জ্বলদর্চি

কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা : চরৈবেতি জীবনের ধারাভাষ্য /আবীর ভট্টাচার্য

কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা : চরৈবেতি জীবনের ধারাভাষ্য  
আবীর ভট্টাচার্য 


There is no Frigate like a Book
To take us Lands away
Nor any Coursers like a Page
Of prancing Poetry … লিখেছিলেন এমিলি ডিকিনসন। 

সম্প্রতি হাতে আসা "কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা" বইখানির দিকে তাকিয়ে সর্বপ্রথম এই কথাটিই মনে পড়লো। 

স্নিগ্ধ ধূসর আবহে এলোমেলো নামসূচক অক্ষরগুলি সাজানো, সহজ সুরে গভীর কথা উচ্চারণের সংযত বিলাসিতায়। প্রকাশক আনন্দ প্রকাশনা, প্রচ্ছদ অলঙ্করণে দেবাশীষ সাহা। স্বাভাবিক ভাবেই অঙ্গসজ্জা যথেষ্ট রুচিশীল এবং যথাযথ। তবে যে কোনও বইয়ের প্রধান আকর্ষণ নিহিত থাকে তার বিষয়বস্তুতে; বিশেষত কাব্যগ্রন্থটি যদি কোন প্রিয় কবির রচনা হয়, প্রত্যাশা বাড়ে। 

বইয়ের লেখক ঋত্বিক ত্রিপাঠী, একজন সংবেদনশীল সম্ভাবনাময় কবি। তাঁর সম্পর্কে যে কথাটি না বললেই নয়, আলোচ্য কাব্যগ্রন্থটির কবি দীর্ঘদিন, প্রায় ত্রিশ বছর ধরে সম্পাদনা করে চলেছেন একটি লিটল ম্যাগাজিন, সুদূর মেদিনীপুর থেকে; যেখানে শঙ্খ ঘোষ, পবিত্র সরকার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে অধুনা মননশীল পাঠকপ্রিয় সন্মাত্রানন্দ সহ খ্যাত-অখ্যাত লেখক কবিরা নিয়মিত লিখে থাকেন। অর্থাৎ বর্তমান সাহিত্য প্রবাহের ধারা সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত হয়েও তিনি এমন অদ্ভুত নামের কবিতা পুস্তক প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলেন, তাও আবার এমন নামী প্রকাশনা সংস্থার মাধ্যমে; সেকথা ভেবেই মনে এলো ডিকিনসনের উদ্ধৃতিটি। 

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

যাইহোক, ঝকঝকে ছাপাই, উত্তম সজ্জার আয়োজন, সুন্দর কাগজের হার্ডবোর্ড বাইন্ডিং…. উল্টে পাল্টে প্রবেশ হোক এবার অন্দরে; আসি কাব্য আলোচনায়। 
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, ‘কীলক লিপি’ হলো প্রাগৈতিহাসিক সেই সুমেরীয় লিপি, ছোট্ট ছোট্ট তিরফলার মতো বর্ণ আকারের জন্য এর নাম কিউনিফর্ম বা কীলক লিপি। এই কাব্যগ্রন্থের চল্লিশটি কবিতাও যেন এক একটি তিরফলা, যা কখনও উন্মুক্ত করে, কখনো নির্দেশ হানে আমাদের চেতনা এবং মননে। যেমন ধরুন,  প্রথম কবিতা ‘আত্মস্বীকার’-এর অমোঘ উচ্চারণ, 
“বিরতিচিহ্নের মতো আগলে রাখি
কিছু ভালোবাসা গোপন, গোপন রাখা ভালো
… … … … . 
আমাদের আত্মস্বরূপ চিরকাল দুহাতে ঢেকে রাখা।” 

আবার, ‘আশ্চর্য নততল’-এর ‘আনন্দ ভৈরবী’তে মজে থাকা কবি-হৃদয় দ্বিখণ্ডিত বেদনায় জীবনকে ব্যাখ্যায়িত করেন,
“জীবন! কখনো মিলবে না জেনেও যাত্রা… “

অতল ভালোবাসায়, নির্মোহ দৃষ্টিতে কবি জীবনকে দেখেছেন, ব্যস্ত জীবনের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আন্দোলন যদিও তাঁকে বিদ্ধ করেছে, মানুষের দীনতায় আহত হয়েছেন, বিশ্বাস হারাননি। তাই হয়তো তাঁর কলমে উঠে আসে, 
“নীরবতার ভাষাপথ পেরিয়ে জ্ঞানশূন্য নির্বেদে
কেউ বা পাশে এসে বসে। চিত্রাঙ্কিত। বলে;
কোন মানুষকেই গভীরভাবে নিও না। নিতে গেলে
আত্মা মরে যায়। মানুষ তো মানুষই!”

কী ঋদ্ধ জীবনবোধ! মুগ্ধ হই, উল্টে চলি পাতার পরে পাতা…। চোখ আটকে যায় আবার ‘বিস্ময়চিহ্ন’ কবিতাটিতে, যেখানে  লেখা আছে, 
“চমস্কি জানে দ্বন্দ্ব পরিণাম অন্যদিকে আনন্দবর্ধন
ধ্বনি না রস কোনটি হবে কাব্যের আত্মা! 
অবয়ব সংস্থানও চাই নির্দোষ
মসৃন ত্বকেই মগ্ন গঠন ও প্রতিভাষ
ধর্মান্তর হওয়ার আগে বদলে যায় ব্যঙ্গ অলঙ্কার…"

বুঝতে পারি খানিক, কেন এমন অদ্ভুত নামকরণ কাব্যগ্রন্থটির, বর্তমান বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে অবস্থিত হয়েও ‘নিষিদ্ধ চারণভূমি’ সেঁচে তিনি  চিরায়ত মানুষের কথাই বলেন, মানুষের কথাই ভাবেন। মানুষই তাঁর প্রিয় পূজ্য ভূমা… 
তাই আসে উচ্চারণ—
“যা পূর্বধ্বনিত কীলক লিপিতে, শেষপালা রাধাবিরহ
নিষ্প্রয়োজন ‘খণ্ড’ লেখা। গৌণ ব্যক্তি, নক্ষত্র প্রলাপ
ভূর্জপত্রে লেখা থাকে সমাসবদ্ধ রোদনের গান”...! 

সবশেষে এটুকুই বলার, কবিতাগুলিতে আক্ষেপ আছে, অশান্তি আছে, দ্বন্দ্ব আছে। একজন মননশীল পাঠক হিসেবে জানি, এই ধ্বস্ত যাপনে তা থাকবেই। তবু আখর আধারে, ছন্দ আদরে যখন তা সুসজ্জিত হয়, দলে, বৃত্তে, বর্ণে দোলা দেয় সৃজনভূমিতে, তা উত্তরিত হয় ভূমা সম্পৃক্ত আনন্দবোধে। এবং এই কঠিন কাজটিই কবি সম্পন্ন করেছেন তাঁর মেধা নিষিক্ত রচনাগুলিতে। 
ব্যতিক্রমী শব্দবন্ধের ব্যবহারে(না ব্যাকরণ না পূর্ণেন্দু, প্রেরক প্রাপকের সমস্বর, মগ্নগঠন প্রতিভাষ, হরিণ আবেশ, চন্দ্রাবতী নদী, অবশ্যম্ভাবী ত্রিভুজ … ইত্যাদি, ইত্যাদি), বিভিন্ন কবিতার ছত্রে ছত্রে ভিন্ন ভিন্ন ছন্দ ব্যবহারে তাঁর ভাষার ওপর দখল যেমন চেনা যায়, তেমনই পাঠক খুঁজে পায় এক আধুনিক কবিকে। আমার মতে কবিতা ছন্দ, অলঙ্করণের আবরণ পেরিয়ে এক নিজস্ব অর্থকে খুঁজে পেলে তবেই সাফল্য পায়। ঋত্বিকবাবুর কবিতা স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত সকল ছন্দেই যেমন সাবলীল তেমনই তাঁর প্রতিটি লেখায় ব্যঞ্জনাও সুস্পষ্ট।

কবি তো নিজেই তাই ঘোষণা করেছেন তাঁর লেখা বিপ্রতীপ। একদিকে সকল আকর্ষণকে ছাড়িয়ে পালানোর প্রবল আকুতি, "দাবানলের আগেই তো চেয়েছিলাম পালাতে/ নামিয়েছিলাম, পারিনি সরিয়ে নিতে চোখ", আবার অন্যদিকে রয়েছে সমাজের প্রতি এক প্রবল দায়িত্ববোধ, "মাটির কনুই নিয়ে অভিযোজনের দীর্ঘ স্কন্ধ/ সমবায় প্রাচুর্যে রক্ষিত হচ্ছে আত্মতুল্য অনুকম্পা…"। কবির এই শতবৈচিত্রময় কাব্যের ডিসেম্বর কবিতাতে ফুটে উঠেছে অন্য এক নির্জনতার সুর। "অভিমানেই শত গদ্য পদ্যমুখী" হয়ে ফুটে উঠেছে এই কবিতায়। এই ব্যস্ত সময়ের শত কবির মাঝে বসেই তিনি যে নির্জনতার কথা বলেছেন তাও ছুঁয়ে যায় পাঠকহৃদয়। আর এই কবিতাতে ভর করেই কবি উড়ে চলেন, "পৃথিবীর অন্য অন্য বাংলা ভাষার আকাশে"। 

এভাবেই ঋত্বিকবাবুর এই কাব্যগ্রন্থে আরও কত যে গুপ্তধনের সুরেলা বার্তা লুকিয়ে আছে ইতস্তত! এবং প্রচলিত ছন্দ ভেঙে, নতুন ছন্দ গড়ার সে ছন্দনিক্কন তাঁর কবিতাপ্রেয়সীর রাতুল চরণে সুমধুর সুরে বেজেছে, অনন্তের বাঁশির মতো, চন্দ্রাবতীর সাধনার মতো। 
এই সব কৃৎকৌশল হয়তো বিজ্ঞমহলে তাঁর কবিকৃতির মাইলফলক হবে, তবে আমরা, তাঁর লিখনমুগ্ধ সাধারণ পাঠককুল কাব্যগ্রন্থটিকে মনে রাখবো তার অন্যধারার গ্রহণযোগ্যতার জন্য।

আশা করবো, দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝে গোগ্রাসে গেলা নয়, বিজনে, তুমুল ক্লান্তিদিনে এই কাব্যগ্রন্থটি সঙ্গী হোক আমাদের, আপন সুধানির্ঝরে তৃপ্ত করুক সংবেদনশীল মনোভূমি ও ভূমা। এবং অবশ্যই নিজস্ব গৌরবে পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠুক বইটি। কবিকে অন্তহীন শুভেচ্ছা। 

কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা / ঋত্বিক ত্রিপাঠী
প্রচ্ছদ: দেবাশীষ সাহা
সিগনেট প্রেস/ মূল্য –২৫০/-


Post a Comment

0 Comments