বিশ্ব ভালোবাসা দিবস
(১৪ই ফেব্রুয়ারি)
দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে
ভালোবাসা একটি মানবিক অনুভূতি এবং আবেগ কেন্দ্রিক একটি অভিজ্ঞতা। বিশ্বের কোন মানুষ, প্রাণী বা বস্তুর জন্য স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ভালোবাসা। ভালবাসাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাগ করা যায়, যেমন- একজন মায়ের ভালোবাসা, একজন সঙ্গীর ভালোবাসা থেকে আলাদা। সব ভালবাসাই ভিন্ন ধরনের। আসলে ভালোবাসা বলতে আমাদের কোন কিছুর প্রতি তীব্র আকর্ষণ এবং মানসিক সংযুক্তির অনুভূতিকেই বোঝায়।
আজ ১৪ ই ফেব্রুয়ারী বিশ্ব ভালবাসা দিবস। কেন এই দিনটি ভালবাসার দিন হল তার ইতিহাস একটু জেনে নেই আমরা।
সেই দিনও ১৪ই ফেব্রুয়ারি ছিল। ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও প্রথম জুলিয়াস ভ্যালেন্টাইন স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারীকে ভালোবাসা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
বিশ্বজুড়ে ১৪ই ফেব্রুয়ারী নানা আয়োজনের মাধ্যমে দিনটি পালন করেন মানুষেরা। এই দিনটিকে কেন ভালোবাসার দিন হিসেবে পালন করা হয়, তার মত অনেক আছে। তবে সাধারণত যে ইতিহাসকে কেন্দ্র করে দিনটি পালিত হয় তা হল, ক্যাথলিক চার্চ এর শুরুর দিকে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস নামে এক বা একাধিক পাদ্রির শহীদ হওয়াকে সম্মান জানাতে খ্রিস্ট ধর্মীয় উৎসব হিসেবে দিনটি পালন হতো। সময়ের সঙ্গে প্রেম ও ভালোবাসার সাংস্কৃতিক ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক একটি আনুষ্ঠানিক দিবসে এটি পরিণত হয়।
ভালোবাসা দিবস প্রতিষ্ঠা নিয়ে নানা মিথ আছে ,এসবের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বেশি পেয়েছে তৃতীয় শতকে এক পাদ্রির শহীদ হওয়ার ঘটনা। তখন রোমান সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় ক্লাডিয়াস একের পর এক রাষ্ট্র জয় করে চলেছেন । যুদ্ধের ময়দানে শত্রুকে পরাজিত করতে সেনাবাহিনীকে আরো বড় করার কথা ভাবলেন সম্রাট।
ঠিক সেই সময় তরুণেরা যুদ্ধের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। গ্লাডিয়াস ভাবলেন সঙ্গী না থাকলে যুদ্ধমুখী হবে তরুণেরা,তাই নিষিদ্ধ করলেন বিয়ে,তরুণদের নিয়মের বেড়াজালে বন্দী করার কাজ যেহেতু মুশকিলের। এদিকে সম্রাটের চোখ ফাঁকি দিয়ে তরুণদের পাশে দাঁড়ালেন এক পাদ্রী নাম সেন্ট ভ্যালেন্টাইন।
গোপনে তিনি বিয়ে দিচ্ছিলেন তরুণ-তরুণীদের কিন্তু সম্রাটের চোখে বেশিদিন ফাঁকি দিতে পারলেন না, ধরা পড়লেন ভ্যালেন্টাইন। শুরু হলো কারা জীবন।
🍂
আরও পড়ুন 👇
মুক্তির পথ জানা ছিল না, কিন্তু ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে জেলখানায় যেতেন তরুণেরা। ভ্যালেন্টাইনের প্রজ্ঞায় মুগ্ধ ছিলেন তরুণী সম্প্রদায়ও, বিশেষ করে এক তরুণী, সেই বিশেষ তরুণীটি ছিলেন কারারক্ষীর মেয়ে।
প্রায়ই সে কারারুদ্ধ ভেলেনটাইন কে দেখতে কারাগারে যেতেন। ধর্মযাজক হয়েও একসময় রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে সেই তরুণীর প্রেমে পড়লেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। এসব ঘটনাগুলো ভ্যালেন্টাইনের জীবনের শেষ সপ্তাহের বলা যায়।২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।
ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে ভ্যালেন্টাইন তার প্রেয়সীকে চিঠি লেখেন। যার শেষ লাইনটি ছিল এই রকম, 'তোমার ভ্যালেন্টাইনের কাছ থেকে ভালোবাসা'।
সেই থেকে পাশ্চাত্যে ১৪ই ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ভালোবাসার দিন হিসেবে দেখা হয়, যদিও দুই শতাব্দী নীরবে-নিভৃতে পালন করা হয়। অবশেষে ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে রোমের রাজা পোপ জেলাসিউ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব ভালবাসা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এর মৃত্যুর আগে প্রতিবছর রোমানরা ১৪ই ফেব্রুয়ারি পালন করত জুনো উৎসব। রোমান পুরাণ অনুযায়ী বিয়েও সন্তানের দেবী হলেন জুনো। এই দিনটিতে অবিবাহিত তরুণেরা কাগজে নাম লিখে লটারির মাধ্যমে তার নাচের সঙ্গীকে বেছে নিত।
৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রোমানরা যখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে ,তখন জুনো উৎসব আর সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের দিনটিকে গাথা হয় এক সূত্রে, যা ইউরোপ থেকে গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে সারা বিশ্বে।
ভালোবাসা দিবসের শুরু নিয়ে আরেকটি মিথ বেশ আলোচিত। এই মতাবলম্বী মানুষেরা মনে করেন ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে প্রিয়জনকে ভালোবাসার বার্তা পাঠানোর কোন সম্পর্ক নেই।
আবার প্রাচীনকালে মানুষের বিশ্বাস ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি হল পাখিদের বিয়ের দিন অর্থাৎ ভালবাসার দিন। মনে করা হয় পাখিরা বছরের দ্বিতীয় মাসে দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিম পাড়ে। আবার অনেকে বলেন মধ্যযুগের শেষ দিকে মানুষ বিশ্বাস করত এই দিনে পাখিদের মিলন ঋতু শুরু হয় পাখিরা সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। তাদের দেখাদেখি মানুষের সঙ্গে নির্বাচন করে এ দিনে।
বর্তমান সময়ে এসে ভ্যালেন্টাইন দিবসের কদর এত প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যে, পাশ্চাত্যে এই উৎসব মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষেরা এই দিনটি উপলক্ষে এক দিনেই প্রায় কয়েক কোটি ডলার ব্যয় করেন। ভালোবাসা দিবসের জন্য মানুষেরা কার্ড ফুল চকলেট ও অন্যান্য উপহার সামগ্রী ক্রয় করে।যুক্তরাষ্ট্রে এই দিনে প্রায় আনুমানিক ৩ কোটি শুভেচ্ছা বার্তা, কার্ড আদান- প্রদান করা হয়।
গত ৮-১০ বছর আগেও ভারতের ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবস বলে আলাদা করে কিছু ছিল না। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ১৪ই ফেব্রুয়ারি দিনটি ভালোবাসার দিন হিসেবে পালিত হয়।
বর্তমানে এই ভালোবাসা দিনের অর্থ বদলে প্রসারিত হয়েছে,শুধুমাত্র প্রেমিক- প্রেমিকার নয়, মা-বাবা, ভাই- বোন, ও বন্ধু-বান্ধব সকলের জন্যই ভালোবাসার দিন।
ভালোবাসা জিনিসটি শুধুমাত্র একে অপরের আকর্ষণের মাধ্যমে তৈরি হয় না। এতে থাকতে হয়, একে অন্যের প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস কাউকে ভালোবাসার অর্থ হচ্ছে তার প্রতি দায়বদ্ধ ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া।
যাইহোক, বাঙালির কাছে ভালোবাসার দিন মানে সরস্বতী পুজোর দিন।
0 Comments