শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত
দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি --১
---------
শিবজ্ঞানে জীবসেবার যে ভাব স্বামীজী দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল তার অন্যতম প্রয়োগ ঘটেছিল ভারতের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের হাত ধরে। এই প্রসঙ্গে স্বামী কৃষ্ণনাথানন্দ গবেষকের দৃষ্টি নিয়ে লিখছেন --- “প্রাক স্বাধীন ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দুর্ভিক্ষ ছিল যেন ভারতবর্ষের অতি স্বাভাবিক ঘটনা তার গ্রাস কতটা ভয়ানক একটি তথ্য থেকেই তা বোঝা যাবে ১৮৭১ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত এই ৫০ বছরে অবিভক্ত ভারতবর্ষে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৫১ মিলিয়ন। ১৮৭১-৮০ এবং ১৮৯১-১৯০০ এই দুই দশকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারও ছিল খুব কম। এই সময় ভারতবর্ষ জুড়ে অনেক বড় বড় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল।
🍂
অন্যদিকে ১৯২১ থেকে পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছিল ৩৭৯ মিলিয়ন। আগের পঞ্চাশ বছরে তুলনায় তখন বড় দুর্ভিক্ষের সেরকম প্রভাব দেখা যায়নি। দুর্ভিক্ষই যে জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
রামকৃষ্ণ মিশনের সেবা কার্য বর্তমানে বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত হলেও তার সূচনা কিন্তু হয়েছিল পীড়িত এবং মূলত দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষের কষ্ট মোচনের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। তবে এই উদ্দীপনার চালিকাশক্তির মূলটি খুঁজতে গেলে আরও পশ্চাতে যেতে হবে। মঠ- মিশনেরআবির্ভাব তখন দূরস্থ। শ্রীমা সারদা দেবীর বয়স তখন মাত্র এগারো বছর, সেই সময় ১৮৬৪-৬৫ সালে জয়রামবাটী অঞ্চলে ভীষণ দুর্ভিক্ষ হয়। শ্রীশ্রী মায়ের পিতা দরিদ্র হলেও হৃদয়ের আবেগে অন্নসত্র খুলে দিয়েছিলেন। মায়ের ভাষায়, ‘একবার সেখানে কি দুর্ভিক্ষই লাগল -- কত লোক যে খেতে না পেয়ে আমাদের বাড়ি আসত।... একেক দিন এমন হতো, এত লোক এসে পড়ত যে, খিচুড়িতে কুলত না। তখনই আবার চড়ানো হতো। আর সেই গরম খিচুড়ি সব যেই ঢেলে দিত, শিগগির জুড়াবে বলে আমি দুহাতে বাতাস করতুম! আহা! ক্ষিদের জ্বালায় সকলে খাবার জন্য বসে আছে।’ দুর্ভিক্ষের করুণ ইতিহাসের সঙ্গে শ্রীমাসারদা দেবী ও শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জীবন জড়িয়ে আছে। দুর্দশা ক্লিষ্ট মানুষের কষ্ট দূর করার প্রয়াস নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব নিজেই। মথুর বাবুর সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণদেব তীর্থ যাত্রা করেন ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি তারিখে, বৈদ্যনাথ ধামের নিকটবর্তী কোনো এক গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় গ্রামবাসীর দুঃখ-দারিদ্র্য দেখে শ্রীরামকৃষ্ণদেব প্রায় জোর করেই মথুরের মাধ্যমে এদের পেটভরে খাওয়ালেন ও কাপড় দিলেন। এই দুর্ভিক্ষ সম্ভবত ১৮৬৫-৬৭ উড়িষ্যা দুর্ভিক্ষেরই ফল। এরপরেও শ্রীরামকৃষ্ণদেব আরেকবার নদীয়া জেলাতে মথুরবাবুর জমিদারিতে গিয়েছিলেন, সেখানেও দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষদের এভাবেই সেবা করেন। ১৮৫৮ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত ভারতের আর্থসামাজিক ইতিহাস বড়ই মর্মান্তিক। তার বড় কারণ ঘন ঘন ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষ। এই সমস্ত দুর্ভিক্ষগুলিই ভারতবর্ষের অর্থনীতির মূলে আঘাত করেছে। অর্থনীতিবিদেরা তাদের বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে এই দুর্ভিক্ষ ও দুর্দশার কারণগুলিকে মূলত চারটি ভাগে ভাগ করেছেন: প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক। প্রাকৃতিক কারণের মধ্যে রয়েছে মৌসুমী বৃষ্টির ন্যূনতা, বন্যা, কীটপতঙ্গের আক্রমণ। তবে মূল কারণ হচ্ছে মৌসুমী বৃষ্টির অভাব। ফলস্বরূপ ফসল ভালো হয়নি। দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব আর খাদ্যাভাব দেখা দিলে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। রাজনৈতিক কারণ দেখতে গেলে বলতে হয় বৈদেশিক শাসকদের উপস্থিতি দুর্ভিক্ষ ত্রাণকার্যে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। বেশিরভাগ শাসকই দেশীয় ভাষা জানতেন না আর সেই সঙ্গে সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কেও তাদের কোনো জ্ঞান ছিল না। তাঁরা দুর্ভিক্ষ সংক্রান্ত বিষয়কে প্রশাসন ও অর্থের নিরিখেই বিচার করতেন। কি করে মানুষের প্রাণ বাঁচানো যায় তা নিয়ে এরা বিশেষ চিন্তিত ছিলেন না। সহৃদয়তার বিশেষ অভাব ছিল। অর্থনৈতিক কারণের মধ্যে ছিল দেশীয় শিল্পের ধ্বংস, দুর্বহ রাজস্ব ব্যবস্থা, দেশ থেকে সম্পদ নিষ্কাশন, বড় আকারের বৈদেশিক সেনাবাহিনীর জন্য খরচা। ভারতবর্ষ শাসিত হয়েছিল ভারতের জন্য নয়, ব্রিটিশদের জন্য। এর ফলে ভারতবর্ষের দারিদ্র্যই ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে আর তার ফলস্বরূপ দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ। সামাজিক যে কারণ দুর্ভিক্ষের সময় মানুষের দুর্দশাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে তাহলে সামাজিক জাতিভেদ প্রথা এবং অশিক্ষা।
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর পরিব্রাজক জীবনে বাংলা, বিহার এবং অন্য প্রদেশের যে সমস্ত অঞ্চল দিয়ে ১৮৮৮-১৮৮৯ সাল নাগাদ যাতায়াত করেছেন, সে সমস্ত স্থান কম- বেশি ১৮৬৮-৭০, ১৮৭৩-৭৪ এবং ১৮৭৬-৭৯ সালের দুর্ভিক্ষের প্রভাবের শিকার। সেই সময় বহু জায়গাই তিনি ঘুরেছেন যেগুলি সেই শতকের দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে। এইসব জায়গাগুলি তিনি স্বচক্ষে দেখে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ প্রভাব উপলব্ধি করেছেন। আবু রোডে তুরীয়ানন্দের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হতেই বলেন, ‘হরি ভাই আমি এখনও তোমাদের তথাকথিত ধর্মের কিছুই বুঝিনা। কিন্তু আমার হৃদয় খুব বেড়ে গেছে এবং আমি অপরের ব্যথা বোধ করতে শিখেছি।’আর সেই স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে তার পাশ্চাত্যে পাড়ি দেওয়া।সেখানে গিয়ে প্রচার করেছেন নিজের দেশের দারিদ্র্য এবং দুঃসহ দুর্দশের কথা। ১৮৯৩ এর ২৯ আগস্ট ইভিনিং নিউজে পাশ্চাত্যে প্রকাশিত প্রথম বক্তব্য পাই, ‘দেশের কোন কোন অঞ্চলে লোককে মাসের পর মাস এমনকি বৎসর পর বৎসর একপ্রকার গাছের ফুল সিদ্ধ করিয়া জীবনধারণ করিতে হয়। কোথাও কোথাও পরিবারের জোয়ান মরদরাই খায় ভাত, স্ত্রীলোক শিশুগণকে ভাতের ফেন দিয়া ক্ষুণ্ণিবৃত্ত করিতে হয় । কোন বৎসর ধান না হইলে দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী। দুর্ভিক্ষ ও তার মারাত্মক প্রভাব উদ্বিগ্ন বিবেকানন্দ যে পরবর্তীকালে দুর্ভিক্ষ পিরিত লোকেদের দুঃখনিবারনে অন্যদের ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করবেন এ কথা তো স্বাভাবিকই।” ( স্বামী অখণ্ডআনন্দ মননে, সম্পাদনা মৃণাল গুপ্ত, রামকৃষ্ণ মিশন সারগাছি,মুর্শিদাবাদ )
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments