নির্মল বর্মন
অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাস প্রাবন্ধিক, গবেষক, সাহিত্যিক হিসেবে প্রথমের দিকে চিরস্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করলেও বর্তমানে বিস্মৃতপ্রায় । অধ্যাপক দাসের প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ভারতীয় রসতত্ত্ব, মধ্য ও আধুনিক যুগের সাহিত্য চর্চা,সংস্কৃত সাহিত্য, , বৈষ্ণব রসতত্ত্ব, রবীন্দ্র সাহিত্য, ভাষাতত্ত্ব ও ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি নানান বিষয়ে সমধিক প্রবন্ধ রচনা করেছেন।সূচিতেও স্থান লাভ করেছে। ড.দাস বিভিন্ন বিষয়ে অবাধ গতি সৃষ্টিতে বদ্ধপরিকর। অধ্যাপক দাসের উদারদৃষ্টি ও প্রসারিত মনের সুযশ অধিকারী , ঞ্জানগর্ভ পাণ্ডিত্য, সুতীক্ষ্ণ রসাত্মক, সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি, বিস্ময়কর ও কৌতূহলী জিজ্ঞাসা ও বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা ড .দাস সাহেবকে ব্যাপৃত রেখেছে। অধ্যাপক দাস সর্বদা যুক্তি ও তর্ককে পাথেয় করে রসাস্বাদন করে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রবন্ধগুলির রসাস্বাদন মারাত্মক আকর্ষণীয় ও চিত্তাকর্ষক করে তুলেছেন।
অধ্যাপক ড.ক্ষুদিরাম দাস বিরোচিত গ্রন্থগুলি :-
"রবীন্দ্র প্রতিভার পরিচয়" (১৯৫৩), "বাঙলা কাব্যের রূপ ও রীতি"(১৯৫৮), "চিত্রগীতময়ী রবীন্দ্র বাণী" (১৯৬৬), "বৈষ্ণবরসপ্রকাশ"(১৯৭৩), "সমাজ-প্রগতি-রবীন্দ্রনাথ'
(১৯৭৮), "রবীন্দ্র-কল্পনায় বিজ্ঞানের অধিকার" (১৯৮৪), "বানান বানানোর বন্দরে" (১৯৯৪), "১৪০০ সাল ও চলমান রবি" (১৯৯৪), "দেশ-কাল-সাহিত্য" (১৯৯৫), "সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ অভিধান" (১৯৯৮) এবং সম্পাদিত গ্রন্থ "কবিকঙ্কণ চণ্ডী" (১৯৭৬)। "রবীন্দ্র প্রতিভার পরিচয়"গ্ৰন্থটি রবীন্দ্র কেন্দ্রীক আকর গ্রন্থ হওয়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ড. দাসকে ১৯৬২সালে "ডি.লিট", উপাধি তে ভূষিত করেন। আবার"বৈষ্ণব রসপ্রকাশ" নামক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের জন্য "প্রাণতোষ ঘটক" পুরস্কার, ১৯৭৩, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কালজয়ী "বিদ্যাসাগর পুরস্কার", ১৯৮৪ ও " রবীন্দ্র পুরস্কার" ,১৯৯৪ লাভ করেন ও সম্মানিত বোধ করেছিলেন।
অধ্যাপক দাস মূলত রবীন্দ্র কবি প্রতিভা'র বিশেষত্ব যে সুগন্ধি অন্তর্নিহিত গতিশীলতা সমাজে ছড়িয়েছিলেন - সেই বিষয়টি'র প্রতি সুতীক্ষ্ণ ভাবনা রেখেই "রবীন্দ্র প্রতিভার পরিচয়" গ্রন্থটি সৃষ্টি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কর্মত্রুম 'ধারাবাহিকতা ও পরম্পরা'র স্বচ্ছতা ও সাবলীলতা সুস্পষ্ট ভাষায় জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন।
ড.ক্ষুদিরাম দাস ''বাঙলা কাব্যের রূপ ও রীতি'' নামক সুমহান গ্রন্থে 'মধ্য ও আধুনিক যুগের বাংলা কাব্য- কবিতা'র টেকনিক , ভাষা ও সমাজ মনস্ক তথ্য নিয়ে বিশাল আলোচনা করে গেছেন যা আজও বাংলার সারস্বত সমাজ ও ছাত্রছাত্রী উপকৃত হলেও কোথায় যেন হারিয়ে যাওয়ার ছাপ অস্পষ্ট কায়ায় আবদ্ধ। আলোচ্য গ্রন্থের মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য:-
প্রথম পর্বে 'প্রাচীন ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব'
দ্বিতীয় পর্বে "বাংলা কাব্য-কবিতার ছন্দের প্রকৃতি বিচার"। তৃতীয় পর্বে "বাংলা কাব্যে প্রযুক্ত অলঙ্কারগুলি"র মূল্যায়ন।
প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক গবেষক ড.দাস মহোদয় রবীন্দ্র সঙ্গীত ও কবিতার ভুবনের নান্দনিক ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করে পাঠক প্রিয়তার সদ্ব্যবহার "চিত্রগীতময়ী রবীন্দ্র বাণী" নামক গ্ৰন্থে প্রকটিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ও কবিতা'র সঠিক সৌন্দর্য প্রীতি'র যে চিত্রময়তা ও সুরের মূর্ছনা অন্তনিহিত রয়েছে তা মনোবিজ্ঞানী ভাবনায় বিশ্লেষণ করে সমাজ ও ছাত্রছাত্রী প্রিয়ভাজন হয়েছিলেন।
প্রাবন্ধিকের বৈষ্ণব সাহিত্য সমাজ ও রসতত্ত্বের বিশ্লেষণী মনোভূমির ব্যতক্রমী গ্রন্থ:- "বৈষ্ণব রসপ্রকাশ"। বস্তুতঃ পূর্বসূরীর প্রাচীন আদর্শকে গ্রহণ করেও বৈষ্ণব তত্ত্বের সুনিবিড় প্রয়োগও তথ্য বিশ্লেষণে যথার্থ মৌলিকতার পরিচয় সুদৃঢ় করেছেন। ফলতঃ চৈতন্য মহাপ্রভু'র প্রবর্তিত আন্দোলনের 'ঐতিহাসিক ও সামাজিক ' প্রেক্ষিতটি মূল্যায়ন করে চৈতন্য মহাপ্রভু'র প্রেমধর্মের ভেতরে যে সুফী প্রভাব বিদ্যমান, সে বিষয়টির প্রতি রূপক সংকেতের আওতায় এনে দিয়েছিলেন।
ড.দাস "সমাজ-প্রগতি-রবীন্দ্রনাথ"গ্রন্থে 'রবীন্দ্র জীবন ও রচনায় সমাজমনস্কতা'র পরিচয় রয়েছে। বস্তুতঃ গ্রাম পুনর্গঠন, গ্ৰামসমাজের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমাজের নিম্ন রোজগারের মানুষদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সর্বদা আকর্ষণ ও নজর' ছিল,তাই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রাবন্ধিক।
অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাস "রবীন্দ্র-কল্পনায় বিজ্ঞানের অধিকার" বইটিতে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূ-বিজ্ঞান, পরমাণ বিঞ্জান ও প্রাণ বিজ্ঞানের সংযোগ স্থাপনের ঐতিহ্য বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কল্পনা ও ভাবনাচিন্তায় বিজ্ঞানের ছাপ নিয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ আগে লেখা হলেও কিন্তু এই বিষয় নিয়ে সম্পূর্ণ একক বই এই প্রথম।
প্রাবন্ধিক আন্তর্জাতিক গবেষক ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত ২৪ টি প্রবন্ধের মালা সংকলন :- "১৪০০ সাল ও চলমান রবি" পুস্তকটি।
ড.দাস মহোদয়ের 'বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগে'র নানা ধরনের প্রসঙ্গকে পাথেয় করে পঁচিশটি প্রবন্ধের সংকলন বিশ্ববাসীকে "দেশ-কাল-সাহিত্য" নামে গ্রন্থটি উপহার দিয়েছেন।
এছাড়াও "বাছাই প্রবন্ধে" রয়েছে ১৪টি নানা ধরনের জাতীয় চিত্রকল্পযুক্ত প্রবন্ধ। উদাহরণ স্বরূপ:-''রাজা-প্রজা পরিস্থিতি-প্রাচীন ভারতে ও মধ্যযুগের বাঙলায়'', ''কৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রূপ ও স্বরূপ'', ''মহাপ্রভুর বাউল-ব্যক্তিত ও নামপ্রীতি সংগতি'', ''দেবমানব শ্রীচৈতন্য'', ''শ্যামাসংগীত ও রামপ্রসাদ'', ''শহর কলকাতায় আরবি-ফারসী-উরদু-সংস্কৃত'', ''বঙ্কিম-রবীন্দ্র সম্পর্ক'', ''অথ বিবেকানন্দ রবীন্দ্র-কথা'', ''কথাকার মানিকের ইতিকথা'' ইত্যাদি।
🍂
আরও পড়ুন 👇
প্রাবন্ধিক গ্ৰাম ভারতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে মানুষ্যসমাজ ''একমুঠো অন্ন থেকে'' বঞ্চিত না হলেও কিন্তু প্রবল ''ইংরেজ কোম্পানীর শাসনে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে নয়া জমিদার ও তস্য নায়েব গোমস্তাদের অত্যাচারে'' গ্ৰাম ভারতে আজও অসহায়। মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের নায়ক ও নায়িকা রাধাকৃষ্ণের প্রণয় কাহিনির যুথবদ্ধ মিল "ইউসুফ জুলেখা"র প্রণয় কাহিনি'র সুনিবিড় প্রভাব গভীরভাবে লক্ষ করেছেন প্রাবন্ধিক "কৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রূপ ও স্বরূপ'' শীর্ষক নামডাক সম্পন্ন প্রবন্ধে।
অধ্যাপক দাসের "অথ বিবেকানন্দ রবীন্দ্র-কথা'' প্রবন্ধে 'বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ উভয়ে'র সুদৃঢ় মানসিকতা ও আদর্শের এক হৃষ্টপুষ্ট-দিকটির প্রতি মনোনিবেশ করেছেন, তাই মন্তব্যটি গ্ৰহনযোগ্য:-
"আমাদেরই দেশের আধুনিক দুজন মনীষী পুরাতনকে ভেঙে নতুনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, তাঁরা কর্মী মানুষের জয় ঘোষণা করে গেছেন, শূদ্রের অভ্যুত্থান সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।”
গবেষক দাস মহোদয় "'সাঁওতালী-বাংলা সমশব্দ অভিধান''-এ ' সাঁওতালী শব্দের প্রাচীনতা' ও তার থেকে বিশাল সংখ্যক 'নব্য ভারতীয় আর্যভাষার শব্দের উৎপত্তি', তার গ্ৰহনযোগ্য প্রমাণ করেছেন।
অধ্যাপক ড.ক্ষুদিরাম দাস ''কবিকঙ্কণ চণ্ডী'' গ্রন্থ সম্পাদনা করে বাংলা সাহিত্যে 'কবিকঙ্কণের জীবন ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন চিন্তার প্রসার' ঘটিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে "মুকুন্দ" ই যে তাঁর আসল নাম, ''মুকুন্দরাম'' নয়-তা মনেপ্রাণে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
পরিশেষে প্রাবন্ধিক, গবেষক , অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাসের রাবীন্দ্রিক গদ্যশৈলীর বিষয়টি উল্লেখের দাবীদার ।তিনি যুক্তি তর্কে সজ্জিত করে নৈয়ায়িক-এর মতো প্রবন্ধের যুথবদ্ধ বক্তব্যকে বিন্যস্ত করে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন । ফলতঃ প্রাবন্ধিক 'গদ্য পরিমিত, যুক্তিনিষ্ঠ ও নান্দনিক বোধে উদ্দীপ্ত! বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাধুনিক ভাবনা চিন্তা প্রয়োগ করেও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকলেও বর্তমান সময় ও সমাজের বিদগ্ধমহলে বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক তকমা পেতে শুধু সময়ের অপেক্ষা।
0 Comments