বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৬
গোলাপ
ভাস্করব্রত পতি
"দৃষ্টিতে আর হয় না সৃষ্টি আগের মতো গোলাপ ফুল।কথায় সুরে ফুল ফুটাতাম, হয় না এখন আর সে ভুল॥বাসি হাসির মালা নিয়ে
কী হবে নওরোজে গিয়ে,
চাঁদ না দেখে আঁধার রাতি বাঁধে কি গো এলোচুল?"
-- কাজী নজরুল ইসলাম
তখন রোমান সাম্রাজ্য চলছে। সেখানকার প্রেম এবং সৌন্দর্যের দেবী ছিলেন ভেনাস। এই দেবী ভেনাসের প্রতীক হল গোলাপ, হাঁস, ঘুঘু, মেহেন্দী গাছ, পাখি, আপেল এবং মৌমাছি। প্রাচীন রোমে তিনি ছিলেন বসন্ত ঋতুর দেবী। তাই এপ্রিল ছিল বসন্ত ঋতুর মাস। যা প্রেমের দেবী ভেনাসের নামে উৎসর্গীকৃত একটি অত্যন্ত পবিত্র মাস। মনে করা হয় যে, এই দেবী ভেনাসের থেকেই গোলাপ হয়ে ওঠে প্রেমের প্রতীক। রোমানদের বিশ্বাস ছিল যে, দেবী ভেনাসের প্রিয় ফুল হল গোলাপ। আর গোলাপ হল প্রেম, সৌন্দর্য এবং আবেগের পরিচায়ক।
'ওগো গোলাপ তুমি একটু গন্ধ দিও
আসবে আরও কাছে যখন আমার প্রিয়'!
পরবর্তীতে মধ্যযুগে এই গোলাপই হয়ে ওঠে প্রেমিকদের ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। একসময় নাইটরা আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে তাঁদের প্রেয়সীদের উপহার হিসেবে দিত গোলাপের তোড়া। ধীরে ধীরে শুরু হয় ROSE DAY। একসময় (সম্ভবত ১৭ শতকে) ইংল্যান্ডে এই Rose Day হয়ে ওঠে সরকারি ছুটির দিন। এই বিশেষ দিনে নানা কিসিমের রোমান্টিক গান, কবিতা, ছড়া, কাহিনীর আলোচনা, চর্চা চলতো।
গোলাপের বিজ্ঞানসম্মত নাম Rosa rubiginosa। প্রায় 360 প্রজাতির গোলাপ মিলবে এখন। এটি Rosaceae পরিবারের অন্তর্গত। অন্যান্য যেসব জনপ্রিয় প্রজাতির কথা উল্লেখ করা যায়, তা হল ---
Rosa rubiginosa
Rosa grandiflora
Rosa floribunda
Rosa bonica
Rosa gallicanae
Rosa pimpinellifolia
আজ থেকে ৫০০ কোটি বছর আগে কলোরাডোতে নাকি পাওয়া গিয়েছিল প্রথম গোলাপ। যদিও ৫৫১ - ৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনের চৌ রাজবংশের বাগানে প্রথম গোলাপ চাষ করা হয় বলে কথিত। সেই চীন থেকেই প্রথম বাগানের গোলাপের চাষ ১৮ শতকে। বাগানের গোলাপের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হল ওল্ড ব্লাশ। ১৯ শতকের গোড়ায় ফ্রান্সের সম্রাজ্ঞী জোসেফিনের বাগানে গোলাপের চারা তৈরি করা হয়েছিল বহুলভাবে। আবার ১৮৪০ নাগাদ ইংল্যান্ডের অ্যাবনি পার্কের কবরস্থান, আদি ভিক্টোরিয়ান উদ্যানের কবরস্থান এবং আরবোরেটামের জন্য হাজারের বেশি বিভিন্ন প্রজাতির গোলাপের প্রজাতির রোপণ করা হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন সে দেশের গোলাপকে ফুলের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করার জন্য আইন স্বাক্ষর করেন। ফলে গোলাপের আভিজাত্য সহজেই অনুমেয়।
সাইপ্রাস, লুক্সেমবার্গ, মালদ্বীপ, বুলগেরিয়া, ইরাক, যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, চেক রিপাবলিকের জাতীয় ফুল হল গোলাপ। ল্যাটিন 'রোসা' থেকে এসেছে 'Rose' শব্দটি। অর্থাৎ গোলাপ। গোলাপের ডাল বরাবর তীক্ষ্ণ কাঁটার সারি দেখা যায়। গানের ভাষায়--
'ফোটে যে রক্ত গোলাপ চিরদিনই তাই,
কাঁটাতেই সুখ।
নেভাতেই প্রদীপ আমার আসে যে ঝড়,
ভেঙে যায় বুক'।
এই কাঁটাগুলি আসলে এপিডার্মিসের বহির্মূখ। এখান থেকেই পরিবর্তিত ডালপালা বের হয়। গোলাপের কাঁটাই হল গোলাপের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কবি অসীম সাহা গোলাপের কাঁটা নিয়ে লিখেছেন, 'পৃথিবীতে নেমে এসেছে ঘন অন্ধকার। তারই মধ্যে সুন্দরের স্বপ্নকে বুকে করে নকশীকাঁথার গায়ে সারাদিন সারারাত মানুষের বিজয়ের ইতিহাস লিখে যাচ্ছে সহস্র গোলাপের কাঁটা'। আধুনিক কবি অমরেশ কুমার লিখেছেন, 'জানি, তুমি গোলাপ হয়ে পাপড়ি মেলে পেয়েছ হৃদয়ে ঠাঁই; / আর আমি? মরা ফুল হয়ে পেয়েছি ভালোবাসার জ্বলন্ত ছাই। / তোমার ওই গোলাপ কাঁটার আদরে আঁকা লাল ক্ষত রেখা বুকে / তবু আমি! জেগে আছি বেঁচে থাকি স্মৃতির মোড়কে রাখা এক চিলতে সুখে'।
বছরের একটি বিশেষ দিনে পালন করা হয় 'বিশ্ব গোলাপ দিবস'। ২২ শে সেপ্টেম্বর তারিখটিকে এই নামে উৎসর্গ করা হয়েছে সারা বিশ্বের ক্যান্সার রোগীদের জন্য। তবে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের ৭ থেকে ১৪ তারিখ হল ভালবাসার সপ্তাহ। যা শুরু হয় 'রোজ ডে' বা 'গোলাপ দিবসে'র মাধ্যমে।
'ফুটেছে গো একটি গোলাপ
যৌবন বাগানে
কতশত ভোমরা আসে
গন্ধেরই টানে'।
এইদিন ভালোবাসা প্রিয় মানুষজন তাঁদের প্রিয়জনকে লাল গোলাপ উপহার দেন। গানের সুরেও গোলাপ উঠে এসেছে ভালোবাসার মানুষজনের জন্য --
'খোঁপার ওই গোলাপ দিয়ে মনটা কেন এত কাছে আনলে।
পারবে কি বাসতে ভালো আমাকে জানলে।
আমাকে তেমন করে জানলে। ।
খোঁপার ওই গোলাপ দিয়ে মনটা কেন এত কাছে আনলে'।
লাল গোলাপ আসলে ভালোবাসার প্রতীক। বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে ও স্বরে সেই রক্ত গোলাপের প্রতিচ্ছবি --
'রক্ত গোলাপ মাখিয়ে নিয়ে সুরে চন্দনে
অঞ্জলি আজ দিলাম বীণাপাণির চরণে,
তবে কমলা গোলাপ পছন্দ জানানোর প্রতীক, সাদা গোলাপ ক্ষমা চাওয়ার এবং বিয়ের জন্য প্রপোজ করার প্রতীক, হলুদ গোলাপ বন্ধুত্বের প্রতীক, বেগুনি গোলাপ প্রথম দেখা বা প্রথম প্রেমে পড়ার অনূভুতির প্রতীক এবং গোলাপি গোলাপ হল সেরা বন্ধুত্বের প্রতীক। মোগল সম্রাজ্ঞী নুরজাহান নাকি লাল গোলাপ পছন্দ করতেন। তাঁর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন মোঘল সম্রাট আকবর। খুব ভালোবাসতেন তাঁর প্রেয়সীকে। নুরজাহানকে তুষ্ট রাখতে সদাই ব্যস্ত থাকতেন। শোনা যায়, স্রেফ অদম্য ভালোবাসার জন্য মহামতি আকবর প্রতিদিন একরাশ টাটকা গোলাপ ভেট পাঠাতেন নুরজাহানের কাছে!
এই গোলাপ কখনও কখনও হয়ে ওঠে বিরহ, বিচ্ছেদ আর দুঃখের কারণ। যখন প্রেম ভালোবাসা হারিয়ে গিয়ে ম্রিয়মান হয় শুকনো গোলাপের মতো। তখন হৃদয়ের বাষ্পচাপের সাথে অনুরণিত হয় --
'মানুষ খুন হলে পরে মানুষই তার বিচার করে
নেই তো খুনির মাফ
তবে কেন পায় না বিচার নিহত গোলাপ।
বৃন্ত থেকে ছিড়ে নেয়া নিহত গোলাপ।।
চেয়ে দেখ গোলাপ কারো বুকটা চিড়ে রক্ত ঝরে
আহা কেউ ছোরা মেরে পালিয়ে গেছে
কোন গোয়েন্দা তাকে ধরে
তাকে খুন করে তো খুনির মনে হয় না অনুতাপ
তবে কেন পায় না বিচার নিহত গোলাপ।
বৃন্ত থেকে ছিড়ে নেয়া নিহত গোলাপ।।
খুন করলে আদালতে খুনির যে হয় গো ফাঁসি
যারা ঐ ফুলদানীতে গোলাপ রেখে আদায় করে তার হাসি
তারাই যে সব পূণ্য করে নেই তো তাদের পাপ।
তবে কেন পায় না বিচার নিহত গোলাপ
বৃন্ত থেকে ছিড়ে নেয়া নিহত গোলাপ'।।
🍂
0 Comments