আছে তাদের বুকের ভিতর। সেকারণে, বেদুইনদের হাতে কোনদিন কোন অনিষ্ট হোল না নেকড়েটার।
এ জন্যই বেদুইন বুড়োরা বলে থাকেন—মা-বাবার যত্ন নিও। অনেক অনিষ্ট থেকে রেহাই পেয়ে যাবে।
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments