বাগদি চরিত ( অষ্টচত্বারিংশতি পর্ব)
শ্রীজিৎ জানা
পানশিউলির গঙ্গা বারুনীর মেলা। তা প্রায় একশ বছরের বেশি হবে মেলার বয়স। জায়গাটার অদ্ভূত ভৌগলিক অবস্থান। রূপনারায়ণ নদী বয়ে গেছে আপন মেজাজে। ওদিকে মুন্ডেশ্বরী পড়ল তার বুকে আছড়ে। মুন্ডেশ্বরীর ডাঁয়ে রইল হাওড়া আর বাঁয়ে হুগলী। ভাটোরা হাওড়ার গ্রাম। রূপনারায়নের এপারে রইল কৈজুড়ি। মানে পশ্চিম মেদিনীপুর। তিন জেলার মানুষকে বেঁধে রেখেছে মুন্ডেশ্বরী আর রূপনারায়ণের মিলিত জলধারা। গঙ্গা বারুণীর মেলা হয় পানসিউলির ওপাশে। ঠা ঠা চৈত্র মাসে সারাদিন নধীপাড় জুড়ে মেলার সেকি জাঁকজমক। এই মেলার বিশেষ একটা আকর্ষণ রয়েছে। যার টানে তিন জেলার মারুষ ভীবড় করে মেলায়। মাটির তৈজসপত্রের এত সম্ভার আর কোন মেলায় পাওয়া যাবে না। রানীচক,কৈজুিড়ি, দুধকোমরা ওদিকে খানাকুলের কুমোররা তাদের মাটির নানাবিধ জিনিসপাতি নিয়ে মেলাকে ভরিয়ে তোলে। চাষীরা আগে চাষে জল দিবতে হাঁোড়ি কিনত। বাড়ির বউরা খলা, খাবরি,কলসী, তাবা,তাড় আরও কত কি কিনে ঘুরে ফিরে। একমাত্র কালো মাটির কলসী পাওয়া যায় এই মেলায়। গরম কালে কালো কলসীর জল সারাদিন বেশ ঠান্ডা থাকে। সেই কলসী কেনার হুড়োহুড়ি দেখবার মতো। হালে মাটির জিনিসের ব্যবহার কমেছে গাঁগাওলিতে। প্লাস্টিক,স্টিল,ফাইবার অ্যালুমিনিয়ামের চল হয়েছে গেরস্থে। তবে কুমোরেরাও পিছিয়ে নেই। যুগের সঙ্গে তাল মিলাতে তারাও তৎপর। এখন মাটির তৈজসপাতির সাথে কত ধরণের ঘর সাজানোর জিনিস নিয়ে আসে তারা। আগে গাঁয়ের মেলাগুলোতে শুধু বকাভাঁড়, পয়সা গলানো মাছ, জোড়া পাখি,ছাঁচের পুতুল, লক্ষ্মী কুলা মিলত। এখন রঙচঙে কত ধরণের পশুপাখি,দেবদেবীর মূর্তি,ফলমূল, টব গ্লাস নক্সা করা সরা, ফুল তোলা সরা পাওয়া যায়। দিনে দিনে মেলার জনপ্রিয়ও বেড়েছে তিন জেলার মানুষজনের কাছে। কদিন থিকথিক করে ভিড়। লোক পারাপার করতে হিমশিম খায় মাঝিরা। আগে দাঁোড় বাওয়া নৌকায় খেয়া দিত। এখন ইঞ্জিন বসানো ভুটভুটি চলে।
লোখা নাকে মুখে দুটি ঘুঁজেই সজা হাজির মাস্টারের দয়রে। এসেই জোরসে হাঁক পাড়গে। সে এই ঘরে ঘরের ছেনার মতো খাতির পায়। কেউ কখনো তাকে দুই দুই করে না। লোখার চিৎকার শুনেই বেরি আসে মাস্টার।
– তোর জন্নেই দাঁড়ি আছি। আমি ত কখন থিকে বেরি বসে আছি। চল্, তাত্তাড়ি।
– তমার ত ছটপটানি এট্টু হবেই। তাবাদে ঝাড়া হাত - পা লোক তুমি। বালবাচ্চা বউ কাকেও সামলাতে হবে নি। মোকে কত চ্যাঁ - ভ্যাঁ সামলাতে হয় জান!
— উ সব লেকচার মোর শুনা আছে। বেশি বোকিসিনি। চাপ তাড়গাতাড়ি। কুন্তু বাঁশিটা লিচু ত মনে করে?
—- উটার খোঁজ তুমি কোরবে তা জানতম। সেইজন্নে আগেই উটাকে ট্যাঁকে গুঁজে লিচি। এখন টাট্ মার দিখি।
মাথার উপরে চড়া রোদ। খগেন মাস্টার তার মোটরসাইকেল ছুটিয়ে রওনা দেয় রূপনারায়ণের তীরে গঙ্গাবারুণী মেলার দিকে। যেন পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে চলেছে রাজপুত্তুর। লোখা ভাবে আর মিজমিজ করে হাসে। মেলা তো কতদিনের। আগে কখনো তো যেত না মাস্টার। কিন্তু এখন ফিবছর যায় পানসিউলির মেলায়। ঘরের পাশেও তো গঙ্গা বারুনীর মেলা হয়। শিলাই পাড়ের হলদীঘাটে, তাদের নিবজের গাঁয়ের পশ্চিমে গঙ্গাতলার ঘাটে, কাঁসাইপারে সনাজেলার ঘাটে। কিন্তু এসব মেলায় সাধে স্বপ্নে গেছে হয়তো। অথচ পানসিউলির মেলার কথা কক্ষনো ভুলে নজ সে। না ভোলার কারণ লোখা জানে। মানুষটার প্রতি লোখার বড্ড মায়া। নিজের মায়ের পেটের ভাই দাদাদের উপরে তার এত মায়া নাই। মনের ভিতরটা তার স্পষ্ট দেখতে পায় লোখা। ভিতরে শিলাইয়ের ধূ ধূ একটা চড়া। চৈত্তের দুপুরে খাঁ খাঁ শূন্যতা পাক খায় সেখানে। শুধু সরু একটা জলধারার মতো মাধুর স্মৃতি পাশ দিয়ে বয়ে যায় তিরতির করে। তাকে আঁড়েই বেঁচে আছে লোকটা। সেই মেয়েটাকে এক ঝলক দেখার আশায় ছুটে যায মেলায়। লোখা গেছে তার সাথে দু একবার। দেখা হয়নি। হওয়ার কথা নয়। যদিও বেনাই থেকে পানসিউলির জাতে লোকজন খুব আসে। কিন্তু মাধু তো থাকে বাইরে। সনায়ালা বরের সঙ্গে বোম্বে। কেন সে আসবে মেলায়। মাস্টার সে কথা বুঝেও বুঝে না। চোত মাস এলেই ক্যামন যেন আনমনা হয়ে যায় সে।
সটান রাণীচক বাজারে এসে মোটরসাইকেল থামায় খগেন মাস্টার। লোখা নেমে পড়ে। বলে,
– কি গ থামালে কেনে। চল, এবার লদী বাঁদ ধরে সজা।
– যাব দাঁড়ানা। এট্টু চা খাবিনি। রানীচকের লদীঘাটাটা কুনু বারে দেখা হয় নি। চল একবার দেখে এসি।
লোখার কোনকিছুতেই না থাকে না। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। পায়ে হেঁটে বাজার ছাড়িয়ে রূপনারায়ণের তীরে এসে দাঁড়ায় দুজনে। পাড়ের একটা ছোট্ট কদমগাছের নীচে বসে পগে। লোখা বুক পকেট থেকে বিড়ি বের করে ধরায়। আরআড় চোখে তাকায় মাস্টারের দিকে। মাস্টার মুচকি হেসে বলে,
– বুজেচি তোর ইশারা। দে একটা, দুটান দিয়েই দি।
হো হো করে হেসে ওঠে লোখা। সে জানে মেজাজ ফুরফুরা থাকলে এক আধবার বিড়িতে টান দতেয় মাস্টার। আজ তো তার মনমর্জি শিলাইয়ের ঢেউয়ের মত ছোল খেলছে। বিড়িতে একটা চোঁচা টান দিয়ে মাস্টারের দিকে এগি দেয় লোখা।
– লাউ,এটা থিকেই তুটান দাও। তার সঙে একটা কথা বল দিখি মেস্টার, এই মেলাটাকে শ্যাম মাজির বারুনী মেলা বলে কেনে? বহুবার জিহ্যাস কোরবে বলেও আর করা হয়নি।
– তুই ইটা জানুনু! এই মেলাটা শুরু করেছিল ভাটোরার ঘেটাল শ্যাম মাজি। সে ত ওই ঘাটে ঞেটালগিরি কোত্ত। তাকে এগবার মা গঙ্গা নাকি দরশন দিইছিল। সেই থিকেই উ ঘাটে গঙ্গাপূজা শুরু করে সে।
– বল কি গ মেস্টার! খুব পুণ্যবান লোক থাইলে বলতে হবে। ত কিভাবে হোল এট্টু বল।
সুড়ুৎ করে একটা টান লাগায় খগেন মাস্টার। রূপনারানের বুকের থেকে ঠান্ডা বাতাস তিরতির করে বইছে। ঘোলাটে জলের ঢেউ ছপ ছপ শব্দ তুলে শোলমাছের মতো গুঁতা মারছে পাড়ে। মাছধরা পানসি গুলো এদিক ওদিক জাল ফেলতে ব্যস্ত। কোথাও কোথাও পাড়ের নোঙরে আটকে পড়ে আছে ডিঙি-নৌকার দল। দেখলে মনে নোঙর উপড়ে নিরুদ্দেশে যাবার টানাটানি খেলছে বোধহয়। কিম্বা একটু অবকাশ পাওয়ার আনন্দে ঢেউয়ের তালে কোমর দোলানোর খুশিবতে বোধহয় তারা মাতোয়ারা। খগেন মাস্টার তন্ময় হয়ে দেখে। কথা ভুলে যায়। তাকে চুপ হয়ে যেতে দেখে লোখা ঠ্যালা মারে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
– হাইয়ে! কুথায় হারি গেলে গো! আচ্ছা বেউলা লোক তুমি! একদিষ্টে লদীর দিকে চেয়ে কি ভাবঠ বল দিখি। লদীর কথা নাকি সেই লোদীতে তাকে লিয়ে ভাসার কথা! সেই লোদী মোদের শীলাবতী। উ মেইছেনা ত আবার এই পুরুষ লোদির বুকে মিশি গেছে। দুজনের পেম নাকি বল দিখি মেস্টার? উদিকে কংসাবতী, তার উবরে মুন্ডেশরী ত অ্যারই মধ্যে পোড়েছে। তার মানে তিনটা মেইয়ামানুষকে লিয়ে এর সংসার। পারেও বটে মাইরি। আর মোদের এত ভাল মানুষটার কপালে একটাও সইলো নি গ। কুরকুটা ভগমানকে কি বোলেচি যা! তা যাউ পাল্লে,তুমি বল দিখি মেলার কাহিনীটা।
— তার আগে বাঁশিটা এট্টু বের কর। এমন পরিবেশ সহজে কি পাবা যায়। ধর দিখি একটচা বাগিয়ে গান।
— কুনটার সুর ধোরবো গো মেস্টার। তমার সেই পিয় গানটা– পরাণ বন্ধুরে ভালোবাইসা ও তোর মন পাইলাম না…
– হুঁ
লোখা দেখে মাস্টারের গলা থেকে আর কোন কথা সরছে না। রূপনারানের জল যেন উপচে ছলছলাচ্ছে তার কালোপারা চোখ দুটায়। লোখা জামার ভিতরে কোমরের কাছে প্যান্টে গুঁজে রাখা বাঁশিটা বের করতে করতে ভাবে,
— কেন মায়া দিয়েচ গ ভগমান মানুষের পেরাণে। কেন ভালবাসা দিয়েচ তুমি? কি জাদু রেখেচ এই ভালবাসায়। সবাইকে ত বেউলা করে দেই গো। মোদের মাস্টারকেও ত করে দিচে। শরীলের কুনু আশ নাই তার। সোহাগের আশ নাই। শুদু আছে তাকে দুদন্ড দেখার,দুচারটা কথা বলার লোভ। এমন লোভ কেন দিলে গ ভগমান। কত লোভী ত দেকলম জীবনে। তাদের দেকলে ঘিন্না করে। কুন্তু মাস্টারের মতো লোভীকে দেকলে বুকটা জুড়ায়। মন পেরাণ ঠান্ডা হয় গ।
মন প্রাণ ঢেলে দেয় লোখা তার সুরে। কিন্তু দৃষ্টি তার থাকে মাস্টারের মুখের দিকে।পাকুড়দানার কোণে কালো কুচকুচা কালবৈশাখীর মেঘ যেমন ধরে, তেমন পারা মাস্টারের মুখ। লোখাও যেন নিজেকে সামলাতে পারছে না। কথা ঘুরাতে বলে ওঠে,
– কি হোলো গ মেস্টার? মোর বাঁশির সুর তমাকে কুথা নিয়ে গেল? জাত দেকতে কি যাবেনি? মোকে কি বোলবেনি আর বারনি মেলার গল্প।
কোনরকম আর ভনিতা করে না। মুখে মুখে যে গল্পকথা ছড়িয়ে আছে রূপনারানের তীরে,সেই গল্পই শোনায় লোখাকে,
—ই ঘটনা বহুকাল আগের। শাম মাজি ভাটোরার লোক। ইখিনের ঘেটাল ছিল সে। উথালপাথাল রূপনারানের ঢেউ ভেঙে হাল বেয়ে খিয়া দিত। সেইরকম একদিন পারাপার কোেচ্ছিল। ভদ্দুফুর বেলা। দেখে একটা এসতি মেইয়া লৌকা পার হতে এসচে। যাবে কৈজুড়ি। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরণে। কপালে টকটকা লাল সপঁদুর। আগুনের মত দাউদাউ কচ্চে। শাম মাজি জিগ্যাস করে, কুথাকে যাবে গ এই আটপিটা দুফুরে? মেইয়ামানুষ উত্তর দেয়,ওপারে শাঁকা পোরতে যাব। এসে পারানি দুব। শাম মাজি পার করে দেয়। কুন্তু মন তার খটখট করে। এতদিন ধরে সে ঘেটালগিরি করেঠে,কত ঘরের বউড়ি ঝিউড়িদের সে ত চিনে। কুিন্তু ইটা কাদের ঘরের মেইয়ামানুষ। দুধে- আলতায় গুলা গায়ের রঙ। পা ভত্তি আলতা। কমর ঝাঁপানা চুল। কুনু খেই পাইনি শাম মাজি। ইদিকে দুফর গড়িয়ে বিকাল হতে যায়, সে মেইয়া আর ফেরে না। শাম ঘেটাল সাতপাঁচ ভাবে। এমন সময় খিয়া দিয়ে যখন একা মাঝ লদি দিয়ে আসচে তখন শাঁকা পরা একজড়া হাত লোদীর মাঝে দেখা যায়। যেন তাকে আশীব্বাদ কোচ্ছে। ভয়ে চমকে উঠে ঘেটাল। সেই রাতে তাকে গঙ্গা মা স্বপ্ন দ্যায়। ব্যাস্ শামা ঘেটাল দেবীর আদেশে তার পূজা শুরু করে। সেইজন্নে লোকে বলে শাম মাজীর বারনি মেলা। মা গঙ্গা তাকে দরশন দিইল বোলে লোকজনের কাছে এখিনের মাকে খুব জাগ্রত মনে লোকে।আর পূজাকে লিয়ে মেলারও এত জমজমাটি।
লোখা হাঁ করে তাকিয়ে শুনতে থাকে ভাটোরার শ্যাম মাজির বারুনী মেলার গল্প। আর বলে,
– যাই বল মেস্টার, দেবদেবী চিরকাল দুলা বাগদি ডমকেই দয়া কোরে গেছে। লোক অ্যাদের ছোট জাত বলে কুন্তু তাদের শালা মন গুলানই ছোট। তমার মুখে এই ঘটনাটা শুনে বড্ড গর্ব হয়ঠে। অ্যাখন চল দিখি, ঢের দেরি হই গেল। লাও, গাড়িয়ে টাট্ মার।
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments