জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —৩৭/সুমিত্রা ঘোষ


লোকমাতা রানি রাসমণি —৩৭

সুমিত্রা ঘোষ 

দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার পর রানি রাসমণি যে উইল করেন তাতে তিনি লিখেছিলেন, 'আমি একটি দ্বাদশ শিবমন্দির জগদীশ্বরী কালীমাতা ঠাকুরনির মন্দির, রাধাকৃষ্ণের মন্দিরসহ একটি দেবালয় তৈরি করব। ১৮৫৫ সালের কিছু পরে তিনি এই - দলিল লিখে গিয়েছিলেন। সে আমলে সুপ্রিম কোর্ট ছিল  কলকাতায়।  হেস্টিং সাহেব  ছিলেন তৎকালীন সুপ্রিম- কোর্টের অ্যাটর্নি । সুতরাং জেমস হেস্টিং সাহেবের কাছ থেকে রানি জমি কিনেছিলেন। এতে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না।
রানি রাসমণি ছিলেন একজন বিদগ্ধ মহিলা। সেযুগে মেয়েরা অন্তঃপুরচারিণী হতে থাকত। রানি সে যুগের নারী হয়েও ঘরের মধ্যে বন্দী থাকেননি। উনিশ শতকের নবজাগরণের সঙ্গে অপ্রত্যক্ষ ভাবে তিনি জড়িত ছিলেন। নবজাগরণের প্রাণপুরুষ রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রমুখেরা রানির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন সমাজ সেবা মূলক কাজের মধ্য .. দিয়ে। রাজা রামমোহন রায় রাজচন্দ্র দাসের বিশেষ বন্ধু ও পরামর্শদাতা ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় রানিকে পিসিমা বলে ডাকতেন এবং বিশেষ সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। সে যুগে সমাজ সংস্কারে রানির ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। যেমন বাল্যবিবাহ ও সতীদাহ প্রথা রোধে রানির ভূমিকা ইতিহাস হয়ে আছে। সতীদাহ প্রথা থেকে বেঁচে ফিরে আসা মেয়েকে জানবাজারের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। একারণে পরিবারের লোক অসন্তুষ্ট হয়েছেন। সেযুগের ব্রাহ্মণ প্রধান পুরোহিত সমাজ রানির পরিবারকে একঘরে করেছেন। তাতেও রানি কর্তব্যকর্ম থেকে সরে আসেননি। তিনি আশ্রিতকে আশ্রয় দিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করেছেন। রানি রাসমণি একাধারে ছিলেন সমাজসংস্কারক, মানবপ্রেমিক  ও আধ্যাত্মিক - মনোভাবাপন্ন সাত্ত্বিক মহিলা। দক্ষিণেশ্বরে মন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে রানি রামমণি যে কঠোর সাত্ত্বিক জীবন অবলম্বন করেছিলেন তার কোনও তুলনা নেই।
🍂
দক্ষিণেশ্বরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মা ভবতারিণী দেবীকে প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীর ইতিহাসে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। দক্ষিণেশ্বরে যে উইল তিনি করে গিয়েছেন তাতে পরিস্কার ভাবে সব লিখে গিয়েছেন। দক্ষিণেশ্বর হচ্ছে রানি রাসমণির অবদান আর শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের দর্শন ও সর্বধর্ম সমন্বয়ের পীঠস্থান হয়ে উঠেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণদেব মা ভবতারিণী সম্বন্ধে বলতেন; মায়ের নিঃশ্বাস পড়ে, মা হাঁটেন। দোতলায় ওঠেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব মায়ের পায়ের নূপুরের আওয়াজ শুনতে পেতেন মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন।  বিশ্বসংসারে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় সবেতেই আছেন। প্রতিদিন মায়ের মন্দিরে এত ভক্ত- সমাগম হয় যার তুলনা মেলা ভার, সকল ভক্তমণ্ডলী মাকে দর্শন করে মনের শান্তি খুঁজে পান।

মন্দির সংলগ্ন ঠাকুরের ঘরে প্রবেশ করে নীরবতা অবলম্বন করে বসলে মন শান্তি খুঁজে পায়, মনে হয় ঠাকুর আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন। যে বটগাছের নীচে বসে ঠাকুর ধ্যান করতেন সেখানে গেলে আর ফিরে আসতে মন চায় না। বটগাছের বেদির উপর বসে থাকলে মনে হয় এখানে ঠাকুরের কত না পদধূলি আছে ? পাশে নহবতখানা যেখানে জগদীশ্বরী, মা- সারদা বসবাস করেছেন। নহবতখানার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাল লাগে মা সারদার কথা। এতটুকু ঘরে আমাদের মা জীবনের কতটা দিন কাটিয়েছেন। ঠাকুরের ঘরে যে সমস্ত ছবি টাঙানো আছে তা দেখলেই সেসময়ের ঐতিহাসিক কাহিনি মনের মাঝে ভেসে ওঠে, মন শান্তি খুঁজে পায়। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের মত ভক্তসমাগম বোধহয় অন্য কোথাও হয় না। ৩৬৫ দিনই নিত্যসেবা হয় মায়ের। মা ভবতারিণী মন্দিরে উৎসব তো লেগেই আছে। বিশেষ বিশেষ উৎসবগুলি হচ্ছে  শারদোৎসব, দীপান্বিতা পুজো (বার্ষিক উৎসব), রটন্তী কালীপুজো, ফলহারিণী পুজো, স্নানযাত্রা, প্রতিষ্ঠা দিবস এবং কল্পতরুর দিন বিশেষ পুজো হয়।

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

 

Post a Comment

0 Comments