জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৬৮

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৬৮
সম্পাদক -মৌসুমী ঘোষ 
চিত্রগ্রাহক - কল্যাণ সাহা
সম্পাদকীয়,
কল্যাণ আঙ্কেলের তোলা প্রচ্ছদের ছবি দেখে বলতে ইচ্ছে করছে, বসন্ত এসে গেছে। গাছে গাছে উঁকি দিচ্ছে ফুলের কুঁড়িরা। কিন্তু আমাদের ছোটোবেলার কুঁড়ি কুঁড়ি ফুলেরা পরীক্ষা নিয়ে নাজেহাল। সরস্বতী পুজো সবে মিটেছে তাই স্বপ্ননীল আর আয়ুস্মিতার আঁকা ছবিদুটো খুবই প্রাসঙ্গিক। শুধু কি তাই সবেমাত্র আমরা পালন করলাম ভাষা দিবস। তারও একটা ছবি রুদ্রাংশ এঁকে পাঠিয়েছে ছোটোবেলার দপ্তরে।  এর পরে পাঠিয়ে দাও রঙ খেলার ছবি। তোমাদের আঁকার রঙীন হয়ে উঠুক ছোটোবেলার পাতা। পরীক্ষা যখন সামনে তখন চলে আসি পড়ার কথায়। দোলনচাঁপা আন্টি জাতীয় বিজ্ঞান দিবস নিয়ে লিখেছে। কার জন্মদিন জানো সেদিন? না জানলে লেখাটা পড়ে জেনে নাও। পড়তে বসলেই সবারই খিদে পেয়ে যায়, কি তাই তো? পড়ে নাও তপশ্রী আন্টির গল্প খাদ্য রহস্য। পরীক্ষা শেষ হলেই বেড়াতে যাবে তাই না? আমেরিকা ভ্রমণের গল্পটা পড়ছো বাসবদত্তা আন্টির লেখা থেকে? আর লাচুঙের পুঙখানুপুঙখ জানতে পারবে শ্রীকান্ত আঙ্কেলের লেখা থেকে। রহস্য জমে উঠেছে। এসো পড়ি আর পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখি।.....  মৌসুমী ঘোষ।
ধারাবাহিক উপন্যাস
লাচুঙের নেকড়ে
শ্রীকান্ত অধিকারী

পর্ব ৩৭

ট্রীটি অব ব্লাড ব্রাদারহুড’–এর নাম শুনেছেন? আর শুনবেনই বা কীভাবে? অমরবাবু উঠে দরজার কাছে গিয়ে আবার রামসিঙের মায়ের কাছে ফিরে এসে বলেন, কাবি লুংচুকের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের মানে লেপচাদের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে তিব্বতে ‘ইয়লো হ্যাটস’ অ্যান্ড ‘রেড হ্যাটস’ এই দুই জনজাতির মধ্যে প্রায়ই ঝুট ঝামেলা লেগেই থাকত। কারণ ওদের মধ্যে কে বড় কে তুলনায় মহৎ-এই ছিল লড়াইয়ের মেইন ডিমান্ড। এর জন্য রেডহ্যাটদের অনেক ভোগান্তি হচ্ছিল। একদিন নিজেদের বাঁচাতে বরফ ঢাকা পাহাড়ি পথ ধরে সিক্কিমে চলে আসে। নেয়ার অ্যাবাউট ফোর্টিন্থ সেঞ্চুরি। এই ইতিহাস শোনানোর সময় অমরবাবুকে বেশ উত্তেজিত লাগছিল। 
এদিকে ভোট জাতির কিছু আদিবাসীও এই বিস্তৃর্ণ সিকিমে বাস করত। কিন্তু এখানেও সেই গোল বাঁধল। ঝামেলা শুরু হল। কিন্তু বেশি দূর গড়াল না। তার আগেই সিকিমের আদি অধিবাসী  লেপচা, ভোট উপজাতি যারা জাতিগত ভুটিয়া আর দক্ষিণ তিব্বতের আদিবাসী যারা সিক্কিমে এসে বাস করতে শুরু করেছিল এই তিন জাতির মধ্যে ব্লাড ব্রাদারহুড চুক্তি স্বাক্ষর করে। তিব্বতের রাজা, ভোট জাতির রিপ্রেজেন্টেটিভ খে বুমসা এবং ঠেং টুক এই চুক্তিতে সই করেন।  কোন জায়গায়? কাবির লুংচুকে। ‘কায়ু শা বি লুংচুক’। 
-কী বললেন? রামসিঙের বাবা বলে। 
 মতলব আমাদের রক্ত দিয়ে তৈরি পাথর। লুংচুকের মূর্তিগুলো দেখেন নাই?  
 রামসিঙের মামি চুপ করে ছিল। এতক্ষণ হয়তো লুংচুকের গল্প শুনছিল। হঠাৎ বলে ওঠে, সে তো সেই প্রথম যেদিন সিকিমে পা দিয়েছিলাম। কি কুক্ষণেই যে পা দিয়েছিলাম! 
-সে সব ঝামেলার কথা আমাদের শুনে কী হবে? রামসিঙের মা বলে। 
আমাদের কথা না শুনতে শুনতে আমরা সারা পৃথিবীর কাছে অচেনা হয়ে রয়ে গেছি। অথচ আমাদের প্রাচীন সভ্যতা ছিল। আমাদের ভাষা প্রাচীন ভাষাগুলোর মধ্যে একটা। সিক্কিমে বাস করে যে উপজাতিগুলো সেই সোম লেপচাস, লো, সেই লিম্বুস এদের কথা কেউ জানে না জানতে চাও না। যেমন আপনারাও। অথচ…
রামসিঙের মা দ্রুত অমরবাবুকে থামিয়ে বলে, বুঝতেই তো পারছেন আমাদের মনের অবস্থা। 
-এই জন্যই তো সেরগিল সাহেব আপনাদের আমার এই ক্ষেত্রে আনতে বললেন। আমার এই ‘এম এল এ এস’–এর ছেলে মেয়েরা এই আদিবাসীদের সংরক্ষণ করে। ওদের হ্যান্ডিক্রাফটের মাধ্যমে ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যেমন পরিচয় করিয়ে দেয়,ওয়ার্ল্ডের লোকেরাও ওদের চিনতে পারে, জানতে পারে।  
-তার মানে ভুটান তীব্বত আর সিক্কিমের জনজাতির লোক শুধু নয় বলতে গেলে এই তিন রাষ্ট্রের  প্রশাসনিক তৎপরতা এই কাবি লুংচুককে ঘিরে আছে। 
অমরবাবু মাথা নাড়েন।
-তার মানে যেদিন আমরা প্রথম সিক্কিম এসে নাগা ফলসের কাছাকাছি বিভিন্ন রাজ্য বা রাষ্ট্রের সরকারি গাড়িগুলো আমাদের লাচুং ঢুকতে অসুবিধায় ফেলছিল সব ওই কাবির লুংচুকে আসার ফল।  
- আসলে এই প্রস্তর মূর্তি এখন আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও মর্যাদা বহন করছে কিনা!  
কখন চম্পা এসে ওদের কথা শুনছিল আর মিটিমিটি হাসছিল। অমরবাবু বলেন, চম্পার সঙ্গে যান, দেখে আসুন লেপচা কাদের বলে? 
পাশ দিয়ে যাওয়া কোনো ঝরনা বা ঝোরা ওপর থেকে নীচে নামছে। তারই ভয়ঙ্কর একটানা শব্দ ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে এক বিদ্ঘুটে শব্দ যেটা কোনো দিন সমতলের রাতে শুনতে পায়নি দীপকবাবু। নানান জায়গায় রাতের অন্ধকারে রেড করেছে, এমনকি ভূতুড়ে বাড়ি বা কোনো মিলিট্যান্টকে অ্যাটাক করার জন্য প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও যেতে হয়েছে কিন্তু এমন হাড় হিম করা শব্দ শোনেনি। কখন যে রাত এসে গ্রাস করে নিয়েছে এই বন জঙ্গলের মাঝে উপজাতিদের ছোট ছোট ঘরে। তবু রক্ষে, কী করে যে একটা দুটো টিম টিম করে বুনো শুয়োরের চর্বি দিয়ে জ্বালানো  তেলের কুপি জ্বলছে। সেই আবছা আলোতে মানুষের মুখ দেখা যায় না তো কাগজ-পত্র কী দেখবে। তাই হয়তো পাশের ঘর থেকে ঘরর ঘরর করে নাক ডাকার শব্দ এই নিস্তব্ধ পরিবেশকে আরো ঘন করে তুলছে। 
বড়মামা শোয়নি। বাঁশের চেয়ারে ঝিমোচ্ছে। ঝিমোতেই ঝিমোতেই বলে,-সেরগিল। সেরগিল নিশ্চিন্তে নাক ডাকছে। অন্য ঘরে এস পি গ্যাঙটক। ছেত্রী ম্যাডাম। দীপকবাবু এবং বড় মামারা লোকাল লোকেদের মোটা জ্যাকেট আর টুপি জুতো পরেছে। কিছুতেই এমন ঠান্ডায় থাকা যায় না। তাই হয়তো সেরগিল সাহেব এই ব্যবস্থা করেছে।  তবুও ওই দুজনেই না ঘুমিয়ে ঘরের বাইরে এসে সামনের পুরু কালো পর্দায়  চেয়ে আছে। এই চেয়ে থাকা যেন সেই চির দেখা নয়, অন্ধকার ভেদ করে অন্ধকারের ওপারে প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধান করা। আর সেই সত্যের কাছাকাছি পৌঁছতে যে ক্লু বা সিঁড়ি দিয়ে যেতে চাইছে লাচুঙের পুলিশ তা কখনো কখনো প্রকৃত সত্যকেও ভুল পথে চালিত করছে। দেখবেন স্যার আমার মন বলছে খুব তাড়াতাড়ি আমরা কালপ্রিটদের কাছে পৌঁছতে পারব। দীপকবাবু রাতের আবছা অন্ধকারে সারা শরীরটাকে অশরীরী আত্মার মত নাড়িয়ে দিয়ে বড় মামার একেবারে কাছাকাছি এসে বলেন, কিন্তু তার আগে একটা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে। তাতে আহত তো হবেই আরো ভয়ঙ্কর কিছু…, ফিসফিস করে বলেন,-পচা মাংসের গন্ধ পাচ্ছেন না? 
অনন্ত বিস্তৃত শূন্যতায় হা হা করে বাতাস বয়ছে, সঙ্গে ঝোরার ঝরে পড়ার বিষণ্ণতার আবহে এই তুষারাচ্ছাদিত অস্বচ্ছ পাহাড়-জঙ্গলে আড়াল করা কোন প্রাচীন সভ্যতা বহনকারী আদিবাসী গৃহে এমন কথায় কে না সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে! হাত পা অসাড় হয়ে চমকে উঠবে না? বড় মামারও তাই হয়েছে। এমনিতে সারা জীবন চোর ডাকাত বদমাইশ খুনিদের পেছন পেছন দৌড়তে হয়েছে বটে কিন্তু কখনো এই সঙ্কটে পড়তে হয়নি। তবু বুকে গুম মেরে বসে থাকা দৃঢ়তা,কলিজার জোর আজকে এই জায়াগায় এনে ফেলেছে। শেষ জীবনে এই কাজটা করে যেতেই হবে। গলার স্বর নিম্নগামী করে বলেন, পচা মাংস না? ইঁদুর বাঁদর কী হতে পারে? আমি অবশ্য এখানে অ্যায়সা অ্যায়সা খরগোশের মত ইঁদুর দেখেছি। 
 -নো স্যার, ইঁদুর যত বড়ই হোক এতটা দুর্গন্ধ ছড়াতে পারবে না। এ অন্য কিছু। ঠিক ট্রাকের ভেতর থেকে যেমন বেরিয়ে আসছিল ঠিক তেমন। এমনিতে শীত কালে মাংস পচতে দেরি হয়। আর যদি বা পচে, গন্ধ যে খুব বেশি ছড়ায় তা নয়। তার ওপর এই আইসে ঢাকা অংশ! বরফিলি আপার ল্যান্ড! তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস চার পাঁচের কাছাকাছি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দেয় এই বিশ্রী গন্ধ। 
-মর্গের ভেতরের গন্ধ! অন্ধকারেই চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে ওঠে নটবর নন্দী। মাঝে মাঝে লাশ কাটা ঘরে পুরোনো লাশ এনে মাতাল ডোম ব্যাটা বুক মাথা ফাটিয়ে আবার ঠিক ঠাক সেলাই করেছে কিনা দেখতে হত আমাদের। তখন থেকে চেনা এই গন্ধ। আজ আবার! 
 এক্কেবারে দারোগার মত ডাইগনিশ! দীপকবাবু বলেন। নাহ আপনার নাকটা এখনো মরে যায় নি। যে কোনো ফোর্সে এই কুত্তার নাকটাই অত্যন্ত ইমপরটেন্ট। 
বাইরের ছোট একট ঘরে লেপচা গ্রামবাসীরা,যারা মুটে বইছিল আর পথ দেখাচ্ছিল তারা এক সঙ্গে আছে। তাদের কাছের একটা ছোট্ট ঘরে তিনজন কনস্টেবল যারা নতুন করে মঙ্গন থেকে এসেছে। সঙ্গে আর একটা ভ্যান গাড়ি। আর তার ড্রাইভার। 
ওদের দিকে চোখ রেখে দীপকবাবু নীচু স্বরে বলেন, তার মানে এই গন্ধটা বেশি ক্ষণ আগের নয়। দ্বিতীয়ত এটা প্রমাণ করে এই গন্ধের সঙ্গে মৃত কোনো বড় জন্তু জানোয়ার কিংবা মানুষেরও হতে পারে।  
তৃতীয়ত আমাদের হয়তো আর বেশিদূর যেতে হবে না, যদি আমি ঠিক ঠাক থাকি। অর্থাৎ ভয়ঙ্কর কিছু একটা আজ রাতেই হতে পারে। 

রামসিঙের বাবা মা বড় মামিদের সঙ্গে গ্যাটসোও আছে। অমরবাবুর হাউজ প্রোপার্টির মধ্যে হলেও এলাচের বাগান বেশ ক’টা পেরিয়ে আপেল এবং পাইন গাছের বীথী পেরোতে হল চম্পার বাড়ি যেতে। গোটা কতক কাঠবাদামের গাছও। এমন কি আখরোটের গাছ। লেপচাদের শখ। তবে গাছগুলোর পাতাগুলো তেমন জমাটে ছিল না।  
চম্পাদের ঘরে ঢোকার মুখে সেই চিহ্ন। অ্যামিনিষ্টদের। রামসিঙের বাবা ও মা দুজনেই ব্যাপারটা দেখেছে। পাশে শিঙি আর বড় মামি। 
-আর কিছু হোক আর না হোক রাতের জঙ্গুর আলাদা আকর্ষণ আছে, কী বলেন আপনারা ?- চম্পা বলে। 
কিন্তু এত সব মনকাড়া পরিবেশ নতুন সমাজের জীবন যাত্রার চক্র সব ওদের কাছে আর ভাল্লাগে না। তাই দ্রুত এদিক ওদিক ঘুরে শুধু চোখের দেখা দেখে নিয়ে ফিরে আসতে চাইছিল ওরা। বেরিয়ে পড়ে ছিল গ্যাটসোকে নিয়ে, ঠিক সে সময়ে কয়েক পা দূরে উত্তর-পূর্ব কোণে অদ্ভুত ভাষায় টেলিফোনে কিছু কথা ভেসে আসায় রামসিঙের মা থমকে দাঁড়ায়। ছোটবেলায় রেডিওতে এমন কিছু অদ্ভূত ভাষা শুনত প্রতিদিন সন্ধেবেলায়- ইন্দু দুয়ালি কম্পুচিয়ান থাই! কথাটার মানে বা উচ্চারণ সঠিক ছিল কিনা জানা নেই, তবে বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কী ভাষা? 
-কম্বোডিয়ান। এক সময় দ্বিতীয় ভারতবর্ষ বলে খ্যাত ছিল কম্বোজ, মানে এই কম্বোডিয়া।  ভারতবর্ষের সঙ্গ ভাল সম্পর্ক ছিল এই দেশের। ধর্ম সংস্কৃতি দুয়েই। বিশাল আঙ্কোরওয়াট বিষ্ণু মন্দির তার প্রমাণ দেয়। আজ হয়তো পূর্বের মত সেই বিষ্ণুর প্রসার নেই সে দেশে তবে অনেকেই এখনো বৌদ্ধ। আজও তাই রেডিওতেও দুই দেশের সেই মিলিত সভ্যাতার স্বাক্ষর ভারতীয় সংস্কৃতি বহন করে। যেমন করে চীন। চীনের বিভিন্ন রেডিও স্টেশনে এখনো বাংলা গান বাজে। 
আজ সেই ভাষা এখানে বাজে কেন? এখানে তো গান হয় না। তবে? একটা অজানা অথচ অনুমেয় আশঙ্কায় রামসিঙের মা এগিয়ে যায় ওই শব্দ লক্ষ্য করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাইকে চমকে দিয়ে বিকট চিৎকার করে ওঠে শিঙি।–সাপ! ক’টা মাথা গো বাবা? 
চম্পা তাড়াতাড়ি জবাব দেয়, ও কিচ্ছু নয় গো বাবু, ও মুচলিন্দ!  
(ক্রমশ)

রুদ্রাংশ দাস
নবম শ্রেণি, সোদপুর চন্দ্রচূড় বিদ্যাপীঠ, উত্তর ২৪ পরগণা

খাদ্যরহস্য
তপশ্রী পাল

সারাদিনের কাজের মাসী সন্ধ্যা, অতসীকে বলল “আজকে ভাত হলেই চাল শেষ। দাদাকে আনতে বলবেন।“
“অ্যাঁ! বলোকি! এইতো দুদিন আগে দাদা দশ কেজি চাল আনলো! এর মধ্যে শেষ! আমাদের এই আড়াই জনের সংসার, আমরা দুজন আর এই ছোট্ট ছেলে ‘বাদাম’ । আমরা তো দুপুরে বাড়িই থাকি না, ভাতও খাই না! শুধু বাদাম একটুখানি খায়। রাত্রেও বেশীরভাগই রুটি হয়। এ হতেই পারে না। দেখ হয়তো চাল কোথাও তুলে রেখেছো, মনে নেই তোমার! তুমি তো না দেখেই শুধু ‘নেই নেই’ করো।“
“না বৌদি, অর্ধেক তুলে রেখেছিলাম । আজ সেই পাত্তর নামিয়ে দেখি, খালি!”
“খালি? বাড়ির মধ্য থেকে চাল যাবে কোথায়? তুমি আমার মাথা খারাপ করে দেবে দেখছি –“
চিন্তায় পড়ে গেলো অতসী। নিজের চাকরীর ঝামেলায় সংসারের অনুকোটি দেখে উঠতে পারেনা। সন্ধ্যা মাসীর ওপর গোটা সংসার। মাসী আঠেরো বছর কাজ করছে। খুব বিশ্বাসী। তবে বলা যায়না। সব খোলা পেয়ে যদি – নাহ এসব কি ভাবছে সে ? নিশ্চই মাসী অন্য কোথাও রেখেছে, মনে নেই।
অতসী তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে, বাদামকে স্কুলের জন্য রেডি করে বেরিয়ে পড়ে। অফিস যাওয়ায় সময় বাদামকে নামিয়ে দিয়ে যায় অতসী আর বাদামের স্কুলের কাছেই অফিস বলে, অফিস থেকে একবার বেরিয়ে ওকে বাড়িতে দিয়ে যায় অর্ধেন্দু। 
অতসীর ব্যাগে সবসময় এক টাকা, দুটাকা খুচরো রাখতে হয় অন্তত পঞ্চাশ টাকার মতো। ছোটবেলা থেকে প্রতিটি সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়ালে কোন ভিখারি, বিশেষ করে কোন বাচ্চা ভিখারি হাত বাড়ালেই মাকে হাত দিয়ে ঝাঁকাবে বাদাম যতক্ষণ না তাকে এক টাকা বা দুটাকা দেওয়া হচ্ছে। অনেক বুঝিয়েছে অতসী। এতে ওদের লোভ বেড়ে যায়, একজনকে দিলে দশজন চায়। কিন্তু বাদাম শোনার পাত্র নয়।
প্রায় হপ্তাখানেক কেটে গেছে। সেদিন অতসী ভাবল, বেশ অসময়ে বৃষ্টি নেমেছে। চালে ডালে খিচুড়ি করলে কেমন হয়? বাদামও খুব ভালবাসে। সন্ধ্যাকে খিচুড়ির অর্ডার দিয়ে, সবে গা ধুতে গেছে অতসী, সন্ধ্যা চেঁচিয়ে বলল “বৌদি শুনছ, খিচুড়ি হবে না ! মুগডাল শেষ।“
আশ্চর্য হয়ে যায় অতসী! এমাসে পাঁচশো ডাল এসেছে। ওরা তো মুসুর ডালই বেশী খায়। মুগডাল সপ্তাহে এক আধ দিন আর নয়তো বিশেষ কোন পদ বা খিচুড়ি হলে ব্যবহার হয়। শেষ কখনোই হওয়ার কথা নয়! বাথরুম থেকে বেরিয়ে অতসী বলে “মাসী, ভালো করে দেখ। ডাল যাবে কোথায়? তুমি আজকাল চোখে ভাল দেখ না, না কি? চারিদিকে খোঁজ।“
“হ্যাঁ, এখন আমারি যত দোষ ! বলতে চাইছো যে সব ডাল আমি খেয়ে ফেলেছি? নাকি চোখের মাথা খেয়েছি? যাও এ মাসের পরে আর কাজ করবনি। তুমি লোক দেখে নাও।“
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে অতসীর। সন্ধ্যামাসীকে ছাড়া তার সংসার অচল! সত্যিই মাসীকে এভাবে বলা ঠিক হয়নি। কিন্তু সংসারের জিনিসপত্র যাচ্ছে কোথায়? অনেক কষ্টে মাসীকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করে অতসী। 

রাত্রে খেতে বসে অতসীর মুখ হাঁড়ি। চুপচাপ খেয়ে চলেছে। খানিকক্ষণ দেখে অর্ধেন্দু বলে “কী হল? আজ কি বাদামের স্কুলের কোন খাতা টাতা বেরিয়েছে? নম্বর কম পেয়েছে, নাকি?” মাথা নাড়ে অতসী। 
“তাহলে? তোমার অফিসে কোন ঝামেলা?”
“উঁহু”
“ও বুঝেছি! মাসীর সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে নিশ্চই! তুমিও পারো বটে। মাসী ছাড়া তুমি অচল, অথচ ছোট ছোট ব্যাপারে খিটখিট করো!”
“আমি খিটখিট করি? আমি অচল?” খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় অতসী। অর্ধেন্দু দেখে বিপদ! তাড়াতাড়ি হাত জোড় করে বলে “সরি, সরি! বলবে তবে তো বুঝব হয়েছেটা কী?”
বাবাকে হাত জোড় করতে দেখে ফিকফিক করে হাসে বাদাম।  
অতসী বলে “ঘরে সারাক্ষণ চাল ডাল বাড়ন্ত! আগের থেকে বেশী আনলেও দুদিনে সব শেষ। কোনদিন মাসী বলছে চাল নেই, কোনদিন বলছে ডাল নেই! অথচ যথেষ্ট পরিমাণ আনা হচ্ছে! তাহলে জিনিসগুলো যাচ্ছে কোথায়! হয় চুরি হচ্ছে, না হয় মাসীই কোথাও রেখে মনে করতে পারছে না। বয়স তো হচ্ছে!” 
অর্ধেন্দু হেসেই অস্থির “ক্কি কান্ড! ঘর থেকে টাকা কিংবা দামী জিনিস নয়, চাল ডাল উধাও হয়ে যাচ্ছে! ফেলুদাকে ডাকতে হবে দেখছি! দেখ, হয়ত রান্নাঘরেই কোথাও রাখা রয়েছে! একটু খুঁজে দেখলেই পাবে। এই সামান্য কারণে তোমার মুখ হাঁড়ি?“
অতসী বোঝে অর্ধেন্দুকে এ সব বলে লাভ নেই। অর্ধেন্দু পাত্তাই দিতে চায় না। সে যখন গিন্নি, রান্নাঘরে তাকেই নজর রাখতে হবে। আজকাল, অকারণেই মাসী রান্নাঘরে ঢুকলে, ঘুরঘুর করে অতসী। আড় চোখে নজর রাখে। চাল ডালের বড়ো কৌটো সরিয়ে নিজের শোয়ার ঘরের খাটের তলায় চালান করে। রোজ মাসীকে মেপে চাল ডাল বার করে দেয়। যা সে কোনদিন করেনি, তাই করতে হচ্ছে। মাসিরও মুখ হাঁড়ি। কিন্তু চাল, ডাল উধাও হওয়া বন্ধ হয় না। খাটের নীচের বড় কৌটোও সময়ের আগে ফুরিয়ে যায়।
হঠাত অতসীর মনে হল, দিনেরবেলা, যখন বাদাম ছাড়া কেউ বাড়ি থাকেনা, তখন কেউ আসেনা তো? কাকে জিজ্ঞাসা করা যায়? ভেবেচিন্তে বাদামকেই জিজ্ঞাসা করে অতসী “হ্যাঁ রে, আমরা যখন অফিসে থাকি, কেউ আসে বাড়িতে?”
“সন্ধ্যামাসীর ছেলে আসে তো, মায়ের সঙ্গে দেখা করতে! আমার সঙ্গেও কতো খেলে। বাবন দাদা খুব ভাল।“ বলে বাদাম। 
🍂

সেই তো! এতোদিন ওদের চেনে অতসী, অথচ আজ ওদেরই সন্দেহ হচ্ছ। ছেলেটা তার মানে আসে। ছেলের হাতেই কি চাল ডাল পাচার করছে মাসী? সন্দেহটা হওয়ায় নিজেকেই নিজের খুব ছোট মনে হল। 
এরপর শুরু হল, আলুর পালা! দু কিলো আলু তিনদিনও চলছে না! নাঃ, রহস্য উদ্ঘাটন না করলেই নয়! এবার অর্ধেন্দুও চিন্তিত হয়ে পড়ল।
রবিবার দিন, বাড়ি ছিল অতসী ও অর্ধেন্দু। ঠিক বিকেল চারটের দিকে বেল বাজলো। পাশের বাড়ির মিসেস আগারওয়াল। ওর ছেলেও বাদামের স্কুলে পড়ে। এসে অনেক খোশগল্প করতে লাগলেন। কথায় কথায় বললেন যে তিনি মাঝেমাঝেই এই সময় আসেন। বাড়িতে হঠাত চিনি, দুধ ফুরিয়ে গেলে সন্ধ্যাকে বলে একটু নিয়ে যান। তাঁর ছেলেও বাদামের সাথে খেলে। 
শুনেই বুকটা ধক করে উঠল অতসীর! উনিও যে আসেন, দুধ চিনি নিয়ে যান, কই বলেনি তো মাসী! অদ্ভুত অভ্যাস কিছু মানুষের, পাশের বাড়ি থেকে জিনিস নিতে হবে? কেন, নীচের দোকান থেকে কিনে আনো না বাপু। আচ্ছা, মিসেস আগরওয়ালই কি তবে চাল ডাল আলুও চেয়ে নিয়ে যান? এরা তো নতুন এসেছে। অতসী চেনেও না, কে কেমন। উঁহু, এত কিছু নিলে মাসী বলতই, বিশেষ করে যখন এত প্রবলেম হচ্ছে। অতসীর মনে হল, ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাবে! 
ব্যাপারটা চলতে লাগলো। কখনো চাল, ডাল, কখনো চিনি, কখনো তরকারী কিংবা আলু। যখন অতসী প্রায় চাকরীতে ইস্তফা দেবে অথবা মাসীকে ছাড়িয়ে দেবে ভাবছে, তখন অর্ধেন্দু বলল “তুমি বরং এ সব করার আগে কয়েকদিন ছুটি নিয়ে বাড়িতে থেকে দেখ, যদি কিছু বুঝতে পার!” অতসী তাই করবে ঠিক করল। এমন সময়, হঠাত একদিন বাদামের ছোট্ট পড়ার বইয়ের আলমারি পরিষ্কার করতে গিয়ে অতসী দেখে, একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে খানিকটা চাল আর আলু! বাদামের বইয়ের আলমারিতে এগুলো এল কী করে? নিশ্চই কেউ সরাবে বলে নিয়েছিল, কিন্তু তাড়াহুড়োয় সরাতে না পেরে এখানে রেখেছে! আজ হোক, কাল হোক সে এখানে হাত দেবেই আর তখনি হাতেনাতে ধরতে হবে! এই ভেবে, পরদিন ছুটি নিয়ে নিল অতসী। তারপর সারাদিন নানা অছিলায় কতবার যে বাদামের পড়ার আলমারি খুলল – উঁহু, জিনিসগুলো যে কে সেই আছে! যথারীতি স্কুল থেকে ফিরলো বাদাম। তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে, খেলনা নিয়ে বসলো। অতসী শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। হঠাত খুট করে একটা আওয়াজ! তাড়াতাড়ি দরজার আড়ালে লুকলো অতসী। দেখে বাদাম আস্তে আস্তে পড়ার আলমারি খুলছে। বার করে নিলো প্যাকেটটা! তারপর বাড়ির জামাকাপড় পরেই স্লিপার পরে পা টিপে টিপে দরজা খুলে বেরলো! অতসীও অমনি বারান্দার দরজার আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে, বাইরে নজর রাখল! বাদাম যেন দেখতে না পায়, যে ও নজর করছে! কোথায় চলেছে একা একা ক্লাস ফোরের ছোট্ট বাদাম? ভয়ে অস্থির অতসী! কিন্তু ওকে যেতে না দিলে কোনদিনই জানা যাবে না এই রহস্য! মুখ ফুটে কিছুতেই বলবে না বাদাম। খুব জেদ ঐটুকু ছেলের। অতসীদের ফ্ল্যাট বেকবাগানে। পার্কসার্কাসের খুব কাছে। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে চুপিচুপি নেমে এলো বাদাম। দারওয়ান গেটে আটকাল। তাকে কিছু একটা দিল বাদাম। কানেকানে কিসব কথা হল! ও মা! দারোয়ান অন্য এক সিকুরিটিকে গেট দেখতে বলে বাদামের সঙ্গে চলল! ওরে বাবা! দারোয়ানও এর মধ্যে আছে তাহলে! কোথায় চলেছে এরা! আজ এর শেষ দেখতেই হবে। মনে মনে বলে অতসী। রাস্তার ধার ঘেঁসে চলতে লাগলো দারোয়ান আর বাদাম! পিছন পিছন বেশ খানিকটা দূরে অতসী! ও মা! এ যে পার্ক সার্কাসের বস্তিতে ঢুকছে বাদাম! কতগুলো অর্ধউলঙ্গ ডিগডিগে বাচ্চা এসে ওকে ঘিরে দাঁড়ালো! হাতের চাল, আলুর প্লাস্টিক আর পিঠের ব্যাগ থেকে রঙিন একটা ছবির বই ওদের দিল বাদাম। ওদের মুখে স্বর্গীয় হাসি ফুটে উঠলো। খানিকক্ষণ ওদের সঙ্গে গল্প করে, চুপচাপ বাড়ির দিকে ঘুরল বাদাম আর দারোয়ান। তাড়াতাড়ি একটা দোকানে ঢুকে দাঁড়াল অতসী। চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই কখন ঝরঝর করে জল পড়তে লাগলো! রহস্যের এমন সমাধান তার আশাতীত ছিল !
আয়ুস্মিতা সামন্ত। নার্সারী।
সরস্বতী শিশু মন্দির। মেদিনীপুর
উৎসব মরশুমে আমেরিকাতে বাসবদত্তা কদম

পর্ব ১৩ ব্রডওয়ে সিনেমা পাড়া পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম রকফেলার সেন্টারের দিকে। প্রবাদ আছে শুনেছি রকফেলার সেন্টারে না গেলে নাকি নিউইয়র্ককে সঠিক ভাবে চেনা যায় না। এতদূর এসে নিউইয়র্ককে না চিনে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া এই অঞ্চলের অতি কাছেই রকফেলার সেন্টার। ঐ যে সেই ফিফটি ওয়ান স্ট্রিট ইত্যাদি বলছিলাম, সেখানেই এই বিশাল কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স। তাও নাকি একটি পরিবারের তৈরী। ভাবো তাহলে। শুনলাম রকফেলার পরিবার ১৯৩০ সালে এটি তৈরী করেন। রকফেলার পরিবার আমেরিকার বিখ্যাত ধনী পরিবারের একটি। বলা যায় আমাদের দেশের আম্বানি আদানি বা পুরনো দিনের টাটা বিড়লা। চারিদিকের উঁচু উঁচু বিল্ডিং দেখতে দেখতে আমার ঘাড় ব্যাথা। মাথা ঘুরিয়ে দেখি সেখানে এক বিশাল এলাকায় আইস স্কেটিং এ ব্যস্ত অজস্র মানুষ।
চিত্রগ্রাহক - বাসবদত্তা

না। না। ম্যানহাটান শহরে তখনো বরফ পড়েনি। তবে ঠান্ডা এসে গেছে তাই বরফ জমিয়ে স্কেটিং এর ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। বরফ গলবে না। রকফেলার সেন্টার তখনই বেশ সেজে উঠেছে ক্রিসমাসের সাজে। এই রকফেলার সেন্টার শুনলাম বিখ্যাত তার ক্রিসমাসের সাজানোর জন্য। সাজানো আর আইস স্কেটিং দুইই চলছে সমানতালে। অজস্র লোকজন আসছেন এখানে। সাজানো জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন তাদের পরিবারের সঙ্গে। পরে দেখেছি এই কমপ্লেক্স ছাড়া আরো বেশ কিছু জায়গায় আইস স্কেটিং চলছে। আমাদের গরমের দেশে এ জিনিস দেখা যায় না তাই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। বলা যায় পুরো শহর জুড়েই প্রাক ক্রিসমাস সাজগোজ চলছে। এই রকফেলার সেন্টারের আরেকদিকে দেখলাম কাঁধে পৃথিবী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এটলাস। সেই ভদ্রলোক দেখি পৃথিবী ঘাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন ওখানেই। দেখেই আমার ক্যামেরা জেগে উঠলো। একটা খিচিক। এটলাস বাবু বন্দী। এটলাসের গল্প তোমরা নিশ্চয়ই জানো। ভয় পেয়ো না! সে গল্প ফাঁদতে বসিনি আমি এখন, আমি এটলাস বাবুর ছবি তুলেই খুশি। এরপর সেই প্রবাদকে মনে রেখে এই বিল্ডিং এর মধ্যে খানিক ঘোরাঘুরি করে নিউইয়র্ককে চেনার চেষ্টা করলাম। এরপর আবার এগিয়ে চললাম লাইন ধরে আমাদের লিস্টের দিকে। যতগুলো সম্ভব টিক মার্ক করতেই হবে। 
এই রকফেলার সেন্টারের খুব কাছেই রয়েছে সেন্ট প্যাট্রিক্স চার্চ। বেশ প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন ম্যানহাটানের এই চার্চটি। ১৮৭৯ খৃষ্টাব্দ থেকে এর যাত্রা শুরু। 
আমরা যেদিন ঘুরে বেড়াচ্ছি, সেদিন সম্ভবত ছিল কোনো মাস প্রেয়ার। চার্চের চারপাশে গিস গিস করছে লোকজন।


স্বপ্ননীল পাত্র
সপ্তম শ্রেণি, রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাভবন
মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর।
স্মরণীয় দিবস।
জাতীয় বিজ্ঞান দিবস (২৮শে ফেব্রুয়ারী)
কলমে- দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে।

২৮শে ফেব্রুয়ারী দিনটি জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে পালন করা হয় ভারতে।
এই দিনটি বিজ্ঞান দিবস হিসেবে পালিত হয়, কারণ দেশ তৈরির পিছনে, দেশের অগ্রগতির পিছনে, দেশের বিজ্ঞানীদের ভূমিকার কথা মাথায় রেখে ২৮শে ফেব্রুয়ারী দিনটি পালিত হয়। এছাড়াও এই দিনটি পালনের জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে তা হল,২৮ শে ফেব্রুয়ারী ১৯২৮ সালে ভারতীয় পদার্থবিদ বিজ্ঞানী স্যার সি ভি রমন 'রমন এফেক্ট' আবিষ্কার করেন, সে জন্য ২৮ শে ফেব্রুয়ারী দিনটি 'জাতীয় বিজ্ঞান দিবস' হিসেবে পালিত হয়। 
তাঁর  এই আবিষ্কারের জন্য স্যার সিভি রমন ১৯৩০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।

এর ইতিহাস সম্পর্কে বলা যায় যে, ১৯৮৬ সালে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি কমিউনিকেশন(এন সি এস টি সি) ভারত সরকারকে ২৮ ফেব্রুয়ারী দিনটিকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে বলে। 
এই দিনটি এখন সারা ভারতে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এবং অন্যান্য একাডেমিক, বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত, চিকিৎসা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান  হিসেবে পালিত হয়। প্রথম NSD(জাতীয় বিজ্ঞান দিবস) উপলক্ষে (২৬ শে ফেব্রুয়ারী ২০২০সাল) NCSTC বিজ্ঞান ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে অসামান্য প্রচেষ্টার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এবং জাতীয় বিজ্ঞান জনপ্রিয় করণের জন্য পুরস্কারের ঘোষণা করে।
যেমন- ২০০৯ সালে জাতীয় বিজ্ঞান দিবসের বিষয়বস্তু ছিল, 'বিজ্ঞানের দিগন্তের প্রসার'
ওই বছরের দেশের মোট পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ভারতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা বিভাগ বিজ্ঞান প্রসারের জন্য জাতীয় পুরস্কার প্রদান করেন। এই পুরস্কার দেশে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ করা কিংবা এরকম ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি প্রদান করে,উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০৯সালে বিক্রম সারাভাই বিজ্ঞান কেন্দ্রকে বিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণা ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিভিন্ন কর্মশালা করার জন্য ওই বছরের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করা হয়।
এরপর ২০১০সালের জাতীয় বিজ্ঞান দিবসের বিষয়বস্তু ছিল, 'লিঙ্গ, সমতা, বহনক্ষম বিকাশের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি'
প্রত্যেক বছরই এটি উদযাপনের সময় বিজ্ঞানের এক একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। ২০২১ সালের আলোচ্য বিষয়বস্তু ছিল, 'ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ শিক্ষায় দক্ষতা ও কাজের উপর প্রভাব'। ঐ বছরই 'রমন এফেক্ট' আবিষ্কারক স্যার সিভি রমন স্মরণে কলকাতা বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড টেকনোকলজিক্যাল মিউজিয়াম 'ক্যারেক্টারইসিং কালার; স্যার সিভি রমন এন্ড ওয়ার্ক' নামক তথ্যচিত্রটি প্রকাশ করে।

যে 'রমন এফেক্ট' আবিষ্কারের জন্য এই দিবসটি পালন করা হয়, সেই 'রমন এফেক্ট' সম্পর্কে একটু জেনে নিই,
রমন এফেক্ট  হল, ফোটন কণা সমূহের অস্থিতিস্থাপক বিকিরণ। 
১৯২৮ সালে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমণ এবং তাঁর ছাত্র কে এস কৃষ্ণান তরল পদার্থে 'রমন এফেক্ট' আবিষ্কার করেন। চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমণের নাম অনুসারে আবিষ্কার টির নাম হয় 'রমন এফেক্ট'। এরপর ১৯২৩ সালে অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ অ্যাডলফ স্মেকাল তাত্ত্বিকভাবে প্রভাবের বর্ণনা করেন।

যাইহোক, ১৯৯৯ সালে আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি তরল গ্যাস এবং সলিউডের সংশ্লেষ বিশ্লেষণের একটি সরঞ্জাম, তাৎপর্য,ও স্বীকৃতি হিসেবে 'রমণ এফেক্ট' কে একটি জাতীয় ঐতিহাসিক রাসায়নিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে মনোনীত করে।

প্রত্যেকটা দিবস উদযাপনের একটা উদ্দেশ্য থাকে, ঠিক সেরকমই এই দিবস উদযাপনেরও একটা উদ্দেশ্য আছে, তা হল, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিজ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। মানব কল্যাণের জন্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সমস্ত কার্যকলাপ, প্রচেষ্টা ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করা। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং নতুন প্রযুক্তি বাস্তবায়নের জন্য মূলত এটি উদযাপন করা হয়। এছাড়াও ভারতের বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিকদের সুযোগ দেওয়া এবং জনগণকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করে তোলা।

২৮ শে ফেব্রুয়ারী জাতীয় বিজ্ঞান দিবস উপলক্ষে স্কুল কলেজ সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও আলোচনার সমাবেশ করা হয়।

২০২৪ সালের জাতীয় বিজ্ঞান দিবসের থিম হবে-'শিক্ষিত ভারতের জন্য দেশীয় প্রযুক্তি' প্রচার করা এবং বিশ্বব্যাপী উদ্বেগগুলি মোকাবিলার সহায়তা করবে এছাড়াও বিজ্ঞানের মাধ্যমে ভারতকে আত্মনির্ভর করার উপর জোর দেবে।

Post a Comment

0 Comments