সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ৩০
গৌতম বাড়ই
মায়ের মৃত্যুটা তাদের কাছে ফিকে হয়ে যায়নি, তবে বসন্তসেনা ও তার বাবার কাছে প্রাথমিক শোকের যে গভীর ধাক্কাটা গাঢ় হয়ে মনে চেপে ধরে এসেছিল, তা অনেকটা তরল হয়ে এসেছে আজকাল। তার মনে পড়ে সবসময় মায়ের বিয়োগব্যথাটা বিভিন্ন সময়ে, কোনোদিন হয়ত বেশি, আবার কোনওদিন একটু কম। অন্য কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়লে হয়ত সেইভাবে মনেই পড়ে না কোনো কোনো দিন। এই বোধহয় বেশিরভাগ পরিবারে ঘটে থাকে।
অভিকাকু অনেকদিন পরে আবার এসেছে। তার বাবা সুশোভন স্কুল থেকে আজ অনেকক্ষণ আগেই এসেছে। এসেই বন্ধুর সাথে গল্প- গুজবে মশগুল হয়ে আছেন। এই অভিকাকু এলেই বাবা অনর্গল কথা বলতেই থাকেন আর কেমন যেন ছেলেমানুষীতে পেয়ে যায় তাকে। আবেগে ছোটবেলার কত কথা আর গল্প বলেন বসন্তসেনাকে। এই যেমন আজকে কথায় কথায় তার বাবা সুশোভন সেই ছেলেবেলার কত কথা বলছেন, এর আগেও শুনেছে সে অনেকবার। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে সেই ঘন শীতের ভোরে ডুয়ার্সের গ্রামগুলি মাহেন্দ্রক্ষণের আগেই জেগে উঠত। উলুধ্বনি শোনা যেত, গৃহস্থের উঠোন নিকোনো হয়ে যেত । সবার গোয়ালে গরুর গায়ে পিঠের ছাপ দেওয়া হত। দূর থেকে যেমন ভেসে আসত মাইকে বাংলা গান আর ভাওয়াইয়া তার সাথে। সুশোভন বলে- " ডুয়ার্সের তখনকার সেই শীত রাতের কথা মনে পড়লে এখনও শরীর হিম হয়ে আসে। ঘন কুয়াশার স্তর আর প্রচণ্ড শীত। গায়ে গরম পোশাক পড়ে লেপের তলায় শুয়েছি। অন্ধকার ভোর রাতেই টের পাচ্ছি বাইরে উঠোনে মায়ের লেপামোছা চলছে। উলুধ্বনি শোনা গেল। পরপর সব বাড়ি থেকে। আমরা ভাইবোনেরা চুপটি করে নিঃসাড় পড়ে রয়েছি জড়োসড়ো হয়ে লেপের ভেতরে। আর ভাবছি, কেন যে এই পৌষ সংক্রান্তির ভোর আসে। রাত থাকতেই ঘুমের মজাটাই নষ্ট করে দেয়। আবার এই আমি সেদিনের সন্ধেয় বেজায় খুশি, সবাই মিলে পিঠেপুলি খাচ্ছি। সরাপিঠে, পাটিসাপটা আর দুধচুষি পিঠেই হত বেশি করে। ওদিকে নলেনগুড়ের থেকে খেজুরপাটালি পাওয়া যেত বেশি করে। সেই ছোটবেলার পৌষ সংক্রান্তি এখনও ভুলতে পারি না। তোরা সেই মজা নিতেই পারলি না। " অভিকাকুও নস্টালজিক হয়ে ওঠে বাবার কথা শুনে।
🍂
বসন্তসেনা বলে - " না বাবা সরি! ভোরের ঘুম ভেঙে ঐ শীত গায়ে মেখে পৌষ সংক্রান্তিতে মেতে উঠতে পারব না। এই বেশ ভালো আছি। পান্নামাসি দু- একটা আইটেম বানালো কি না বানালো ঠিক আছে, না হলে তোমায় আমি পাড়ার মোড় থেকে কিনে এনে কী ভালো আর সুস্বাদু পাটিসাপটা খাইয়েছি ! বলো এটা অভিকাকুকে।"
- " তা ঠিক বলেছিস। পেশাগত কারণে এই মিষ্টির দোকানগুলোতে বেশ উচ্চমানের হরেকরকম পিঠে তৈরী করছে এই শীতের সময়। অস্বীকার করছি না। তো আগামীকাল অভিকেও খাওয়ানোর ব্যবস্থা কর।" বলে মেয়ের দিকে তাকালেন সুশোভনবাবু।
অভিকাকু লাফিয়ে উঠলেন - " ক্ষেপেছিস তুই! না রে হাসনু, আমার সুগার লেভেল জানা আছে তোর বাবার? মিষ্টি নৈব নৈব চ। একদম না। তবে তোদের মুখে পাটিসাপটার কথা শুনে একটু তো খেতে ইচ্ছে করছে। ঐ একপিস আমার জন্য নিয়ে আসিস, তাহলেই হবে। আমার বরাদ্দ ওই এক পিস এই শীতে রাখছি তাহলে। "
- হ্যাঁ কাকু কালকেই হবে। আর সঙ্গে একপিস মাছভাজা খাবে, ব্যালেন্স হয়ে যাবে।
তিনজনেই একসঙ্গে হেসে উঠলো এরপর। অভিকাকু এলেই ঘরের মধ্যে আরও বেশি করে প্রাণের ছোঁয়া লাগে যেন। বসন্তসেনার তাই মনে হয়।
সুশোভনবাবু গল্পে গল্পে আরও মেতে উঠেছেন। তার পরিচ্ছন্ন এক রাজনৈতিক মতাদর্শ তো আছেই, আর আছে সামগ্রিক এক সুস্থ চিন্তা ভাবনা। যখন তার বাল্যবন্ধু বলতে থাকেন,"এইসব রাজনৈতিক ভাবনাগুলো মন থেকে তাড়িয়ে দে শোভন। "
সুশোভন অবাক হয়ে অভির দিকে তাকায়।
- তুইও কী তাহলে এক সর্বংসহা মনোভাব নিয়ে এই বর্তমান অথবা চিরন্তন প্রবাহমান অবস্থান থেকে পলায়ন করছিস?
অভিজিৎ বলে উঠলো -" না, একে পলায়ন বলে না। একে বলে মানিয়ে নেওয়া। সময়ের সাথে। ধর্ম আর রাজনীতি যখন মিশে যায়, তখন যে যে কোনও দেশের সমূহ বিপদ ভবিষ্যতে আমি তা ভালোমতন জানি শোভন। এ আমাদের মতন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অচিরেই উন্নয়নের সমস্ত গতিধারা রূদ্ধ করে দেবে এ আমার কাছে না বুঝবার কিছু নেই। আমি বলছিলাম শুধুমাত্র ক্ষণিকের গল্প গুজবে এসব প্রসঙ্গ এনে কী লাভ? "
- "ক্ষণিকের নয় রে অভি। রাজনীতি আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জড়িয়ে থাকে এ শরীরে। আমরা আদতে রাজনৈতিক এক জীব। আমাদের ভালো থাকা , আমাদের মন্দ থাকা সবটাই রাজনীতির ওপর। এই যে সাধারণ মানুষের এত রক্ত ঝরানো বছরগুলি আর স্বাধীনতা সংগ্রামের পর , যে স্বাধীনতা পেলাম , আমাদের পরিশ্রমের যে সংবিধান লেখা হল সাধারণ মানুষের জন্য , আদৌ সেইসব মৌলিক অধিকারগুলি আজ মানা হচ্ছে কী? গণতন্ত্রের কোন সংজ্ঞায় তুই বিশ্বাস করবি। সত্যি আমাদের দেশের দারিদ্রতা নয়, প্রশাসনের ও ক্ষমতায়নের ব্যাপক দূর্নীতি আমাদের দুর্দশার কারণ। নইলে এ দেশ আজ শুধু খাতায় কলমে নয়, সারা পৃথিবীর মানুষের চোখের কাছে উন্নত এক দেশে পরিণত হত। "
বাবা আর অভিকাকুর কথা মনযোগ দিয়ে শুনছিল বসন্তসেনা। তারও মনে প্রশ্ন জাগে, তবে সমাজতন্ত্র আমাদের মতন গরীব দেশে প্রতিষ্ঠিত হল না কেন? বিশেষত সোভিয়েত রাশিয়ার বিগত শতাব্দীতে ওই ভয়ানক রকম উত্থানে! অথচ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পর বামদলের প্রতিষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়ন ভারতবর্ষের সবচেয়ে পুরানো রাজনৈতিক দল হয়েও সেই অর্থে ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারল না। আশ্চর্যের দেশে তখন প্রচণ্ড ক্ষুধা ছিল, রোজগারহীন অসংখ্য মানুষ ছিল, গরীবতা ছিল, নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল, সরকারি পরিকাঠামো আজকের মতন মানুষের কাছে এত সহজলভ্য ছিল না। স্কুল , কলেজ , হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় নামমাত্র ছিল বা বলতে গেলে ছিল-ই না। বিপ্লবের আবহাওয়া ছিল, তবুও সমাজতন্ত্র বা লেফটিস্টদের হাতে চূড়ান্তভাবে দেশের শাসন ক্ষমতা যায়নি। দুচারটা রাজ্যে বিচ্ছিন্ন ভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতালাভ এইটুকু শুধু। কেন? আর দীর্ঘদিনের রাজ্যশাসন একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরাতে। সেখানেও প্রতিমুহূর্তের রাজনৈতিক সংঘাত বামভাবাপন্ন দলগুলোর মধ্যে। বাসবদত্তার মনে হয় যখন বামেরা সত্যিকারের সংসদীয় গণতন্ত্রের উপর পূর্ণ আস্থা রেখে সম্পূর্ণভাবে এই রাজ্যের জন্য শিল্পায়নের এক গতি আনতে চাইলেন, আবার স্বাধীনতার সময়কার পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করতে চাইলেন বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীকে নিয়ে ঠিক তখনই তাদের রাজনৈতিক পরাজয় ঘটে গেল। এ কী ইতিহাসে পশ্চিমবঙ্গের ওপর দি গ্রেট কনসপারেসী বলে অভিহিত হবে না? বাসবদত্তার এরকম মনে হয় আজকাল। আমাদের রাজ্য তো সেই অর্থে পিছিয়েই রইলো। কর্মসংস্থান কোথায়? সবাই রাজ্য ছেড়ে বাইরে যাচ্ছে এখনও জীবিকা নির্বাহের জন্য। কেন? এক দিকে দেশ আর অন্য দিকে রাজ্য , এ দুয়ের মাঝে পড়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন বাসবদত্তা। চিন্তার তাল কেটে গেল অভিকাকুর কথায় ।
- হ্যাঁ রে হাসনুমা তুই ও কী আমাদের মতন গভীর চিন্তায় ডুব মারলি? তোর বাপকে ঐ জন্যে বলেছিলাম, রাজনীতি ভাবনাগুলো ছেড়ে দে এখন। তুইও ওসব ছেড়ে দে। যা চটপট এবার আমাদের তিনজনের জন্য চা বানিয়ে আন। আর আমার ঐ ডাফেলব্যাগের চেনখুলে ভেতর থেকে ভুজিয়ার প্যাকেটটা বের কর। আমার হাতে রাখা প্যাকেটটা দিয়েছি কিন্তু ভুজিয়া আর লাড্ডুর প্যাকেটটা বের করা হয়নি। নে ঝটপট চা আর ভুজিয়া নিয়ে আয় মা।তারপর আবার কথা কই। "
বসন্তসেনাও সবে ভাবছিল চা আর একদফা বানিয়ে আনতে যাবে, আর ঠিক তখুনি অভিকাকু চায়ের বায়না করল। তবে ভুজিয়ার প্যাকেটটা বের করলেও বসন্তসেনা অভিকাকুকে চমকে দেবে একটা নতুন স্ন্যাক্স পরিবেশন করে। কারণ সে, রেডি টু কুক ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের প্যাকেট অন লাইন অর্ডারে বাড়িতে এনে রেখেছে। একদম গরমা- গরম পরিবেশন হবে, তাতে এই শীতে আরও জমবে চা- পান তাদের।
বাবা আর অভিকাকুর গল্পের মাঝেই এ রকম নোনতা গরম খাবার আর চা পেয়ে তাদের মুখে খুশির ঝিলিক দেখে বসন্তসেনার ভেতরটা আনন্দে ভরে গেল। বাবা আর অভিকাকুর খুশির মেজাজ দেখে তখন কে আর! ওরা বসন্তসেনাকে ওর এই খাদ্যপরিবেশনে বাহবা দিতে লাগল। বড়দের আনন্দময় এ মুখ দেখে আগের ভাবনাচিন্তা ওর মাথা থেকে উড়ে গিয়েছে।
চা খেতে খেতে শুনতে পেল তার বাবা সুশোভন বলছে অভিকাকুকে, " বুঝলি শোভন , আমাদের এই ভারতবর্ষ শুধু রাজনৈতিক ভূগোলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। আমাদের ঐতিহ্যবোধ, ঐক্যবোধ , ধর্ম এবং ধারাবাহিকতার বোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই ভারত অতি প্রাচীন আর একদম নবীনের, আর্য এবং দ্রাবিড় , কিরাত, নিষাদ, হিন্দু- বৌদ্ধ - জৈন- পারসিক- মুসলমান - খ্রিস্টান - শিখ ও নাস্তিকের ভারত। এই ভারতবর্ষ তো একদিনে গড়ে ওঠেনি। এর ইতিহাস সুপ্রাচীন, প্রাগৈতিহাসিক। এ দেশের ইতিহাসের প্রত্যেকটি পর্যায়ে প্রধান চরিত্রটি হল, তা এর বহুত্ববোধ। বৈচিত্র্যের বোধ। তাই যখনই সমস্ত বহুত্বকে লুপ্ত করে দিয়ে একের প্রতিষ্ঠা করা, সমস্ত বৈচিত্র্যকে বিনষ্ট করে একাকার করার চেষ্টা যখনই দেখা গেছে, তখন তা ব্যর্থ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে বহুত্বের বোধ। লড়াই সংঘর্ষ হয়নি কখনো এ কথা বললে সত্যের প্রতি মিথ্যাচার করা হবে, একাধিপত্যের চেষ্টা তাও হয়েছে, এও একদম সত্যিকথা। তবে শেষপর্যন্ত ভারতের ইতিহাস বহুত্বকে স্বীকার করার ইতিহাস। তোর নিশ্চয় এর বিরুদ্ধে মতামত নেই?"
- তা কী করে থাকবে বল? তোর আর আমার পৃথিবীকে দেখা তো নিশীথ স্যারের হাত ধরেই। এখনও ওরকম একটা লোককে ভীষণভাবে হারাই।
- "সত্যি রে শোভন। আজ তোকে হাসনুমাকে নিয়ে একটা কথা বলব। "
এই বলে বসন্তসেনার দিকে তাকিয়ে বলল- " কী রে হাসনুমা বলব তোর কাকুকে? "
বসন্তসেনা বলল- " বাবা তুমি আমাকে নিয়ে কী বলবে কাকুকে তা তো আমি জানি না। তবে আমার অনুপস্থিতিতে তুমি কাকুকে আমাকে নিয়ে সবকিছু জিগ্গেস করতে পার। না হলে আমার বিড়ম্বনা হবে তো!
- কোনও বিড়ম্বনা নয়, ওই কয়েকটা মামুলি কথা অভিকে। ওর কিছু পরামর্শ চাই। তুই থাক, কোনো সমস্যা নেই। সেটাই ভালো হবে। "
- আচ্ছা বাবা তবে তাই হোক।
বসন্তসেনা এই কথা বলে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বসল।
ক্রমশ
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments