জ্বলদর্চি

প্রতিবেশী লতা /সুমিত্রা মাহাত

প্রতিবেশী লতা

সুমিত্রা মাহাত

মাঝে রাস্তা। মুখোমুখি দুটি বাড়ি। ডানদিকের বাড়িটি সংগীত গুরু শ্রদ্ধেয় শিশির মাহাত মহাশয়ের। বাড়ির নাম 'দোলন চাঁপা'। তিনি সম্পর্কে আমার ছোটো মামাশ্বশুর হন। বামদিকের বাড়িটি একতাল স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক , প্রয়াত শ্রদ্ধেয় সুনীল দন্ডপাঠ মহাশয়ের। এ বাড়িতে প্রবেশের সৌভাগ্য অবশ্য আমার হয়নি। এই দুই বাড়ি ও তাতে বসবাসরত সদস্যরা পরস্পরের খুব ভালো প্রতিবেশী এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে এছাড়াও তাঁদের মধ্যে একটি মিল রয়েছে। দুই বাড়ির প্রবেশপথে গৃহিনীদের আস্পর্ধা পেয়ে দুটি মজবুত লতা গেটের উপর জুড়ে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে সারাবছর। তারাও পরস্পরের খুব ভালো প্রতিবেশী। 'দোলন চাঁপা'য় ফ্লেমিং গ্লোরির বাড়বাড়ন্ত। উল্টোদিকের গেটে সমানতালে তাল মিলিয়েছে অরেঞ্জ ট্রামফেট ভাইন। সারাবছর সবুজ পাতা নিয়ে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে। কিন্তু শীতের হিমেল ভাব ঠেলে যখন গলা রোদ একটু একটু করে প্রকৃতিকে উষ্ণ করে তোলে তখন এই পরস্পরের প্রতিবেশী লতা দুটি যেন হঠাৎ জেগে ওঠে। মাঘের দশ-বারো থেকেই সবুজ পাতার ফাঁকে থোকা থোকা ফুলের কলিতে গাছ ভরে যায়। আশ্চর্যভাবে তাদের ব্লুমিং সিজ্ন একই। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। 

থোকা থোকা গাঢ় লাল ফুলে ফ্লেমিং গ্লোরির শাখা প্রশাখা ভরে গেছে। অরেঞ্জ ট্রামফেট ভাইন যেন থরে থরে কমলা ফুলের মালা সাজিয়ে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। বিরহিনী লতার সৌন্দর্য ক্রমশ বেড়েই চলে। উভয়ে উভয়ের পানে চেয়ে থাকে সারাদিন। উভয়ের সৌন্দর্যে উভয়ে বাকরুদ্ধ ! কে বলে কার কথা! পথচলতি মানুষ তাদের রূপ সৌন্দর্যের টানে থমকে দাঁড়ায়। আবার কি ভেবে চলতে শুরু করে। তাদের ভাব বিনিময়ে বিরক্ত করে না। ছাদের ওপর থেকে মামাবাবুর কন্ঠ নিঃসৃত সুরের ঝরণা ধারা যখন তাদের ওপর নেমে আসে, তারা আপন মনে গা দোলায়, সঙ্গত করে। সঙ্গীত সুরা পান করে বিমুগ্ধ হয়। এ তাদের অসীম পাওয়া। গাছেরও প্রাণ আছে। বাগানে তারাও জোট বেঁধে থাকে। পরস্পরের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলে। আরও কত কি! এই লতা গৃহস্থকে শখ করেই লাগাতে হয়। বনে জঙ্গলে শাল পলাশের মতো সহজলভ্য নয়। তাদের ফোটা ফুলের সৌন্দর্য ঢেউ এ ভেসে যায় না এমন মানুষ তো দূরের কথা একটা মৌটুসী ও বাদ পড়ে না। ফুলের চোখজুড়ানো রং আর মনভোলানো রূপ ই তাদের বিখ্যাত করেছে। না চাইলেও ফিরে ফিরে দেখতে হয়। না চাইলেও তাদের কথা ভাবতে হয়। 

মামাবাবুর ছাদের ওপরে আছে একটা রসুন লতা। ইংরেজিতে গারলিক ভাইন। সময়ে তার লকলকে ডগাগুলোতে ঝাঁকে ঝাঁকে বেগুনী কুঁড়ি ওঠে। তবে ফুলের আয়ু কম। ফুলগুলো নতুন থেকে পুরনো, গাঢ় থেকে ফিকে বেগুনীর দিকে যায়। যত্ন আত্তি করে ফুলের জন্য অপেক্ষা করতে হয় বছরভর। হোক না তাতে ক্ষতি কি! মানুষ তো কত বিষয়েই অপেক্ষা করে থাকে। গ্রীষ্মে শীতের জন্য, শীতে গ্রীষ্মের জন্য, পূর্ণিমায় অমাবস্যার জন্য, অমাবস্যায় পূর্ণিমার জন্য। এ তো শুধুই চোখভরা ভালোলাগা ও মনভরা আনন্দ দেয়। যা সহজে পাওয়া যায় না। তাই অপেক্ষা করতে ক্ষতি কি! 

মামাবাড়ি আসার পথে একটা বাড়ির উঠানে, একটা শাল গাছের ওপর জড়িয়ে থাকে একটা নীলমণি লতা। সে আরেক রকম আশ্চর্য করে আমাকে। কবিগুরু স্বয়ং যার ফুলের রূপে মুগ্ধ, আমি সেখানে নেহাত ছেলেমানুষ। নীলমণি র গাছ দেখে কোন মতেই বোঝার উপায় নেই, তাতে এত সুন্দর ফুল ফোটে। দড়ির মতো লতা দোল খায় সারাবছর। সময় এলে নিখুঁত আকারের নীল ফুলে লতা ভরে যায়। নতুন থেকে পুরনো, গাঢ় থেকে হালকা নীল ফুলে সাজতে ইচ্ছে হয়। এই সৌন্দর্য চাক্ষুষ করতে সারাবছর অপেক্ষা করতে হয়। হয় হোক!
লতানোর সুযোগ পেলে বোগেনভেলিয়াও অনেক উঁচুতে উঠতে পারে। তার থোকা থোকা সাদা , রানী ফুলে মন ভরিয়ে দেয়। দেশী মাধবী লতার মধ্যে দেখা যায় অদ্ভুত জংলীপনা। অন্য গাছকে চেপে দিয়ে এমন আধিপত্য বিস্তার করে! অবশ্য তার সুগন্ধী ফুলেই সাতখুন মাপ হয়ে যায়। চাইলেও তাকে ফেলে দেওয়া যায় না। তার আবার জিওল মাছের প্রাণ। কেটে ফেলে দিলেও বার বার মাটি ভেদ করে মাথা তোলে।

🍂
ছোট বেলায় গ্রীষ্মের ছুটি মানেই মামাবাড়ি যাওয়ার পালা। মামাবাড়িতে দুই দাদুর মিলে একটা কুঁয়ো ছিল। দুপাশে বাঁশের খুঁটি। তার উপরে লম্বালম্বি বাঁশ বাঁধা। মাঝে থাকত ঘররি। লাল মোরাম মাটি। মাটির উপর তিনটে রিং। এই কুঁয়োতে কিংবা বাঁধে স্নান করতে যেতে হতো। কুঁয়োর জল খুব ঠান্ডা। কুঁয়োর পাশেই একটা জায়গা উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা থাকত। বাঁশ কঞ্চি লতিয়ে লতিয়ে বেড়া দেওয়া হতো। বেড়ার ভেতরে থাকত সবরকম  সব্জি। বেড়ার ভেতর থেকে কুঁয়োর দিকে ঝুঁকে থাকা ডালিম গাছটা টুকটুকে লাল ফুলে ভরে থাকত। কুঁয়োতলার দিকের অংশে সমস্ত বেড়ায় লতিয়ে থাকত মালী ফুল। দেশি প্রজাতি। কি সুগন্ধ! আম গাছ, পেয়ারা গাছ, ডালিম গাছে ঘেরা ছায়াঘন পরিবেশ। মালী ফুলের সুগন্ধ। সুশীতল জল। বাদশাহী স্নানাগারকেও হার মানায়। প্রচন্ড গরমে মনে শীতলতা এনে দেয়। দু-চারটা তুলে সঙ্গে নিয়ে আসি । এখন এই ফুল তেমন আর দেখিনা। সেই সুগন্ধও নেই, সেই বন্য লতাও নেই। 

দুধি লতা,আটাইড় লতার কুখ্যাতি সর্বজনবিদিত। অন্য গাছকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে জঙ্গল দুর্ভেদ্য করে তুলতে এদের জুড়ি মেলা ভার। জংলী মানুষ এদের কেটে জীবন যাপনে কাজে লাগায় বলে এদের উৎপাত কিছুটা কমে। তা না হলে বড়ো বড়ো শালগাছের উপর মহাশূন্যে অ্যানাকোন্ডা সাপের মতো মাথা তুলে দোল খেতে থাকে। দুধি লতা বুনে মাছ রাখার 'খালোই' বানানো যায়। খালে , নদীতে মাছ ধরতে গেলে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া যায়। পাইন্যা লতার রস আওয়া চালের গুঁড়িতে মিশিয়ে বাঁধনার আলপনা দেওয়া হয়। বাবা বাঁধনার সময় কপাল চাপড়ে বিলাপ করেছে। বনে এই লতা নাকি অনেক কমে গেছে। যায় যাক! বনে পাইন্যা লতা বাড়ানোর টোটকা আমার জানা নেই। 

লতাপাতার মূল অনেক সময় মূল্যবান ওষুধ। বিছাতি লতা,শতমূলী আরো কত কী! তারা মাটির উপরে রূপ ছড়ায়, নীচে ছড়ায় গুণ। রূপ নয় বিছাতি অবশ্য ছড়ায় ভীতি। অনেকের গেটে ঘুঘু লতাও লাগাতে দেখেছি। ছত্রাকের মতো বিকট আকার ও দেখতে ফুলগুলো। ঢুকতেই কারো এরকম ভালো লাগে! গৃহস্থ অবশ্য বুদ্ধি এঁটেই লাগায়। আগন্তুক যাতে ঢুকেই ভয় পেয়ে যায়,বিরক্ত হয়। বেশিক্ষণ থাকতে না চায়। কি বুদ্ধি!
লতা , গাছপালার জগতে এক আশ্চর্য সৃষ্টি। যার দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই, সে রীতিমত রাজত্ব করে বসে। সুন্দর ও সুগন্ধী ফুলের দোহায় দিয়ে তবু কিছু ছাড় পায়। আমি এখনও কোনো লতা গেটে তুলিনি। মনস্থির করতে পারিনি। বর্ণ নাকি গন্ধ কাকে প্রাধান্য দেবো! জংলী নাকি বিদেশি কাকে ? নামকরা উকিলের পরামর্শ নিতে হবে। সাহিত্যিক বুদ্ধিতে চলেছি কি বিপদে পড়েছি। তারা কখন যে কার রূপে,গন্ধে মুগ্ধ হয়ে যায় বলা মুশকিল। এমন যুক্তি ও সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা তুলে ধরে শেষে ঘুঘু লতাই না ঘাঁটি গেড়ে বসে। আত্মীয় স্বজন আমি খুবই ভালোবাসি। তারা বেজার মুখে ফিরে যাক তা আমি চাই না!

সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments