জ্বলদর্চি

উদয়ের পথে-প্রথম পর্ব/মলয় সরকার

উদয়ের পথে
প্রথম পর্ব
মলয় সরকার


অনেক দিন থেকে ইচ্ছা ছিল জাপান যাওয়ার।তার কয়েকটি কারণ আছে।তার মধ্যে জাপানের সাথে নেতাজী( যদিও তাঁকে একদল মানুষ জাপানী ঘনিষ্ঠতার জন্য নিন্দা করেছিলেন)  ও রাসবিহারী বসুর অন্তরঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতা।
ভাবতাম, কি পেয়েছিলেন ওঁরা, যে, জাপানকে এত ভালবেসেছিলেন। রাসবিহারী তো একেবারে জাপানী ঘরণীই সঙ্গী করে ফেললেন।এছাড়া অপর্ণা সেনের 'জাপানীজ ওয়াইফ' সিনেমায় জাপানী মেয়েদের আন্তরিকতা আমার মন ছুঁয়ে গিয়েছিল।
এছাড়াও আরও নানা কারণ আছে।তাই ছিল জাপান যাওয়ার এত আগ্রহ। শেষে সুযোগ এসেই গেল, প্রায় হঠাৎ। আর এসে যখন গেলই, হাত ছাড়া করার পাত্র আমি নয় ,অন্ততঃ যতক্ষণ শরীর চলছে ঠিক। অবশ্য বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ আমি কখনোই ছাড়ি না।ভাবতাম,' চীন জাপান ' শব্দবন্ধটা আমরা একসঙ্গে ব্যবহার করি।চীনটা যখন ঘুরে এসেছি, জাপানটাও যাই, একবার, এটাই ইচ্ছা।

যাই হোক, যদিও জাপান মানে তো আর এতটুকু জায়গা নয়, রীতিমত চারটি বড় দ্বীপ এবং অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে তবে জাপান। বড় দ্বীপগুলো হল হোক্কাইডো, হনসু, কিউসিউ, শিকোকু। তার মধ্যে আমাদের যাত্রা মাত্র ১২ দিনের তাও কেবলমাত্র হনসু দ্বীপের প্রধান দুটি শহর আর একটি গ্রামে।অর্থাৎ ভাতের হাঁড়ির একটি ভাত টিপে পরীক্ষা করে গোটা হাঁড়ির অবস্থা বোঝার মত ব্যাপার।অগত্যা–

জাপানকে যদিও আমরা ছেলেবেলা থেকেই জানি, নিপ্পন বা উদীয়মান সূর্যের দেশ অর্থাৎ পৃথিবীর প্রথম প্রভাতী সূর্যকিরণ এখানেই পড়ে, বলে, কিন্তু তথ্যগত দিক থেকে তা নিতান্তই ভুল।আসলে প্রকৃত অর্থে বা ভৌগোলিক ভাবে যদি বলা হয় পৃথিবীতে নতুন দিনের প্রথম সূর্যকিরণ কোথায় প্রথম পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করে, তা হল প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে Kiribati র  জনশূন্য একটি প্রবালদ্বীপ, যার নাম ক্যারোলিন দ্বীপ(Caroline island) বা মিলেনিয়াম দ্বীপ (Millennium Island)।কাজেই সে দ্বীপে প্রথম সূর্যকিরণ পায় না কোন মানুষ, পায় সুন্দর প্রবালের দল।
তা হলে স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে মনে, যে, তাহলে এতদিন ধরে আমরা যে 'উদীয়মান সূর্যের দেশ' বলে জেনে আসছি, তা কি ভুল! জাপানীরা নিজেরাও তো বলে নিজেদের দেশকে 'নিপ্পন' বা ' নিহন' যার আক্ষরিক অর্থ'যে দেশে প্রথম সূর্য ওঠে'। কিন্তু বাস্তবে তা মোটেই ঠিক নয়।

আসলে এই নাম দিয়েছিল চীনারা।দক্ষিণ চীন দেশের লোকেরা তাদের দেশের থেকে পূর্বে বলে, তারা মনে করত সূর্য ওখান থেকেই ওঠে। সেই থেকেই ধারণাটা ছড়িয়ে পড়ে, ভুল হলেও।যেহেতু জাপানে আগে লেখার ভাষা ছিল না, চীন দেশ থেকেই তা আসে, সে হেতু চীনারা যেভাবে তাদের দেশের নাম লিখত, ওরাও সেইভাবে নিজেদের দেশের নাম লিখত।যার অর্থ দাঁড়িয়েছিল, উদীয়মান সূর্যের দেশ।

ওদিকে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইটালিয়ান পরিব্রাজক মার্কো পোলো যদিও জাপান যান নি, তবু এর কথা শুনেছিলেন চীন দেশ থেকে।তারা তখন একে বলত,Ji pang বা Zu Pang। ওদিকে মার্কো পোলোর কাছ থেকে শুনে ইটালিয়ানরা একে বলত Zipangu।  তার থেকে আবার ইংরেজরা বলতে শুরু করল Japan। তাই এর নাম হল জাপান।
প্রথম দিকে অর্থাৎ সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এর নাম ছিল Wa (Yamato), যেটা অষ্টম শতাব্দীতে পরিবর্তন করে চীনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে, তাদের দেওয়া নামই রাখা হয়, নিহন বা নিপ্পন। জাপানীদের ধারণা সূর্যের রঙ টকটকে লাল।ফলে ওরা ওদের জাতীয় পতাকার মাঝে সূর্যের প্রতিকৃতি আঁকে লাল রঙ দিয়ে।অবশ্য এই পতাকাটাই জাপানের জাতীয় পতাকা ছিল না ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত।

এবার আসি অন্য কথায়।আমরা যদিও জানি, জাপান প্রধানতঃ চারটি দ্বীপ নিয়ে তৈরী। কিন্তু আসল কথাটা হল, জাপানের ভিতরে রয়েছে মোট ১৪১২৫ টি দ্বীপ, যা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি।এর মধ্যে মাত্র ২৬০ টির মত দ্বীপে মানুষ বাস করে।দ্বীপ- রাষ্ট্র হিসাবে এর আয়তন পৃথিবীর মধ্যে চতুর্থ।অনেক দ্বীপ আসলে এতই ছোট যে, তা প্রায় ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না।

তবে এর মধ্যে অবশ্যই প্রধান হল চারটি, Hokkaido (Second largest),Honshu (Largest, capital Tokyo), Kyushu (Third largest), Shikoku(Smallest)। কাজেই জাপানকে একটি বৃহৎ দ্বীপপুঞ্জ হিসাবেই ধরা উচিত।এর মধ্যে হনসুতেই রয়েছে জাপানের বর্তমান রাজধানী টোকিও।এ ছাড়া এখানেই রয়েছে সব চেয়ে বেশি দর্শনীয় জিনিস। অবশ্য তার অর্থ এই নয়, যে, অন্য জায়গায় তেমন কিছু নেই। আমাদের সময় খুবই কম বলে, এই দু একটি জায়গায় যাওয়াই স্থির হল।
এই হোক্কাইডোতেই আমাদের যাদুকর সিনিয়র পি সি সরকার যাদুর খেলা দেখাতে দেখাতে মারা গিয়েছিলেন।
আর রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন তখনকার প্রধান বন্দর সহর কোবেতে, যা কিন্তু এই হনসু দ্বীপেই, যেখানে আমাদের ঘোরার পরিকল্পনা।

মনে একটা আলাদা উত্তেজনা, কারণ এই সময়টাতেই চলে ওদের চেরী উৎসব।আসলে চেরী ফুলের সঙ্গে জাপানের নাম প্রায় অভিন্ন ভাবে উচ্চারিত হয়, যদিও, এখন বহু জায়গাতেই চেরী গাছ দেখা যায়।আমি নিজে আমেরিকাতে অনেক চেরীর সমারোহ দেখেছি এর আগেই।আমার জীবনে প্রথম চেরীর নামটি শুনি একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের জিনিসের সাথে জড়িত হিসাবে। আমি আজও বুঝিনি এই দুটো জিনিস সমার্থক হল কি ভাবে। তা হল, সেকালের বিখ্যাত ও একমেবাদ্বিতীয়ম জুতোর পালিশ ।যেটি ছিল এক ব্রিটিশ কোম্পানী, কিউই (Kiwi) কোম্পানীর তৈরী। ১৯০৬ সাল থেকে তার পদযাত্রা শুরু। যদিও এর আগে আইরিশ এবং জার্মানরা জুতোর পালিশ তৈরী করেছিল, কিন্তু চার্লি চ্যাপলিনের ছবি দেওয়া জুতোর পালিশের এই কোম্পানী সেকালের মত আজ একশ বছর পরেও অদ্বিতীয় ভাবে বাজার দখল করে আছে। অবশ্য এখন আর চার্লিকে এর কৌটোর মাথায় রাখে না, তার বদলে ওরা চেরী ফলকে বসিয়েছে। এই কোম্পানীর আদি নাম ছিল Grangers International।

যাক গে’ আসল কথায় আসি। এই চেরী ফুল কিন্তু জাপানীদের গর্ব । একে ওরা আদর করে বলে Sakura. এটাকে জাতীয় ফুল হিসাবেই ওরা গণ্য করে। এটার  বিভিন্ন ধরণ আছে,। যখন গাছ ভর্তি চেরী ফুল ফোটে, গাছে পাতাটিও দেখতে পাওয়া যায় না।এটি ফোটে সবচেয়ে বেশি মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে। যখন ঝরতে থাকে সেও এক দেখার মত জিনিস।বাতাসে উড়তে থাকে চারিদিকে পেঁজা তুলোর মত রাশি রাশি সাদাটে , হাল্কা গোলাপী ফুলের পাপড়ি আর রাস্তায় , মাঠে ঘাটে চতুর্দিক ঝরা ফুলের মেলায় দর্শনীয় হয়ে ওঠে।শুধু তাই নয়, জাপানীরা এতই ভালবাসে এই ফুলকে, যে তারা লোককে নিমন্ত্রণ করে ফুল দেখার জন্য, ভোজের ব্যবস্থা করে। এই ভোজের নাম ‘হানামি’ (Hanami). ভারতেও এই ফুল হয় অল্প কিছু জায়গায়।তার মধ্যে হিমাচল প্রদেশের নারকাণ্ডা ,ভুট্টি, মাশোব্রা ইত্যাদি জেলায় প্রধান। এ নিয়ে পরে আরও বলার ইচ্ছা রইল। এগিয়ে চলুন আমার সঙ্গে পরের পর্বে। (ক্রমশঃ)

Post a Comment

1 Comments

  1. সুন্দর শুরু।

    ReplyDelete