তনুশ্রী ভট্টাচার্য
ভ্যালেন্টাইন ডে স্পেশ্যাল
ফরাসী প্রেমের সুগন্ধ
(গতকালের পর)
বালজাক লিখতে বসতেন রাত বারোটায়।প্যারিস তখন নিদ্রিত নিস্তব্ধ।বাড়িতে তিনি একা। নিস্তরঙ্গ। কোলাহলহীন।লিখতে লিখতে আঙুল অবশ হলে নিজেই উঠে বানিয়ে নিতেন কড়া কফি। প্রিয় পানীয়। কফি এবং কলম ---অচ্ছেদ্য বন্ধন বালজাকের ।
দিনের আলো ফুটলে শুরু করতেন কেজো কিছু কাজ। খুব প্রয়োজনীয়। আর কাজ শেষে শুরু হতো জাঁকজমকপূর্ণ বিলাসিতা উচ্ছৃঙ্খল জীবনধারা। লোকে বলাবলি করত---দ্য গ্র্যান্ড মোগল স্টাইল অফ লাইফ।দুটি বিপরীত মানুষ দিনে আর রাতে। দিনের টার সমালোচনা হত। রাতের কাব্যলক্ষীর সাধনা থাকত সকলের অগোচরে। এই সময়ে বালজাক চাইতেন কেউ তার সংসারের ভার নিক। কিন্তু তার উপন্যাস পড়ে শত শত তরুণী হেসেছে,কেঁদেছে, প্রণয়লিপ্সায় মাতোয়ারা হয়েছে কিন্তু ঔপন্যাসিকের মেটেনি প্রণয়পিপাসা। কোনো তরুণী এগিয়ে আসেনি। সম্ভবত বালজাকের লাবণ্যহীন চেহারায় চাষাড়ে ছাপ এজন্য দায়ী।
না ,কেউ আসবে না এতো হতে পারে না। এল একজন । সশরীরে নয়। চিঠির মাধ্যমে। সে অভিজাত গৃহিনী ইভলিন। বালজাকের সৃষ্টির আবিষ্ট পাঠিকা। চিঠিতে চলে সাহিত্য আলোচনা। সাহিত্য থেকে জীবনের বন্দর। জীবন থেকে প্রেমের অন্দর। আঙুরলতার মতো লতিয়ে চলল সে সম্পর্ক। আর এই চিঠিগুলো রয়ে গেল ফরাসী সাহিত্যের সেরা পত্রসাহিত্যের মর্যাদায়। আজো। একবছর পরে তাদের দেখা হলো। আজকের ভাষায় ডেটিং। জেনিভায়। ইভলিনের শবরীর প্রতীক্ষা শেষ হবার পথে। বালজাক পথ চেয়ে আছেন। কাঙ্খিত সময় এগিয়ে এলো। মুহুর্ত বিলীন হল চিরকালীনে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
দুজনের মুখোমুখি বসিবার মাহেন্দ্রক্ষণ।গোপন সাক্ষাৎ। শিহরণ উত্তজেনায় বালজাক যেন নব্য কিশোর। ওদিকে ইভলিনের মধ্যে গৃহিনীপনার লেশমাত্র নেই। যেন সদ্য ফোটা গোলাপ। কিন্তু হায়!গল্পের যাদুকরের প্রত্যক্ষ রূপ দেখে হতাশ হলো ইভলিন। স্বপ্ন আর বাস্তবে র বিস্তর পার্থক্যে ইভলিন মুষড়ে পড়লেন। বালজাকের চেহারা অত্যন্ত নীরস। আকর্ষণহীন। তবুও ।তবুও। প্রেম কবে দৃষ্টিতে বাধা পায়?মন দেওয়া নেওয়া আগেই হয়েছিল এখন এল শরীরের বিনিময় পালা। আর ইভলিন সাহিত্যিকের সাহচর্য পাবার লোভ কেনই বা ছাড়বে?
বুঝহ মন যে জান সন্ধান।
সুতরাং সন্ধান চলল সেই সন্ধিক্ষণের ।কবে তাদের স্থায়ী মিলন হবে!!
হলো মিলন। অনেক অনেক দিনের পরে। আল্পসের সানুদেশ থেকে যখন ঝর্ণা বয়ে গিয়ে পড়ে সীন নদীর কুলে। যখন প্যারিস মিউজিয়ামে ঘনিষ্ট সন্ধ্যা কাটায় এক নতুন কপোতকপোতী। রাতের তারারা রাজী হয় এই দুজনের মিলনে সাক্ষী থাকবে বলে।ঠিক তখন ।তখনই তাদের বিয়ে হলো। ইভলিন পঁয়তাল্লিশ।বালজাক একান্ন। আর দুজনেই তখন জীবনের পথ চলে চলে ক্লান্ত অবসন্ন। তবে বালজাকের সৃষ্টি থেমে নেই।কলম দুর্বার গতিতে চলছে। চলছে নতুন সংসার হোঁচট খেতে খেতে। প্যারিসে নতুন বাড়ি। নতুন সংসার। বালজাক ভেবেছিলেন তার সংসার সৃষ্টি স্বাস্থ্য সব --সব দেখভাল করবে ইভলিন। কিন্তু Man proposes ,God disposes.অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে কে কবে লড়তে পেরেছে। হারা জেতা সব নির্দিষ্ট।ইভলিনের মধ্যে সে উৎসাহ স্তিমিত এখন।
সে রাতে বালজাক যখন নিজের নতুন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ইভলিনকে নিয়ে বাড়ি ভিতর থেকে বন্ধ। শত ডাকাডাকিতেও সে দরজা খুলল না কেউ। দরজা ভেঙে ঢুকে দেখা গেল ভৃত্যটি পাগল হয়ে সারাবাড়ি ঘুরছে। শেষের শুরুর ইঙ্গিত?
ধীরে ধীরে বালজাকের জীবনের দরজা বন্ধ হয়ে এলো। খুলে গেল মৃত্যূর দরজা। ১৮৫০সালের ১৭ই আগষ্ট। বালজাক শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলেন। ইভলিন জানতেও পারলেন না। তিনি অনেক আগেই নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছেন।
শুধু সেই দীনহীন রাতে শীর্ণকায়া এক মহিলা বালজাকের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে। নিণির্মেষ নেত্রে চেয়ে আছেন মৃত্যুআলিঙ্গনকারী অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক বালজাকের দিকে। জীবনে যাঁর স্নেহ পাননি মৃত্যূর পাশে তাঁর শোকাচ্ছন মূর্তি দেখে বালজাকের ঠোঁটের কোণে শান্তির হাসি ছিল কি না তা আর জানা যায় নি। তিনি আর কেউ নন------বালজাকের মা।
এই প্রণয় পক্ষে বালজাক --বার্ণির অসমবয়সী প্রেমের কাছে,,বালজাক --ইভলিনের মোহভঙ্গের প্রেমের কাছে নতিস্বীকার করতে হয় বৈ কি!!!যে প্রেম প্রণয়, প্রতীক্ষা,পরিতাপ --সব মিলে তৈরী করেছে ফরাসী সাহিত্যের দরবার। বিশ্ব সাহিত্যের বারান্দায়
বিছিয়ে দিয়েছে ফরাসী প্রেমের সুগন্ধ।।।
আসুন এই বসন্তে আঁচলে বেঁধে রাখি নয়তো বুকপকেটে সাজিয়ে রাখি সে প্রেমের নির্যাস। প্রণয়পক্ষে এক দুরন্ত প্রণয় কে সাক্ষী রেখে।।।।।
(চলবে)
0 Comments