সব্যসাচী বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ থেকে ১৭ বছর আগের কথা। ২০০৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। একটি প্রথমশ্রেণীর দৈনিক সংবাদপত্রে খুব বড় বড় করে লেখা হল ' শতাতু পদীপিসী '। আমাদের ছোটোবেলার বেশ কিছু সোনালী মুহূর্তের যিনি সাক্ষী সেই লীলা মজুমদার শতবর্ষে পা দিয়েছিলেন সেদিন। শিশু সাহিত্যের স্বর্ণযুগের প্রথম লগন থেকে শুরু করে মোটামুটি ১৯৯৫-১৯৯৬ সাল অবধি তাঁর লেখনী ছিল সক্রিয়। তাঁর লেখাতে কখনও দুরন্ত কৌতুক বিদ্যুৎ ঝলকের মত ঝলসে উঠেছে আবার কখনও বুদ্ধিদীপ্ত বর্ণনায় নিজেকে শাণিত করে নেওয়া যায়। একজন জীবিত সাহিত্যিকের শতবর্ষ উদযাপন খুবই বিরল ঘটনা। কিন্তু ২০০৭ সাক্ষী হয়েছিল সেই মূল্যবান মুহূর্তের।
সেদিন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তিনিই আলোচ্য বিষয়। কখনও তিনি শান্তিনিকেতনের অধ্যাপিকা, কখনও 'সন্দেশ' পত্রিকার সম্পাদিকা, কখনও আকাশাবাণীর দায়িত্বশীলা আধিকারিক। এসব কিছু ছাড়িয়েও তিনি শিশুসাহিত্যের এক সুবিশাল সাম্রাজ্যের চিরন্তন অধীশ্বরী যাঁর জাদুকলমের সোনার পরশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম আলোকিত হয়ে রয়েছে। কলকাতার অনেক সুধীজন লীলা মজুমদারের শতবর্ষে পদার্পণের দিনটিতে বারংবার বলেছিলেন যে আমাদের হয়তো অনেক কিছুই নেই কিন্তু আছেন লীলা মজুমদার যা আমাদের অহংকার।
🍂
১৯৮৬ সালের কলকাতা বইমেলা। তখন আমি বিদ্যালয়ের ছাত্র। মা আর বাবার সঙ্গে গিয়েছি কলকাতা বইমেলায়। সেই বছর এডগার রাইজ বরোজের টারজান নিয়ে পুরো লেখাগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছেন লীলা মজুমদার। বইমেলায় সেই বই হট কেক। মৌসুমী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সেই বই। মৌসুমী প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নের বাইরে রাখা একটি টেবিলে সাজানো রয়েছে অনেকগুলি বই। সেই বইএর মাঝে একটি চেয়ারে বসে আছেন এক বৃদ্ধা। গায়ে কালো শাল,মাথার চুল ছোটো করে কাটা,চোখে চৌকো কালো ফ্রেমের চশমা।
- উনি লীলা মজুমদার। প্রণাম কর।
মা বললেন আমাকে। কাছে গিয়ে প্রণাম করতেই আমার গালে হাত দিয়ে নাম জিজ্ঞাসা করলেন, কোন ক্লাসে পড়ি জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বাড়িয়ে দিলাম আমার অটোগ্রাফের খাতা। সুন্দর হস্তাক্ষরে আমার অটোগ্রাফ খাতার পাতা ভরে উঠল। সেদিন আমার শিশুকালের স্বপ্নের যাদুকরীর সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য হয়েছিলাম।
মনে আছে ছোটোবেলায় যত বই কিনেছি তার সিংহভাগ জুড়ে ছিল লীলা মজুমদারের বই। ' গুপী পানুর কীর্তিকলাপ' ,' আজগুবি',' ' পদীপিসীর বর্মীবাক্স', ' টংলিং' ' সব ভুতূড়ে', ' বাতাসবাড়ি', ' কাগ নয়' বলে শেষ করা যাবে না। নিকুঞ্জের ন্যাকামি, সমাদ্দারের চাবি, অহিদিদির গল্প, পিলখানা, বকবধপালা, হলদে পাখির পালক, বদ্যিনাথের বড়ি, আমার আমি হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। বাংলা সাহিত্যে ' আর কোনোখানে ' বা ' পাকদন্ডী' র মত আত্মজীবনী খুব কমই আছে। 'খেরোর খাতা ' র মত একটি আদ্যন্ত রম্য বই পড়ে মনে হয় যেন চোখের ওপর ছবি দেখছি। ছোটো ছোটো ঘটনাকে কিভাবে জীবন্ত করে উপস্থাপিত করা যায় তা লীলা মজুমদার তাঁর কলমে করে দেখিয়েছেন। এখন প্রকৃত শিশুকিশোর সাহিত্যর অভাব। শিশুদের জন্য লেখাতে সবাই দড় হন না। লীলা মজুমদার পারতেন অনায়াসেই ছোটোদের মত হয়ে তাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করে তাদের জন্য লিখতে। সেইজন্যই তিনি আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
আজ তাঁর জন্মদিনে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম। ভাবতে ভালো লাগে ২০০৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অনেকের সঙ্গে আমিও প্রত্যক্ষ করেছিলাম শিশুসাহিত্যের সুবিশাল সাম্রাজ্যের অন্যতম অধীশ্বরী এই সাহিত্যিকের শতবর্ষে পা দেওয়ার সেই মুহূর্তটিকে। আমি লীলা মজমুদারকে সামনাসামনি দেখেছি। আমার সামান্য জীবনে এ আমার পরম প্রাপ্তি।
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments