The Smart Lady With Divinity
তনুশ্রী ভট্টাচার্য
দেবী সরস্বতী বৈদিক দেবী। ঋক্ বেদে দুই সরস্বতীর উল্লেখ আছে। একটি স্বর্গের সরস্বতী --সুর গঙ্গা, আকাশ গঙ্গা, মন্দাকিনী নামেই আমরা তাকে চিনি। অন্যটি মর্তের সরস্বতী নদী। বৈদিক আর্যরা এই নদীর তীরেই বসতি স্থাপন করেছিলেন, যেটি রাজস্থান ও পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছিল ,(যেটি এখন লুপ্ত)। এমন বেগবতী বিরাট নদী আর ছিল না ।আর্যরা এখান থেকেই ক্রমে বিদ্যায় বুদ্ধিতে জ্ঞানে কর্মে আশাতীত সাফল্য লাভ করেছিল কালক্রমে তাই এ ধারণা জন্মায় যে সরস্বতী নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কৃপাতেই তাদের উন্নতি হয়েছে। সেই থেকে সরস্বতী নামটি উর্বরতা প্রাচুর্য পুষ্টি কান্তি মেধা যশ বুদ্ধির দ্যোতনা বহন করে চলেছে। এইভাবে নদীর অনুষঙ্গে শুরু হলো দেবীর আবাহন। নদী হলেন বাক্ রূপা দেবী । আর সরস্বতী হলেন মেধা প্রজ্ঞা স্মৃতির দেবী।
স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ তার 'মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা' গ্রন্থে বলেছেন দেবী সরস্বতী বেদের দেবী ঊষা। উষা সৃষ্টি রূপিনী বা চৈতন্যদায়িনী। দেবী ঊষার প্রকাশের পথে প্রধান অন্তরায় রাত্রির অন্ধকার। অন্ধকার অজ্ঞানতাকেই সূচিত করে আর সূর্যোদয়ের ঠিক পূর্বাকাশে শুভ্র এবং উজ্জ্বল আলোকাভাসই দেবী ঊষা --- যিনি শ্বেত বর্ণ সরস্বতী আর এই অরুনা লোক অজ্ঞান বিনাশিনী জড়তা নাশিনী।
অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ তাঁর "সরস্বতী" গ্রন্থে বলেছেন ব্রাহ্মণ ও উপনিষদের যুগে সরস শব্দের অর্থ ছিল জ্যোতিষ্মান সূর্য। তাই সরস্বতী সূর্যের কন্যা বা সূর্যের পত্নী --- সরস্বতী অর্থে জ্যোতির্ময়ী। প্রথমে তাই তিনি ছিলেন নিরাকার তথা জ্যোতি :স্বরূপা। অজ্ঞানতা দূর করে জ্ঞানের পথকে তিনি জ্যোতির্ময়ী আলোলিকা করেন। আবার "সরস্বৎ" শব্দের আরেকটি অর্থ হল যাতে সরস জল আছে। জল হল জ্ঞান। জ্ঞান নদীর মতোই বহে চলে অনবরত--- অজ্ঞান থেকে জ্ঞানে, অন্ধকার থেকে আলোয়, ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে।
আবার ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে সরস্বতী শ্রীকৃষ্ণের মুখ গহ্বর থেকে নিঃসৃত হয়ে ছিলেন এবং তাঁরই আদেশে বিষ্ণুর স্ত্রী হয়েছিলেন। তাই তিনি বিষ্ণু ভার্যা এবং বিষ্ণুজিহ্বা নামে পরিচিত। তিনি জ্ঞানজ্যোতির প্রতীক স্বরূপা তাই তিনি শ্বেত বর্ণা। তাঁর সকল উপচার সাদা রঙের। সাদা ফুল সাদা চন্দন সাদা পদ্ম দই ক্ষীর মাখন খই তিলের খাজা সাদা পিঠে প্রভৃতি।সাদা খইয়ের মালা গেঁথে দেবীকে পরানো হয়।সাদা বাসক ফুলের মালা দেবীর বড্ড প্রিয়।
উপরোক্ত মত ছাড়াও আরো ভিন্ন ভিন্ন মত আছে সরস্বতীর দেবীরূপে অধিষ্ঠাত্রী হওয়ার পিছনে। কোথাও তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মার মানস কন্যা বা পত্নী আবার কোথাও বা শিব দুর্গার কন্যা আবার বৌদ্ধ মতে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীর পত্নী। তিনি হংস বাহিনী না সিংহারুঢ়া না তার বাহন কচ্ছপ না ময়ূর তা নিয়ে বিস্তর তর্ক বিতর্ক।
বৈদিক যুগে সরস্বতী প্রতিমার কোন অস্তিত্ব ছিল না বলেই অনুমান করা যায়। পরে বৌদ্ধরা বাগীশ্বরী রূপে তার পুজো করেন। এইরূপে তিনি সিংহের পিঠে বসেন এবং হাতে থাকে বীনা আবার বীনাপানি রূপে এর আসন হাঁসের পিঠে। দক্ষিণ ভারতে এর বাহন ময়ূর। নদী রূপে দেবীর কল্পনা হওয়ায় অনুষঙ্গ পদ্ম কচ্ছপ ও হাঁস আবার জ্ঞান ও কলার স্মারকে পুস্তক কলম ও বীনা।
আমাদের সরস্বতী হংস বাহনা। এই হংস শব্দের যৌগিক ব্যাখ্যা হলো--- মানুষের জীব শরীরকে বলে হং এবং আত্মাশরীরকে বলে স: ।এই স্থূল জীব শরীরের মধ্যে আত্মার মিলনের নাম হয় "হংস"। জীবদেহী মানুষ অহংকার মায়া দম্ভ মোহ ভ্রান্তিরূপ অবিদ্যা দ্বারা বেষ্টিত হয়ে আছে। প্রকৃত সাধনায় জীব মধ্যস্থিত আত্মাকে হংস রূপ বাহন করে তুলতে পারলেই জ্ঞান সম্ভব হয় এবং সেই অবস্থায় মানুষের মধ্যে জ্ঞানালোক জাগরিত হয়।
মাতর্মাতনমস্তে দহদহ পড়তাং দেহি বুদ্ধিং প্রশান্তম"--- হে মাত: তুমি আমার জড়তা দগ্ধ করে আমাকে প্রশান্ত বুদ্ধি দান কর। বাগদেবীকে "নিঃশেষ জাড্যাপহা" --- নি:শেষে জড়তানাশিনী বলা হয়েছে। কেবলমাত্র বিদ্যানুশীলনই নয় সকল কর্মোদ্যমেই দৈহিক ও মানসিক জড়তা থেকে মুক্তি প্রার্থনা করা হয় দেবীর কাছে। শীতের অবসানে বসন্তের সমাগমে বাইরের প্রকৃতি যেমন নবপত্রোদগমে জেগে ওঠে মানুষের মন ও শীতের জড়তা ও অজ্ঞানতার জড়তা ত্যাগ করে নব তেজে বলীয়ান হয়ে উঠতে চায়। তাই তো বসন্ত পঞ্চমী জাড্ডানাশিনী দেবীর আরাধনার প্রকৃষ্ট সময়।
বসন্ত সৃষ্টির দ্যোতক ,বিকাশের পরিচায়ক। বিনীত ভক্ত তাই প্রার্থনা করেন---"প্রকৃতিং পরমাং অভয়াং বরদাং" আর মানসপুত্র কবি আবৃত্তি করেন---
তুমি মানুষের মাঝখানে আসি
দাঁড়াও মধুর মুরতি বিকাশি
কুন্দ বরন সুন্দর হাসি,
বীনা হাতে বীণাপানি।
(পুরস্কার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
🍂
আরও পড়ুন 👇
বিশ্ব কবি ও দেবীকে অনুরোধ জানিয়েছেন সকল মানুষের মাঝখানে তার আশীর্বাদের ডালি নিয়ে হাজির হতে যাতে স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে তার চরণে অন্তরের উপচার সাজিয়ে অর্চনা দিতে পারেন। বিদ্যার্থী শিক্ষার্থী জ্ঞানী ধ্যানী মানী বিজ্ঞানী সকলেই পারেন শুদ্ধ আসনে শুদ্ধ বসনে শুদ্ধ মননে পলাশপ্রিয়ার চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিতে, তাঁর প্রসাদ লাভ করতে।
ঋক বৈদিক যুগ থেকে আজ ২১ শতাব্দী। সময় এগিয়েছে সভ্যতা এগিয়েছে আর দেবীর রূপাখ্যানের ও পরিবর্তন হয়েছে। পূজা অর্চনার ধারা বদলেছে। এ প্রসঙ্গে সমাজতাত্বিক অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ এর লেখা "সরস্বতী"বইটি ঘাঁটলে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায় ।প্রায় ১০০ বছর আগে ১৩৪০ বঙ্গাব্দে বিদ্যাভূষণ মশাই লিখছেন "সরস্বতী নিজে স্ত্রী দেবতা, কিন্তু স্ত্রীলোকেরা অঞ্জলি দিতে পারিত না।"
বাঙালির বোধ হয় ভয় পাচ্ছে মেয়েরা দেবীর অনুগ্রহে লেখাপড়া শিখিয়া ফেলে।
তবে এই ভয় এখনো একটু আধটু আছে।একটু রকমফেরে---পাছে স্ত্রীলোকেরা পুরোহিতের আসনে বসিয়া পড়ে। কান পাতলে যে ক্যাচামেচি শোনা যায়!!!!!!
সোশ্যালমিডিয়া র হাইটেক যুগে ই বলুন আর ফিলগুড আবহে ই বলুন বসন্তপঞ্চমী এখন একটি মেগা ইভেন্ট। নববসন্তে নবপ্রেমের উদ্ভাস নিয়ে বাসন্তী রঙের শাড়ি পাঞ্জাবী শোভিত উদ্ভিন্ন যৌবন সেলিব্রেট করে সরস্বতী পুজা থুড়ি বসন্তপঞ্চমী। মাঘের কোকিল ও দূরে থাকে না। গলা সাধা শুরু করে দেয়।দেবীর রূপাখ্যানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ ও বেশ মানানসই। হৃদয়ে শুদ্ধ প্রেম জাগলেও ত বুদ্ধির জড়তাই দূর হয় । প্রেমের উদযাপনে এমন সক্রিয় ভূমিকা সরস্বতীপুজোর।প্রাচ্য প্রতীচ্য একাকার। প্রেমে আর বিদ্যায়ে এমন মাখামাখি! সৌজন্যে দেবী সরস্বতী ---The Smart Lady With Divinity
জড়তানাশিনী দেবীর কাছে প্রার্থনা প্রতিটি মানুষের সবরকম বুদ্ধির জড়তা যেন দূর হয়।সে পাঠের হাতেখড়ি হোক আজই।
যা কুন্দেন্দু তুষার-হার ধবলা যা শ্বেতপদ্মাসনা
যা বীনা-বরদন্ড-মন্ডিতভূজা যা শুভ্রবস্ত্রাবৃতা
যা ব্রহ্মচ্যূত শঙ্কর প্রভৃতি ভিদের্বৈ:সদা বন্দিতা
সা মাং পাতু সরস্বতী ভগবতী নি:শেষ জাড্যাপহা।।
0 Comments