জ্বলদর্চি

অরূপ তোমার বাণী থুড়ি জীবনী/ (দশম পর্ব)/অরূপ পলমল


     

অরূপ তোমার বাণী থুড়ি জীবনী 

                  (দশম পর্ব)

                অরূপ পলমল 

নবমত: 

     আমার বাড়ির মতে - আমি নাকি আজকাল প্রচন্ড রেগে থাকি। অশান্ত!

তারই প্রতিফলন ঘটেছে সেদিনের তোর প্রতি লেখাতে। তুই তো মেয়েটা খুব শান্ত... কী এমন তোর লেখাতে বলেছিল? তোর প্রতি অত রাগের কী কারণ থাকতে পারে আমার? গুড!

      গান না। কবিতা! এবার...শেষে নয়- প্রথমেই শুনি ও পাঠ করি চল--

"আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,/মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,/ আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,/ আমি দুর্বার,/ আমি ভেঙে করি সব চুরমার!/ আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,/ আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!/ আমি মানিনা কো কোন আইন,/ আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!/ আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!/ আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব- বিধাত্রীর!"

##

কিরে? ঘুমিয়ে যাচ্ছিস না তো? ক্লান্ত হচ্ছিস না তো? চল তবে আরও একটু পড়ে নিই---

"আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’,

করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে  পঞ্জা,/ আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!/ আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রী/ আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর!"

... জানিস! এই লাইনগুলো গীতার চরণ! গায়ত্রী মন্ত্র! এই মন্ত্রে কুরুক্ষেত্র হয় না। হয় জাগরণ! আত্ম জাগরণ! হৃদয় কুসুম হয় প্রস্ফুটিত! সুবাসিত! আহ্. ..আহ্... একবার আমার সাথে গলা মিলায়ে দেখ… আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,/ আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!/ আমি মানব দানব দেবতার ভয়, বিশ্বের আমি চির - দুর্জয়,/ জগদীশ্বর - ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,/ আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ পাতাল - মর্ত্য!/ আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!/ আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!/ আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার/ নি ক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার! / 

       আমি হল বলরাম - স্কন্ধে/ আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।/ মহা - বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত / যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না - / অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ - ভূমে রণিবে না - / বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত।/…আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ- চিহ্ন/ আমি স্রষ্টা - সূদন, শোক- তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!/ আমি চির- বিদ্রোহী বীর -/ বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির।”

       দেখ! আচ্ছা দেখতে হবে না।              শোন...রাগটাই আমার প্রাণ। বাঁচিয়ে রেখেছে মোকে। যেদিন আমি আর রাগবো না... সেদিন আমি ফিনিস। শেষ! ডেড! স্টপ! ধরে নিবি... ভেবে নিবি... তোদের “স্যার” মরে গেছে। তার থেকেও বড় কথা আমি- ভাবি। ভাবতে পারি। ওই একটাই তো কাজ পারি।ভাবতে ভালোবাসি! একটু অন্য রকম...আর পাঁচ-দশ জনের থেকে একটু আলাদা-আর তো কিছু পারি না। সেই ছাত্র -জীবন থেকে এই একটাই তো পারি ভাবতে - আর আজ...বিশ্বাস কর...মোর যত কিছু সাফল্য সবই এই-- একটুকুরো অন্যরকম ভাবনার জোরেই। ওই বসে বসে ভাবি আর বসে বসে রাগ-ই। যেখানে সেখানে যার তার উপর উগরে দিই। আমি তো আর নীলকণ্ঠ না যে- বিষটা কণ্ঠে ধারণ করে নেবো। হজম করতে না পারলে তখন কামড় দিই। এক ছোবলেই... হা হা হা!

       এই ভাবে জানি একদিন..... 

ভা.... ব..... তে..... /ভা…ব…তে…/রা…গ... তে…রাগ…তে…/র...আগ..... তে....বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবো।  তাতেও কোন দুঃখ নেই। সেদিন তো তোর "মোটু ভাইটা" আছে তো রে… মেডিসিন দেবে আমায়....আমার চিকিৎসা করবে। ওর 'মেডিক্যাল কোর্স'টা শেষ হয়ে যাক সুন্দর ভাবে। তারপর উন্মাদ হতে আর কোন বাধা নেইক। হাসতে হাসতে মুই এরকম শত শত বার উন্মাদ....বদ্ধ উন্মাদ হতে প্রস্তুত। এই ভরসায় আছি ও ভাবছি। আরও ভাবতে থাকছি.....আর কান পাতছি .... সুরে .... সুরে …

"নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল,

বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল- 

নীল  দিগন্তে মোর বেদনখানি লাগল,

অনেক কালের মনের কথা জাগল।

এল আমার হারিয়ে-যাওয়া কোন্‌ ফাগুনের পাগল হাওয়া।/ বুঝি এই ফাগুনে আপনাকে সে মাগল,/ সর্ষেক্ষেতে ঢেউ হয়ে তাই জাগল॥"

                        ##

দশমত :

         দুটো গল্প শোনাই। তোকে। তখন আমি জ্যান্ত বেকার! সদ্য ইউনিভার্সিটি    -পাস করেছি। তাও নাই নাই করে কুড়িবছর পূর্বে- মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ি যাই। যেতে হয়। বাবা - মা তখনও ওখানেই থাকেন। আমার গ্রাম ঘোষপুর। কেশপুর! পশ্চিম মেদিনীপুর। কেশপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে দশ কিমিঃ ভিতরের গ্রাম। সম্বল একমাত্র ট্রেকার একটি। না হলে পদব্রজে! হাঁটি হাঁটি পা পা…

         অফিস টাইমে একটা সিডিউল  ছিলোই ট্রেকারটার। তাতে বেশ কিছু আমাদের গ্রামের স্কুল - এর ম্যাডামরা যাতায়াত করতেন। সাথে আমরাও যেতাম - আসতাম। বিকালের ঠিক ফেরার টিপ ছিলো বিদ্যালয় ছুটির পর। আমিও সেই ট্রেকারে ফিরতাম গ্রামের বাড়ি হতে।

কিন্তু বড্ড অস্বস্তি হতো। ওই স্কুল  শিক্ষিকাদের সাথে ফিরতে। তখন তো আর হেডফোনের যুগ ছিলো না। তাই কানে  চিবোতে হতো অনেক কিছু। হজম শক্তির বাইরে গিয়ে… ওই ম্যাডাম গুলোর কথাবার্তায় প্রায় এমনটাই সব সময় যে - বাকিদের বুঝিয়ে দিতো যে তারা ম্যাডাম... শিক্ষিকা...কর্মক্ষেত্র থেকে কাজ সেরে ফিরছেন। আর মুখ বন্ধ করতো না কখনো। যেন আমাদের মানে বাকিদের বুঝিয়েই দেওয়াটাই ছিলো তাদের একমাত্র কাজ।  আমাদের মস্তিষ্ক - এর ঠিকা নিয়ে বসেছিল। 

🍂

কোন কথাই তারা নিজেদের মধ্যে গলার স্বর নামিয়ে করতো না। সবাইকে শ্রোতা বানিয়েই ছাড়তো। তবেই তারা সেটিস্ফাইড! জানি না - এদের এতো এতো কিসের প্রচার দরকার হয়? কেনো? কে জানে? ফাঁপা ফাঁপর ঢেঁকির দল! আমিও কিছুদিন পর ওই অফিস টাইমের বাস ও ট্রেকার ধরা ছেড়ে দিয়েছিলাম। বদহজম! কান ও মন ও মস্তিষ্ক বাঁচাতে…

      দ্বিতীয় গল্প - ট্রেনে গড়বেতা ডেলি জার্নির এক ঝলক! দেখাচ্ছি! আমি শোনাবো কিন্তু তুই দেখতে পাবি... খেয়াল করো... আগেই বলেছি-তোদের স্কুল-এ যাওয়ার পূর্বে দু -বছর আমি গড়বেতা কলেজে পার্ট -টাইমার হিসেবে কাজ করতাম। ফলস্বরূপ - মেদিনীপুর থেকে "হাতিয়া" বা "আরণ্যক" ধরতাম। 

 অনেকেই যেতাম। প্রায় সত্তর জন পার্ট -টাইমার ছিলাম। হইহই- রইরই করে যেতাম -আসতাম। জীবনের সব থেকে উজ্জ্বল "বন্ধুত্ব পর্ব" ছিলো আমার ওটাই। কারণ ওখানে কোন নিদিষ্ট সাবজেক্ট ছিলো না...  সব সাবজেক্ট ছিলাম...নয়তো  একটা 'কমন সাবজেক্ট' তো ছিলোই - 'জ্যান্ত বেকার '!

        ট্রেনের আগে স্টেশন পৌঁছলে গ্রুপেই যেতাম। অনেকজন একসাথে। হাসতে হাসতে - খেলা দেখতে দেখতে। বিচিত্র গল্প - গুজব করতে করতে। গুনগুন ভোমরার দল– 

“”গুনগুন মন ভ্রমরা
কোথা যাস কিসেরই ত্বরা
কেন আর মিছে এফুল সেফুল করা-
আকাশে রং ধরেছে
নদী দুই কূলে ভরেছে
এসেছে দারুণ ফাগুন আগুন ভরা।।

     লাল লাল পলাশের বনের ডাক শুনে কি
দিন দিন রজনী ছিলে কাল গুনে কি
হায়রে তোর বকুল শিমুল পারুল মরেছে
নীল নীল রঙ পারিজাতের পাপড়ি ঝরেছে
এবার যে তোর সময় হল ঘরেতে ফেরার।      গুন গুন গুঞ্জনের নেশায় সব ভুলেছ
দোল দোল দোলনায় দ্যোদুল দোল দুলেছ
এমনি দিন আর ক’দিন বাদ যাবে না
টলমল মল ফুলের মধুর সাধ পাবে না
সময় তখন হবে দু’চোখ ভরে যে কাঁদার।।””   – ট্রেন আসার পর স্টেশনে পৌঁছলে যে কোন কামরায় লাফ দিয়ে উঠে পড়তে হতো । ফলে সেদিন দল ছাড়া। ঘটনাগুলো সেদিনই ঘটতো। দ্বিতীয় গল্প আরও বেশি জমাটে! একটু পরেই আসছি! জল খেয়ে… আপনি যাবেন না কিন্তু! ওয়েট… 

॥ ॥ ধারাবাহিক / একাদশ পর্ব / পরবর্তী অংশ বিরতির ॥॥ 

সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments