জ্বলদর্চি

আমিও আকাশদীপ জ্বালি/দিলীপ মহান্তী


আমিও আকাশদীপ জ্বালি

দিলীপ মহান্তী

  ১
পুরনো পথের রেখা চিনে চিনে ঝর্ণার স্রোতে ভেসে যাই
ধুলো ওড়া পথে পথে ফাল্গুন বিকেলে ভিজে শ্রাবণের মেঠো গান গাই
রিক্ত নদীটির ব‍্যথা গায়ে মেখে রোদ্দুরের কথা টেনে আনি
রাঙামাটি বুকে ভরে পাহাড় ডুংরি ধারে জঙ্গলের গন্ধটুকু ভানি!

   ২
মুগ্ধতার ভাষাগুলি পথের দু'ধারে ঝরে ঝরে পড়ে
বিদ্বেষের শব্দরাজি বাতাসে বাতাসে ভাঙে, আর নড়ে
আমাদের লালমাটি রক্তের চিহ্নগুলি বুকে পুষে রাখে
চারদিকে জঙ্গলের বিষাদলেখা পাতা অশ্রুধারা মাখে!

    ৩
রাতচরা পাখি কাঁপে বন্দুকের বেপরোয়া ডাকে
বাতাসেরা চুপি চুপি ঝোপঝাড় নদীপথে বাঁকে
চাঁদও ডুবে যায়, নদী স্রোতে বালিঝড় ওঠে
সমস্ত বেদনাগুলি রাত জাগে -  স্বপ্ন হয়ে ফোটে!

     ৪
ফেলে আসা কৈশোরের দিনগুলি বুকে বুকে রাখি
অজস্র রক্তমণি জ্বলে ওঠে, সেই সব জ‍্যোৎস্নালেখা মাখি
ভুলে গেছে সন্ধ‍্যাতারা! আকাশ জুড়ে ছোপ ছোপ কালি
সেই সব স্বপ্ন ছুঁতে আমিও আকাশদীপ জ্বালি!

     ৫
স্বপ্ন থেকে চুঁইয়ে পড়ে রক্ত মাখা পলাশের ডাল
হিংস্রতার কণাগুলি জমা রাখে জঙ্গলের দীর্ঘ দীর্ঘ শাল
সবুজ পাতার ফাঁকে রাত কাঁপে, আঁধার গড়িয়ে পড়ে মাঠে
দু'পাশের শস্যক্ষেতে ফসলের কান্না দেখে ব‍্যর্থ দিন কাটে!

   ৬
কোথায় লুকোবো এ দগ্ধদেশ! গোপন দীর্ঘশ্বাস
এই খানে এই মাটির হৃদয়ে শুয়ে আছে কত লাশ
গুলি খাওয়া ওই থ‍্যাঁতলানো দেহ, কারো কাটা গেছে হাত
লোকালয়ে ঘোরে নেকড়ে হায়েনা, বনে বীভৎস রাত!

  ৭
এখানে এখন আকাশে ভাসে বাতাসের নখ থাবা
প্রখর রৌদ্রে শ্মশানে শ্মশানে ফুটেছে রক্তজবা
পাহাড়ে পাহাড়ে শকুনের চোখ, খেলা শকুনির পাশা
প্রত‍্যন্ত এই গভীর অরণ্যে মিডিয়া নিয়েছে বাসা!
                  
  ৮
জঙ্গল আজ বিষাদে রয়েছে ভ্রাতৃহত‍্যা দেখে
অন‍্যের ক্রোধ, বাদী প্রতিবাদীর সাক্ষী শরীরে মেখে
আমার এই দেশে এই প্রিয় মাটি মৃত মহুয়ার দেশ
দুঃশাসনের সংখ্যা বেড়েছে ধরেছে দ্রৌপদী কেশ!
                      
স্লেটের লেখায় ধরা দিত কত নিখিলব‍্যাপী মাঠ
বৃষ্টি অভাবে পুড়ে ছারখার খরায় এ তল্লাট
এ সকালগুলো যামিনী রায়ের দুপুর-চেরা ছবি
ভয় ঢেলে দেয় জঙ্গলে ঘাসে গ্রহণ দিনের রবি!
                    
 ১০
মিথ্যে দিয়ে কী ভাবে আঁকবো বনলতা সেন মুখ
বসুন্ধরার ধর্ষিতা রূপে ভেঙে গেছে এই বুক
চলে গেছে দিন আষাঢ় শ্রাবণ প্রণয়ের পদাবলী
আত্মীয় মাঝে কীর্তন গানে রাসমঞ্চের গোধূলি!
       
১১
আমাদের সেই সবুজ বয়সে পথে নেমেছিল রাধা
স্বপ্নের সেই সোনাঝরা দিনে মেঘমল্লার সাধা
উড়ে যায় কথা সেদিনের খোঁজে অরণ্য পর্বতে
অথবা দিনের মিছিল মাড়ানো বেদনা ধূসর পথে...
                     
১২
এই মাঠে এসে ভুলে গেছি আমি কিশোর ছিলাম কবে
জমি খাল বিল সাঁতরানো দিঘি বয়স বেড়েছে সবে
ধুলো মাখা পথ যক্ষ্মায় ভোগে মাখে শুধু প্রসাধন
স্মৃতির অতলে তলিয়ে ভাসছে আমার ধূসর গ্রাম!
                       
১৩
কুয়াশায় ঢেকে গেছে ধানজমি, রাস্তার রক্ত-রাঙা বেশ
জঙ্গলের পথে পথে বোঝা নিয়ে আলুথালু লুটায় সুকেশ
আমাদের জন্মভূমি লুটিয়ে পড়ছে পথে, অভাবের দেহ
চারপাশে গাছে গাছে ঘাসে ঘাসে মধুমাখা আদরের স্নেহ!
                   
  ১৪
যেখানে রয়েছি প্রেমিকারা বাঁচে, জেগে থাকে কত প্রেম
আছে অমিয়মাখা সেই সব পদ যেন নিকষিত হেম
এ দেশের এই মেঠো প্রেম গান আজ দুর্দিনে ভাঙা
চণ্ডীদাসের বেদনার ভাষা রক্তের লালে রাঙা!
🍂
                
    ১৫
সাঁতালি পর্বতে পাহারায় আছি হাতে নিয়ে হেতালের লাঠি
কালনাগিনী ঢেলে দেয় বিষ ঘুমের মধ্যে, স্বপ্ন দেখা মাটি
বয়ে যায় নদী, ভেসে যায় ভেলা, ধোপানি কাপড় কাচে
বেহুলা নাচছে রাজদরবারে লখিন্দররা বাঁচে!
                
     ১৬
 আছি শত শত অলস চোখের ঈর্ষা বাঁচিয়ে দূরে
নেই তারা শ্রমে, বিপ্লবে বা জয়ে, অন‍্য গানের সুরে
কোমল ঘাসের বাউল বাতাসে প্রসারিত হৃদি সুখ
নিচু হতে হতে ইতিহাস গড়ে বারুদ বুলানো বুক!
    
    ১৭
পথ নেই তবু পথের খোঁজে ভুলেছি রোদন ভাষা
দীর্ঘ আঁধার একটু সরাতে আগুনের কাছে আসা
তৃষ্ণায় ফাটা বুকের কাছে এসেছে চণ্ডালিনী
আনন্দ ছুটছে প্রাণ ভয়ে তার পিছনে যৌথবাহিনী!
     
    ১৮
বাঁচার পরবে বাহুবলী পথে, মানুষ রয়েছে ঘরে
ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে ঘুরে, নিরীহ মানুষ মরে
এই অমানিশা কী করে ঘোচাবে কার ধড়ে ক'টা মাথা
লিখে রাখি আজ জলের অক্ষরে পীড়িত দেশের কথা!
            
       ১৯
দেশের সকল শস্য পুড়িয়ে অসময়ে নামে বৃষ্টি
অপরাধী এসে আয়না ধরেছে, অন্ধ পেয়েছে দৃষ্টি
হাত পাতা ওই ভিখারী মানুষ সরিয়ে নিয়েছে হাত
আগুন মাটি জলের কাছে হিসেব নেওয়ার রাত!

                
 ২০
হিসেবের খাতা খোলা আছে কত প্রান্তর ঘেরা ঘাসে
রোদ উড়ে আসে নদী তীর কাঁপে দীর্ঘ দহন মাসে
হাওয়া ঢেকে দেয় ধুলোর আকাশ অট্টালিকার সারি
অন্ধকারে চরাচর জ্বলে, স্টেশন কাঁপায় রাতের রেলগাড়ি!

                        
২১
পাতা ঝরে যায়, অভিমানে কাঁপে ধূসরিত ধরাতল
মাটির বুকেতে আছড়ে পড়ছে শত ঝর্ণার জল
ছায়া ছায়া মুখ মালঞ্চ থেকে এখনো জ‍্যোৎস্নার আভা জ্বলে
রোদ মেখে ফুটে ওঠে তারা আর দৃষ্টির বিদ্যুতে মোম হয়ে গলে...

                     
  ২২
রোদ্দুরের রং নিয়ে নদীটি লিখত চিঠি আকাশের কাছে
বাতাস পিয়ন সেজে হেঁটে হেঁটে দেখে কত কত রাতফুল ভোর হয়ে আছে
রাতের ধূসর ডানার গন্ধে ভেসে ওঠে কত কত সূর্যরাঙা চর
সমুদ্রপারের হাওয়া ঝড় হয়ে ভেঙে দিল স্বপ্ন দেখা ঘর!

                       
 ২৩
শুকনো রক্তের দাগ বৃষ্টি এসে ধুয়ে দিতে চায়
সেই সব চিরচিহ্ন মাঠের ওপরে ঘাসের ওপরে দাপায়
হাওয়ারা জড়িয়ে পড়ে অসমাপ্ত দিনের মিছিলে
রাত এসে চুপি চুপি দরজা দেয় মায়াবী অন্ধকার ঢেলে...

                    
  ২৪
তবুও জঙ্গলের পাশ দিয়ে পাহাড় কাঁপিয়ে চেনা নদী বয়
সমস্ত বিকেলগুলি বুকে নিয়ে ঢেউ তোলা অঙ্গ গীতিময়
দু'পাশের মাঠ ঘাট ভুলে গেছে ফাগুন জ্বলা পলাশের ভাষা
মেঘগুলো সরে সরে আকাশের পোড়া বুকে ঢেলে দেবে করেছিল আশা!

                
   ২৫
যাবতীয় ক্ষতচিহ্ন দূরে রেখে ফেলে আসা নদীটির বুকে
কাগজের নৌকো বেয়ে এইসব দিনরাত্রি স্রোতে ভাসে সুখে
সন্ত্রাসের পরিবেশে তবু দেখি জ‍্যোৎস্না দেয় চাঁদ এক ফালি
সমস্ত বিচ্ছেদের জন্য সমস্ত পীড়িতের জন্য আমিও আকাশদীপ জ্বালি!

সংগ্রহ করতে পারেন 👇


                     ---

Post a Comment

1 Comments

  1. Darun kobita...the reflection of contemporary society is mindblowing

    ReplyDelete