জ্বলদর্চি

উদয়ের পথে /তৃতীয় পর্ব/মলয় সরকার

মন্দিরের পথে দোকানের সারি

উদয়ের পথে
তৃতীয় পর্ব
মলয় সরকার


স্টোরে ঢোকা গেল। আমাদের পরিচিত জিনিস অনেক কিছুই পাই না, তবু ওরই মধ্যে খুঁজে খুঁজে কিছু কাজ চালাবার মত জিনিস নিয়ে ফিরলাম।ঘরে ঢোকার মুখে দেখি লেখা রয়েছে, ‘আস্তে কথা বলুন। প্রতিবেশীর যেন অসুবিধা না হয়’।
বুঝলাম, কেন সারা পাড়া নিস্তব্ধ। ওরা কোন আওয়াজ পছন্দই করে না।

একটা গোটা দেশে এটা কি করে হয়! সমস্ত মানুষ একই নীতি পছন্দ করে! কেউ আওয়াজ করে না! অথচ আমাদের দেশে তো দেখি, কি নেতা-নেত্রী , কি সাধারণ মানুষ, জোরে কথা বা উচ্চগ্রামের ঝগড়া তো চালিয়েই থাকেন,তা ছাড়াও মাইক্রোফোনে যে কোন কথা বা গান সমস্ত ডেসিবেলের মাত্রা ছাড়িয়ে ব্রহ্মলোকে পৌঁছে দেবার চেষ্টায় সবাই ব্যস্ত।কোন সজ্জন , এ ব্যাপারে কথা বললে, তাঁর অপমানিত হওয়ার সম্ভাবনা তো আছেই, উপরন্তু প্রাণহানিও হতে পারে, হয়ও।

পরদিন ঘুম ভাঙ্গল সকাল ৮ টায়- বাইরে বেশ মেঘলা, বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া। চিন্তা হচ্ছিল আজ বেরোব কি করে। অবশ্য একটা কথা, জাপানে বছরে বেশিরভাগ সময়েই বৃষ্টি হয়।কাজেই সব সময়েই ওরা ছাতার ব্যবস্থা রাখে।তবে বৃষ্টির তীব্রতা বোধ হয় সব জায়গায় বেশি হয় না, অনেকটা ঝিরঝির করে বৃষ্টির মত। তাতে ওদের কাজের খুব অসুবিধা হয় বলে মনে হয় না। তবে একেবারেই যে জোরে বৃষ্টি হয় না তা নয়, আমরা নিজেরাই দু একবার আটকে গিয়েছিলাম বৃষ্টির চোটে।

যাক, বেলা এগারোটায় আমরা বেরোলাম। তখন আকাশ পরিষ্কার।আজ আমাদের প্রথম দর্শনীয় সেন্সোজী টেমপ্ল। মোবাইলে গুগলবাবা ম্যাপের সাথে রাস্তা দেখাতে দেখাতে নিয়ে চলল আমাদের। আমরাও বাধ্য বশংবদের মত তার দেখানো রাস্তা দিয়ে , ডাইনে গিয়ে বাঁয়ে বেঁকে আবার সোজা , যখন যেমন বলছে চলতে চলতে হঠাৎ দেখি সামনেই এক মোড়ের মাথায় মন্দিরের গেট।লেখা পড়ার তো সাধ্য নেই। গুগল যখন এনেছে, তখন এটা ভুল জায়গা হতেই পারে না।

এই সেন্সোজী মন্দিরটি যে জায়গায় , সেই অঞ্চলটির নাম আসাকুসা। এই মন্দিরটি টোকিওর প্রাচীনতম মন্দির এবং জাপানে খুবই বিখ্যাত। এটি  অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের (Sho Kanzeon Bosatsu) মন্দির। একে Asakusa Kannon ও বলা হয়।এখানে বছরে প্রায় তিন কোটি মানুষ পদার্পণ করেন। এই মন্দিরটি বৌদ্ধ ধর্মের Tendai শাখার উপাস্য দেবতার প্রতি নিবেদিত।

গল্প আছে যে,অতীতে দুই ভাই হিনোকুমা হামানারি ও হিনোকুমা তাকেনারি দুজনে মাছ ধরছিল সুমিদা নদীর জলে। মাছ ধরতে গিয়ে তাদের জালে ওঠে এই মূর্তিটি।তখন তারা গ্রামে গিয়ে এই কথা বলতেই, গ্রামের প্রধান, মূর্তিটি দেখে দেবতাকে চিনতে পারেন। তিনি তখন নিজের বাড়িতেই যত্ন করে একে স্থাপন করেন ও পূজা করতে থাকেন।পরে এইখানেই তৈরী হয় আজকের মন্দির।

এরকম গল্প অবশ্য অনেক জায়গার দেবতার ক্ষেত্রেই প্রচলিত আছে।তবে বিগত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই মন্দিরটি বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়।পরে আবার তার উপর নতুন করে মন্দির তৈরী হয়।প্রথম মন্দিরটি স্থাপিত হয় ৬৪৫ খ্রীষ্টাব্দে।তারপর এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমায় বিধ্বস্ত হওয়ার পর পুনর্নির্মিত হয়। এখানে নাকি একটি গাছ আছে যা, বোমায় প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার পোড়া বাকী অংশ থেকেই পুনরায় গাছটি বৃদ্ধি লাভ করে।

🍂

যাক, ঢোকার মুখেই দেখি ,মন্দিরের বিশাল রংচঙে উঁচু গেট যার নাম Kaminarimon।এটির বিশাল কারুকার্য রঙ ও  এর যে কাগজের একটি বিশাল লাল রঙের লণ্ঠন রয়েছে সেটি আকর্ষণ করবেই। এর নাম (Thunder Gate)। এই গেটের দুপাশে রয়েছে দুটি বিশালাকায় মূর্তি যার ডান দিকেরটির নাম ফুজিন (fujin,যিনি হাওয়ার দেবতা  বাঁ দিকেরটির নাম রাইজিন (Raijin).যিনি বজ্রের দেবতা।এনারা আসলে শিন্টো দেবতা।এই গেটটি বার বার ধ্বংস হয়েছে এবং বারবারই তৈরী হয়েছে। এখানে দেখি বহু তরুণ তরুণী সুসজ্জিত হয়ে নিজেদের সেলফি তুলছে। তাই গেটেই প্রচুর ভিড়। এতই ভিড়, আমি প্রথমে তার সাথে ঐ দেবতাদের দেখে ভাবলাম, এটাই কি মন্দির না কি!এই গেটটি প্রথম তৈরী হয় ৯৪১ খ্রীঃ তে। তারপর অনেক বার অনেক ভাবে এটি নষ্ট হয়। শেষ বার এটি তৈরী করার দায়িত্ব নেন Matsushita Electric Industrial Company (এখন Panasonic) । এবং সেটি তৈরী হয় ১৯৬০ সালে। 

শিন্টো দেবতার কথা বলতে গেলে যে প্রসঙ্গ আসে, তা হল, জাপানে যদিও প্রধানতঃ শিন্টো এবং বৌদ্ধ ধর্ম বেশি প্রচলিত, তবু এ ছাড়াও হিন্দু ধর্ম, তাও ধর্ম, জেন, ইসলাম, জৈন, খ্রীষ্ট ইত্যাদি অনেক ধর্মই চলে।
এই শিন্টো ধর্মের উৎপত্তি জাপানেই বলে মনে করা হয়।এই ধর্মে প্রধানতঃ প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে দেবতার আসনে বসানো হয়েছে।তবে এটি ধর্মের চেয়েও বেশি বিশ্বাস ও আচার ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এখানে বৌদ্ধধর্মও সমান ভাবেই মানা হয়।একজন মানুষ শিন্টো আচার আচরণ পালন এবং বৌদ্ধ ধর্মাচরণ একসঙ্গেই করতে পারেন।দুটি ধর্ম অনেক সময়েই খুব ঘেঁষাঘেঁষি করে চলে।এখানে দুই মতের মন্দিরই রয়েছে। তবে শিন্টো মতাবলম্বীদের মন্দিরের একটি নিদর্শন আছে  আলাদা করে। তা হল এদের গেটের ধরণ। 

গেটগুলি প্রধানতঃ দুপাশে দুটি থামের উপর প্রতিষ্ঠিত। আর তার উপরে একটি নৌকার মত দুপাশ উঁচু পাটাতন আছে।আসলে ঠিক একটি নয়, দুটি পাটাতন বা Lintel আছে। তার মধ্যে নীচেরটি সোজা, কোন বাঁকাচোরা নেই। আর তার উপরেরটি বাঁকা নৌকার মত। আর এগুলির রঙ প্রায়শঃই লাল ধরণের, সঙ্গে কালো রঙের অস্তিত্বও আছে। এগুলির নাম টোরি (Torii)গেট। ওদের ধারণা এগুলির মধ্যে দিয়েই Kami বা ঐশ্বরিক শক্তি যাতায়াত করে। এই টোরি গেটের ছবি বহু জায়গাতেই আইকন হিসাবে দেখা যায়।এই থামগুলি প্রধানতঃ তৈরী হত কাঠ বা পাথর দিয়ে।বর্তমানে অবশ্য অন্য নানা জিনিস দিয়েও বানানো হয়।কোন কোন জায়গায় এই মন্দিরের রাস্তার উপর বহু দূর থেকে এই গেট দেওয়া হয়। তাতে বোঝা যায় এই মন্দিরের অস্তিত্ব।সেগুলির আবার নামকরণ হয় প্রথম গেট, দ্বিতীয় গেট ইত্যাদি। অনেক জায়গায় ভক্তরা মানত হিসাবেও এই গেট স্থাপন করেন। ফলে কোন কোন মন্দিরে অনেক গেট হতে দেখা যায়।
অনেক ক্ষেত্রে আবার কোন কোন বৌদ্ধ মন্দিরে বেশ কয়েকটি শিন্টো দেবতাকেও দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে ঐ বৌদ্ধ মন্দিরেও টোরি গেট দেখা যেতে পারে। অন্যথায় এটি প্রধানতঃ শিন্টো মন্দিরের প্রতীক চিহ্ন। আর একটি জিনিস সুক্ষ্ম হলেও লক্ষ্য করলাম, বৌদ্ধ মন্দিরকে ওরা বলে প্রধানতঃ Temple, কিন্তু শিন্টো মন্দিরকে বলে Shrine.
আর এটি যেহেতু শিন্টো মন্দির, কাজেই এর গেটটিও ওই টোরি গেট , তবে আকৃতিতে বেশ বড়।এই গেট থেকে ভিতরের দিকে তাকিয়ে দেখি একটি রাস্তা সোজা চলে গেছে মন্দিরের দিকে।এই রাস্তাটি প্রায় ২৫০ মি। দীর্ঘ, যার দুপাশে রয়েছে অগুণতি দোকান। এই দোকানের সংখ্যাও কম নয় , প্রায় ৯০ টি দোকান আছে এখানে।তার মধ্যে বেশির ভাগটাই নানা ধরণের খাবার দোকান, এ ছাড়া আছে বিভিন্ন ধরণের উপহারের বা জামা কাপড়ের দোকান।রাস্তাটির নাম Nakamise-dori ।রাস্তায় অসংখ্য মানুষ দেখলাম, তবে এমন নয় যে, শুধু বয়স্করা যাচ্ছে, অসংখ্য তরুণ তরুণীও চলেছে, মন্দিরের পথে। এখানে খাবারের দোকানে একটা কথা, প্রায় সব দোকানেই বলা আছে, এখানে খাবেন না।আসলে এখানেই খেলে রাস্তা নোংরা হতে পারে তাই এই সাবধানতা। তবে খাওয়া যে সম্পূর্ণ বন্ধ এমন নয়, কিন্তু নোংরা কোথাও হচ্ছে না, অর্থাৎ সে ব্যাপারে সবাই সতর্ক।
মন্দিরে কিমোনা পরা জাপানী মেয়েরা

এখানে জাপানী তরুণ তরুণীরা অনেকেই বেশ সুন্দর , তাদের জাতীয় পোষাক পরে এসেছে দেখলাম। তা বেশ আকর্ষণীয় ও সুন্দর। জাপানী মেয়েরা পরেছে কিমোনো আর ছেলেদেরটাও কিমোনো তবে ধরণ আলাদা। ছেলেদের পোষাকটার নাম Montsuki । তবে ওরা সাধারণতঃ যা পরে তার নাম Yukata । এই পোষাকের মধ্যে মেয়েদের পোষাক প্রধানতঃ খুব ঊজ্বল রঙের আকর্ষণীয় আর ছেলেদেরটা প্রায়শঃ কালো রঙের।এই কিমোনো আবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হতে পারে উপলক্ষ্যের উপর নির্ভর করে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখলাম, ওদের যে কোন রঙের কিমোনোর সঙ্গেই মোজাটা সাদা রঙের এবং তার সাথে ওরা জুতো প্রায় পরে না, চটি পরে। যারা খুব ভাল সাজে, তারা সব কিছু অর্থাৎ ব্যাগ, ছাতা পাখা ইত্যাদি কিমোনোর সাথে ম্যাচিং করেই পরে। এমন কি তার জন্য চুল বাঁধাও আলাদা।ওদের কোমরে যে চওড়া বেল্টটি থাকে তার নাম ওবি। অনেক ক্ষেত্রে অনেক বিদেশী পর্যটকজুটিকেও এই সুন্দরভাবে ম্যাচিং কিমোনো আর ইয়ুকুতা পরে যেতে দেখেছি। এগুলো কিছু সময় পরার জন্য ভাড়া পাওয়া যায়, বা এগুলো পরিয়ে উপযুক্তভাবে সাজিয়ে দেওয়ার অনেক দোকান আছে, যেগুলোতে সবাই সাজেন এবং নিজেদের ছবি তোলেন ওই পোষাকে।

এরপর এগিয়ে চলুন সঙ্গে পরের পর্বের জন্য–

ক্রমশঃ -

Post a Comment

0 Comments