চিত্রা ভট্টাচার্য
সুদূর মুম্বাইতে বসে গতকাল হাতে এসে পৌঁছলো এবারের ৪৭তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত জ্বলদর্চি পত্রিকার স্বনামধন্য সম্পাদক মূলত কবি শ্রীঋত্বিক ত্রিপাঠী মহাশয়ের "কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা " ---কবিতার বইটি।
ফেসবুকে প্রথম প্রচারে যখন দেখেছিলাম এমন একটি অদ্ভুত বিচিত্র নামে কবিতার বই--- "কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা " আগামী বই মেলায় প্রকাশিতব্য—তখন থেকেই বইটি সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধিৎসা ও নানা কৌতূহল আমার মনে সাড়া জাগিয়েছিল।
যেখানে আজকের যুগের ভাবধারায় প্রতিনিয়ত অজস্র কবি তাঁদের কাব্যধারা ও কবিতাগ্রন্থ প্রকাশ করছেন আধুনিকতার ছোঁয়ায় ও নামকরণে, সেখানে বিশেষ পরিচিত কবি ঋত্বিকের কবিতার বইটির এমন অদ্ভুত নামের বিশেষত্বের কী কারণ ?
'কীলক লিপি' সেই অতি প্রাচীন কালে ৩২০০খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সুমেরীয় সভ্যতার যুগে যে লিপির আবিষ্কার হয়েছিল। যে লিপি ছোট্ট তীরের মত হওয়ার কারণে কিউনিফর্ম বা কীলক লিপি। চার চৌকো কাঁচা মাটির ওপর আঁকিবুকি কেটে তাকে পুড়িয়ে যে লিপি লেখা হতো, সেই ' কীলক লিপি ' নামে কবিতার বই! বই পাওয়ার আনন্দ ও উত্তেজনায় মোড়ক খুলে দেখি গেরুয়া রঙের মলাটের ওপর কীলক লিপির মতই তেমনই অসমান আঁকিবুকি কেটে অ আ ক খ লিখতে চেষ্টা করা প্রচ্ছদটি দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। অবশ্যই নামের সাথে যথেষ্ট সামঞ্জস্যের অধিকারী এই নতুন ভাবধারার বইয়ের মলাটটি।
ধীরে ধীরে বইটির অন্দর-মহলে প্রবেশ করলাম। মনে হলো, বর্তমান দিশাহীন, উদ্দেশ্যহীন স্বার্থপর সমাজের চিন্তাধারায় জীবনবোধে পীড়িত কবি। লিখলেন 'আমার আর কোনো দুঃখ নেই'। জীবনের কোন রহস্য উন্মোচনে কবি চলেছেন অজানা পথে!
কবিতার অলিগলি পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি রাজপথ পার হয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে। "জীবন কখনো মিলবে না জেনেও জীবনের যাত্রা চলে '' —অভীষ্টকে হয়তো সব সময় পাওয়া যাবে না তবুও "পাই বা না পাই, সচেষ্ট হই"।গভীর মনোনিবেশ করে বইটির পাতা উল্টে চলেছি। অসাধ্যকে সাধন করে চলার প্রয়াস দেখি জীবনের স্রোতে পলেপলে ভেসে বেড়ায়। সুন্দর পাতায় স্পষ্ট হরফে নির্ভুল ছাপায় --আনন্দ পাবলিশার্স এর অনবদ্য প্রকাশ।
একের পর এক পাতা উল্টে চলেছি। এবার আবার অবাক হবার পালা। কাব্যলিখনের অচলায়তন ভাবধারাকে ভেঙে কবি যেন এক নতুন আঙ্গিকে তার সৃষ্টিকে আবিষ্কার করলেন। মৃৎ-শিল্পী যেমন দিনের পর দিন কাদা মাটি ছেনে খড়ের কাঠামোয় নরম মাটির প্রলেপ লাগিয়ে রঙ তুলি দিয়ে নতুন করে প্রতিমায় রূপ দান করেন। তিনিও কাব্যের জীবনদেবীকে তেমনই করে অন্য সাজে সাজালেন।
অবশেষে অলঙ্কার দিয়ে অঙ্গসজ্জা সম্পন্ন করলেন। সুদক্ষ কবি ও তার দ্ব্যর্থবোধক ভাবধারায় নিপুণ কলমের টানে অক্ষর ও শব্দ শৈলী প্রয়োগের নানা কুশলতায় বর্তমান অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন নৈরাশ্যের সমাজ জীবনের চলমানতাকে কবিতার রূপদান করলেন। "প্রত্যাশা মানেই ত্রাস, বাসা বেঁধেছেন সন্ন্যাসী"। দরদী মনে ভাবলেন রোগগ্রস্ত পৃথিবীর আরোগ্যের কথা।
এমনি প্রতিটি কবিতার পরতে পরতে কবির গভীর অনুভূতির পর্যবেক্ষণ। "মানুষকে গভীর ভাবে নিয়ো না। মানুষ তো মানুষই।" অথবা "মানুষকে গভীর ভাবে নিতে গেলে আত্মা মরে যায়।" অত্যন্ত সহজ ভাবে জীবন দর্শন ব্যক্ত করলেন। এককথায় তীক্ষ্ণ তিরের দংশন। নিগূঢ় তত্ত্ববোধ প্রতিটি শব্দের আড়ালে।
বইটি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এ আলোচনার শেষ নেই। কবিতা আলোচনা করার যোগ্যতা আমার তেমন নেই। কবিতায় ডুবে থাকা মন নিয়ে কবিতা পড়তে ভালবাসি। এই নতুন ধারায় লেখা বইটির কবিতা পড়ে যেটুকু শিখলাম, যে কথা মনে এলো তাই লিখলাম। আমাকে নাড়া দিয়ে গেল, কবির গভীর আত্মপ্রত্যয়। "সূর্য ডুবে যায় আদিম ঢেউয়ের পিঠে তমোময় বুদবুদ"--- বইটির পাতায় পাতায় ছত্রে ছত্রে এই নশ্বর জীবনের পাওয়া যে এককথায় ফুরিয়ে যায় না সেই গভীর জীবন বোধ, "একমাত্র মহাকবি-ই আবিষ্কার করেন, ব্যঞ্জনার পথ, ত্রিভুজের কেন্দ্র।" কবির শাণিত মননের দৃষ্টিতে তাই বারবার দেখতে পেলাম। আশা রাখি একবার পড়েই এ বইটি পড়া শেষ হবে না। সংবেদনশীল পাঠক হৃদয় বারবার বইটির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াবে। কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীকে তাই তাঁর সৃষ্টির জন্য অজস্র ধন্যবাদ জানাই।
কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা/ ঋত্বিক ত্রিপাঠী
প্রচ্ছদ: দেবাশীষ সাহা
সিগনেট প্রেস/২৫০/–
0 Comments