জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদপর্ব ---২ /স্বপন কুমার দে

চিত্র : শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব -২
             
স্বপন কুমার দে
               

দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস সম্পূরকের। কেউ তাড়া না দিলে সকাল আটটার আগে ঘুমই ভাঙে না তার। ঠিকে কাজের মাসি রোজকার সব কাজ শেষ করে চিৎকার করতে থাকে,"এত বেলা অব্দি তোমাদের বাড়িতে পড়ে থাকলে আমার চলবে না বাপু।ছোড়দার ঘরটা তোমরাই পরিষ্কার করে নেবে। এত বেলা পর্যন্ত কেউ ঘুমায় ?" বলে গজ্ গজ্ করতে থাকে। বাধ্য হয়ে মা উঠে আসেন দোতলায়।ছেলের ঘরে ঢুকে তাড়া দেন, " সমু, ওঠ্। কত বেলা হয়েছে দেখ্। হারুর মা এবার চলে যাবে।তখন তোর ঘরটা কে পরিষ্কার করবে বল দেখি?" মায়ের বকুনিতে ঘুমটা ভেঙে যায় সম্পূরকের। ব্যাজার মুখে বিছানায়  উঠে বসে। এই সবে রূপসাকে নিয়ে একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখছিল। গঙ্গার তীর। ঢেউগুলো বিকেলের সোনালি রোদে ঝিক্ মিক্ করছে। তখনও লোকের অতটা ভিড় নেই।ফাঁকা বেঞ্চে ওরা দুজন পাশাপাশি। বিকেলের হেলে পড়া সূর্যের লাল আভা নদীর জলে। যাত্রী নিয়ে লঞ্চ গুলোর আনাগোনা। সমস্ত কিছুর মধ্যে এক অপূর্ব স্বাদ অনুভব করছিল সে। আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারলে ভালো হত।তা না, তাড়া দিয়ে স্বপ্নের বারোটা বাজিয়ে দিল। যত দোষ ঐ হারুর মায়ের। " ক্যানো রে বাপু, অফিস আমার, ঘর আমার।দেরি হলে আমি বুঝবো। একদিন ঘর পরিষ্কার না করলে কোন্ মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে শুনি?" নিষ্ফল আক্রোশে মনের ভেতরে গুমরাতে থাকে। চোখ কচলাতে কচলাতে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখল আটটা বেজে পাঁচ। বিছানায় ছেড়ে দাঁড়ায়। 

অমরেশ আর মণিদীপার সংসার খুব ছোটও নয়,আবার খুব বড়ও নয়। আর পাঁচটা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মত 'উই টু,আওয়ার টু '।তাদের দুই ছেলে। বড় উদ্দালক, ডাকনাম দালু। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেসরকারি কোম্পানিতে মোটা মাইনের চাকরি। তার বিয়ে হয়ে গেছে। স্ত্রী সুদেষ্ণা। তাদের একমাত্র মেয়ে,নাম মন্টি। ছোট ছেলে সম্পূরক ওরফে সমু। সে কেমেস্ট্রিতে এম,এস,সি করতে করতেই সরকারি চাকরি পেয়ে যায়। তার কথাই এতক্ষণ হচ্ছিল।

অমরেশবাবু গ্রামের এক এইচ, এস স্কুলে তেত্রিশ বছরের বেশি সময় শিক্ষকতা করেছেন। শিক্ষকতা জীবনে তিনি তিনটি বিষয় খুব মেনে চলতেন, -- পাংচুয়ালিটি, সততা ও নিষ্ঠা। নিখুঁত সময়জ্ঞান ছিল তাঁর। কোনোদিন দেরিতে স্কুলে ঢোকেন নি। ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো, তাদের সঙ্গে মেশা, তাদের অভাব অভিযোগ শোনা,প্রতিটি বিষয়ে তাঁর অন্তরঙ্গতা প্রশ্নাতীত। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন পরিচ্ছন্ন স্বভাবের। তাঁর ছেলেদের তিনি বলেন, "
কখনও কারো প্রতি অন্যায় করিস না,আর কারও অন্যায় সহ্যও করিস না।"

🍂

ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে বাথরুমে ঢুকে সমু। কিছুক্ষণ পর মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে খবরের কাগজে চোখ বোলাতে থাকে।
 
" আর পারিনা বাপু তোকে নিয়ে। এবার তোর মাকে রেহাই দে। রূপসাকে বল্, এবার আমরা বিয়ের আয়োজন করতে শুরু করি। ওদের বাড়ির লোকজনকে আসতে বল্। না হলে, আমরাই ওদের বাড়ি যাবো।" কথাগুলো বলতে বলতে ছেলের পাশের চেয়ারটাতে বসে পড়েন।
" অত তাড়া কিসের, মা।এই তো কিছুদিন চাকরি করছি। আরও বছর খানেক যাক।তারপর না হয় ভাবা যাবে। বিয়েবাড়ির খরচও তো আছে, না কি?"বলেই মায়ের গালটা টিপে দেয়।
" ছাড়,ছাড়,লাগছে। আচ্ছা, তোর কবে বুদ্ধি শুদ্ধি হবে বল তো।তোর বিয়ে, আর তুই টাকা খরচ করবি? কেন তোর বাবার কিছু নেই? এত বছর চাকরি করে তাহলে কি করলো?"
" না মা আমি তা বলিনি। আসলে আমি ভেবেছি বাবার ওপর আর চাপ বাড়াবো না।এত বছর ধরে তো আমাদের জন্য অনেক করেছে। তাছাড়া নিজের বিয়ের জন্য স্বাবলম্বী হতে চাইছি। "
" তোর অত পাকামি না করলেই ভালো।তোর দাদার বিয়েতে তোর বাবা যেমন খরচ করেছিল, তোর বিয়েতেও তাই করবে। খরচের জন্য তোকে চিন্তা করতে হবে না। আমি তোর বাবাকে বলতে চললাম।"

চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে মাকে জড়িয়ে ধরে সমু। বলে," মা, ও মা,শোনো না,এখনই বাবাকে বলার দরকার নেই। আর ক'টা মাস যাক না।বাবা না হয় বিয়ের খরচটা দিল,কিন্তু তাছাড়াও তো আরও অনেক খরচ থাকে বিয়ের পর। সে টাকাও কি আমি বাবার কাছে চাইতে যাবো? মিষ্টি মা আমার। সময় হলে আমিই তোমাদের বলবো।"

মাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ছেলে। আঁচল দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে নিয়ে মা বলেন, " ভয় হয় রে বাবা, আরও এক বছর যদি না বাঁচি। গ্যাস অম্বলে ভুগতে ভুগতে মনে হয় হঠাৎই একদিন হয়তো চলে যেতে পারি। যাওয়ার আগে তোর ঘর সংসারটা গুছিয়ে দিয়ে না গেলে আমি যে মরেও শান্তি পাবো না।"
" একদম চুপ করো, চুপ করো বলছি। " জোর করে হাতের তালু দিয়ে মায়ের মুখটা চাপা দেয় সমু।
" এই সাত সকালে আজে বাজে কথা না বললে তোমার চলছে না মা, তাই না? বাড়িতে তোমাকে কোনও কাজ করতে হবে না।আরও দু'জন কাজের লোক রাখবো।তুমি কিচ্ছু ভেবো না।আজ অফিস থেকে ফিরে তোমাকে ডা: গুপ্তের চেম্বারে নিয়ে যাব।নিয়মিত চেক আপ করাবো। কাল থেকে সকাল ছ'টায় উঠব। তুমি আর আমি মর্নিং ওয়াকে বেরোব।"বলে খানিকক্ষণ দম নিল।
ছেলের অবস্থা দেখে মা হেসে ফেললেন
" তার চেয়ে বল না তোর মায়ের জন্য দেবতাদের কাছ একটু অমৃত  নিয়ে আসবি।"
" উপায় থাকলে সেটাও করতাম মা।"
থাক থাক, তোকে আর উপায় বের করতে হবে না।এখন স্নান করে আয় দেখি, রান্না হয়ে গেছে।খেয়ে অফিস বেরোতে হবে তো।" মণিদীপা নিজেই উঠে পড়েন।

ছেলে বাথরুমে গেলে মা এবার চলে যান বাড়ির এক চিলতে বাগানে, স্বামীর কাছে। স্বামী অমরেশ রিটায়ার্ড পার্সন। গত পাঁচ বছর হলো শিক্ষকতার জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। এখন সময় কাটানোর জন্য আরও অনেক কিছুর মধ্যে আছে এই এক চিলতে বাগান। রকমারি ফুলের গাছ লাগান লোক দিয়ে। মাঝে মাঝে নিজের হাতে পরিচর্যা করেন। ছাদে টবেও বেশ কিছু ভিন্ন জাতের ফুল গাছ রয়েছে। স্ত্রী কাছে যেতেই বেশ উৎসাহের সঙ্গে বলতে থাকেন, " দেখো মনিদীপা, সব গাছগুলোতে কী সুন্দর ফুল ফুটেছে। আরও বেশি বেশি করে যখন ফুল ফুটবে তখন আরও কত সুন্দর লাগবে!" একটা অচেনা ফুলের দিকে মণিদীপার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, " ওই...ওই যে দেখছো বেগুনি রঙের ওপর হলদে ছাপ, ওই ফুলটার কী নাম বলতো?"
আনন্দে গদ গদ হয়ে অমরেশ যেন মণিদীপাকে তাঁর লেখা কবিতা পড়ে শোনাতে থাকেন।
মাঝপথে থামিয়ে দেন মণিদীপা," এত বেলা অব্দি খালি পেটে থাকলে তোমার চলবে? বাগানের প্রেমে আজ তো প্রেসারের ওষুধও খাওয়া হয়নি। এই বুড়ো বয়সে কিছু একটা না বাঁধিয়ে ছাড়বে না দেখছি। "
"খবরদার! বুড়ো বলবে না গিন্নি। বুড়ো বললে আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা একটা ইয়ে ইয়ে হয়।"
" যত্তোসব ঢং, খাবে চলো।"
" দাঁড়াও,আর একটু কাজ বাকি আছে।" বলে একটা ফুলগাছের গোড়ায় মাটি দিতে দিতে বলল," সারাজীবন চেষ্টা করেও তো আমার জন্য তোমার মনের ফুলটা ফোটাতে পারলাম না। তাই গাছের ফুল ফোটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।" কথাটা বলেই একটু হেসে নিল।
" যত বয়স বাড়ছে ততই যেন ছেলেমানুষী বেড়ে যাচ্ছে।"
"এই করেই এতটা কাল কাটিয়ে দিলাম মণি, ভাবছি শেষদিনটাও যেন এভাবেই চলে যেতে পারি।"
" থাক থাক আর বলতে হবে না। বলছি, সমু বলছিল,আজ আমাকে নিয়ে ডাক্তার গুপ্তের চেম্বারে যাবে। তুমিও চলো না,একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেবে।"
" যথা আজ্ঞা দেবী।"
তখনকার মত বাগানের প্রেমে ইতি টেনে অমরেশ গিন্নির পিছু নেন। ( ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments