জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতেপ্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব/বৃন্দাবনের দোল / দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী / একবিংশতি পর্ব

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
বৃন্দাবনের দোল 

লেখক - দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী              
একবিংশতি পর্ব

বিকেলে পুনরায় আমরা বেরিয়ে প্রথমে গেলাম কালীয় দমন ঘাট থেকে একটু দূরে যমুনার তীর থেকে প্রায় ৫০ ফুট উঁচুতে আদিত্য টিলার মদনমোহন মন্দির দেখতে। কথিত আছে কালীয়নাগকে দমন করার পরে শ্রীকৃষ্ণ এখানে এসে বিশ্রাম করেছিলেন। সিঁড়ি ভেঙে মন্দির চত্বরে উঠতে হবে। উত্তর দিকে নাট মন্দিরের ধারে লেখা রয়েছে 'সম্বত ১৬৮৪ বর্ষ, শ্রাবণ'। চত্বর পেরিয়েই প্রাচীন পাথরের সুবিশাল মন্দির। দুদিকে সিঁড়ি, লাল পাথরের দেয়ালে সুন্দর কারুকার্য করা। সংস্কার না হওয়ায় মন্দিরটি জীর্ণ, তাহলেও মন্দির তোরন ও চূড়াটির অলঙ্করন আকর্ষণীয়। পাশেই নতুন মন্দির তৈরি করা হয়েছে। কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে মন্দির চত্বর, তারপরে একটি ছোট নাটমন্দির ও তারপরে গর্ভমন্দির। গর্ভমন্দিরের সিংহাসনে মদনমোহনজীর প্রতিনিধি বিগ্রহ, কেননা আদি বিগ্রহ রয়েছে রাজস্থানের করৌলীতে। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে জমিদার নন্দকুমার বসু এই নতুন মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন। দিল্লীর ধর্মান্ধ সম্রাট ঔরঙ্গজেব বৃন্দাবন আক্রমণ করার পরে বৃন্দাবনের অন্যান্য বিগ্রহের সাথে মদনমোহনজীর প্রাচীন বিগ্রহকে জয়পুরের মহারাজা জয়পুরে নিয়ে যান। পরে মহারাজার শ্যালক করৌলীর মহারাজা গোপাল সিং মদনমোহনজীর ওই বিগ্রহ নিজের রাজ্যে নিয়ে যান এবং সেই থেকে মদনমোহন করৌলিতে রয়েছেন। মদনমোহনের প্রাচীন সুবিরাট ভগ্নমন্দিরে শ্রী নিতাই গৌরের বিগ্রহ রয়েছে। মন্দিরটির উচ্চতা ৪৪ ফুট, নাট মন্দির ৫৭ ফুট লম্বা, কুড়ি ফুট চওড়া এবং ২২ ফুট উঁচু। নাটমন্দিরের ছাদ নেই। কারুকার্য সমন্বিত দেওয়াল, গম্বুজ ও চূড়া। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে মথুরার কালেক্টর মিস্টার গ্রাউস গোবিন্দমন্দিরের মতো এই মন্দিরটিরও যথাসাধ্য সংস্কার সাধন করেছিলেন। এই মন্দির স্থাপনের পিছনে একটি ঘটনা আছে সেটি না বললে মন্দিরটির ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।     
🍂
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব শ্রীরূপ গোস্বামীর সাথে শ্রীসনাতন গোস্বামীকে বৃন্দাবনে পাঠিয়েছিলেন লুপ্ত তীর্থগুলি উদ্ধারের জন্য। লুপ্ত তীর্থ উদ্ধারের নির্দেশ পেয়ে সনাতন গোস্বামী তীর্থস্থান এবং তীর্থ বিগ্রহের আবিষ্কার করার চেষ্টা করেন। বৃন্দাবনের আদিত্যটিলার পর্ণকুটিরে বসে সেই সময়ে সনাতন গোস্বামী ভজন কীর্তন এবং মহাপ্রভুর নির্দেশিত কর্ম সাধনা করে চলেছেন। বৃন্দাবনের আশেপাশে তখন লোকবসতি খুব কম ছিল, তাই ভিক্ষা সংগ্রহ করতে গেলে সাধুদের মথুরা অঞ্চলে যেতে হতো। একদিন এই ভিক্ষা করতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর সাধন জীবনের এক নতুন দ্বার খুলে গেল। ইষ্টদেব প্রকটিত করলেন সনাতনের কাছে এক নতুনতর সেবালীলা। সেদিন ভিক্ষায় বেরিয়ে সনাতন গোস্বামী মথুরার দামোদর চৌবের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন। উঠোনে পা দিতেই তাঁর চোখে পড়ল দামোদর চৌবের গৃহ অভ্যন্তরে শ্রী শ্রীমদনগোপালের নয়নাভিরাম বিগ্রহ। সেই বিগ্রহ দর্শন করেই সনাতন গোস্বামীর অন্তরে এক অপূর্ব প্রেমাবেশ এল। তাঁর মনে হল ওই মূর্তি যেন তাঁর কত আপনার, কত জন্মের সাধনার ধন সেদিন তাঁর কাছে উপস্থিত। ভাবাবিষ্ট বৈষ্ণব সাধক সনাতনের অন্তরে জেগে উঠল প্রবল আর্তি আর ঐ শ্রীবিগ্রহ সেবার জন্য এক দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা। অতিকষ্টে আত্মসম্বরন করলেন কারণ তিনিতো কন্থাকরঙ্গধারী কাঙাল বৈষ্ণব। আর ঐ বিগ্রহের সেবার সামর্থই বা তাঁর কই। ভিক্ষা গ্রহন করে আদিত্য টিলার নির্জন আবাসে ফিরে এসে তাঁর প্রাত্যহিক ধ্যান ভজনে নিবিষ্ট হলেন। কিন্তু যখনই তিনি চোখ বন্ধ করে ভজনাসনে বসছেন তখনই যেন সেই মদন গোপালের অনুপম মূর্তি তাঁর মানসনেত্রে ভেসে উঠছে। সনাতনের মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেল। মাঝে মাঝেই তিনি কাজে বা অকাজে মথুরায় যেয়ে দামোদর চৌবের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ঐ বিগ্রহের দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে থাকেন। ক্রমে দামোদর চৌবের বিধবা স্ত্রীর সাথে তাঁর পরিচয় হল। কথায় কথায় সনাতন গোস্বামী জানতে পারলেন দামোদর চৌবের বিধবা পত্নী মদনগোপালের এই বিগ্রহকে আদরের বালগোপাল হিসেবে সন্তানজ্ঞানে সেবা পরিচর্যা করেন। তাঁর পুত্রের নাম সদন। ওই সদন যেমন তার এক পুত্র, মদনগোপালকেও আর এক পুত্রজ্ঞানে সেবা করেন। নিষ্ঠাবানভক্ত সাধক সনাতনের মন এই কথায় খুতখুঁত করতে থাকে। তিনি চিন্তা করলেন ভগবানের শ্রীবিগ্রহের এইভাবে সেবা করা শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী অনুচিত। একদিন তিনি চৌবে পত্নীকে ডেকে বললেন "মা তুমি পরম স্নেহে বাৎসল্য রসে মদনগোপালজীর সেবা পরিচর্যা করছ ঠিকই, তবে আমার মনে হয় ওই সেবা পরিচর্যায় খুঁত থেকে যাচ্ছে। একমাত্র মা যশোদা বাৎসল্য রসে প্রভুকে লালন পালন করতেন। এই বাৎসল্য রসে শ্রীভগবানের সেবার চিন্তা সাধারণ জীবের মধ্যে থাকার কথা নয়"। এরপর থেকে চৌবে গৃহিণী ভক্ত বৈষ্ণবেরা যেভাবে শ্রী গোবিন্দের সেবা পূজা করেন সেই বিধি সম্মতভাবে শ্রীবিগ্রহের সেবা অর্চনা করতে লাগলেন। বেশ কিছুদিন এরপরে পেরিয়ে গেছে। পুনরায় চৌবে গৃহিনীর বাড়ীর উঠোনে একদিন সনাতন গোস্বামী গেছেন। তাঁকে দেখে চৌবে গৃহিনী সনাতনের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে বললেন "আপনার উপদেশ কিন্তু আমার মনে হচ্ছে পালন করতে পারব না। কারন কয়েকদিন আগে প্রভু আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন 'তুমি আমার মা হয়েছিল সেটাই তো ভালো ছিল। এখন ভগবান জ্ঞানে আমার সেবা করে আমাকে তুমি দূরে সরিয়ে রাখছো'। প্রভুর এই স্বপ্নাদেশের কথা শুনে সনাতনের দুটি নয়ন অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। এর কয়েকদিন পরে পুনরায় সনাতন চৌবে গৃহিনীর বাড়ির উঠোনে প্রবেশ করামাত্র চৌবে গৃহিনী ছুটে এসে ম্লান মুখে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন "বাবাজি আজ থেকে আপনি আমার মদনগোপালের সেবার ভার নিন। গোপাল বড় হয়ে গেছে, তাই মায়ের আঁচলের তলায় আর বসে থাকতে চাইছে না। আপনার ঝুপড়িতে যাবে বলে বায়না ধরেছে। কাল রাতে এই কথা স্বপ্নে তিনি বারবার আমায় জানিয়েছেন। আপনি আজকেই গোপালের শ্রীবিগ্রহ নিয়ে আপনার ঝুপড়িতে যেয়ে সেবা অর্চনা শুরু করুন"। পরম আনন্দে মদনগোপালের শ্রীবিগ্রহকে কোলে তুলে নিয়ে সনাতন তখনই ছুটে চললেন বৃন্দাবনে তাঁর আদিত্য টিলার ভজন কুটিরে। ভজন কুটিরের পাশে একটি ঝুপড়ি তৈরি করে সেখানে মদনগোপালজীর শ্রীবিগ্রকে সংস্থাপন করলেন। তাঁর সেবার জন্য নতুন উৎসাহে তিনি মাধুকরী করতে শুরু করলেন। ভিক্ষায় সামান্য যা কিছু আটা পেতেন তা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে নিতেন তারপর সনাতন ওই ভোগ শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে নিবেদন করতেন। এই প্রসঙ্গে জানাই যে শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র মহারাজ বজ্রনাভ এক সময়ে সারা ব্রজমণ্ডল অনুসন্ধান চালিয়ে যে আটটি প্রাচীন-বিগ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন মদনগোপালজীর এই বিগ্রহ তাঁদেরই অন্যতম। এই আটার ডেলা আগুনে পুড়িয়ে নিবেদন করার সাথে সাথে প্রতিদিন টিলার চতুর্দিকে যে বুনো শাক পেতেন সেই শাক তুলে এনে সেদ্ধ করে ভগবানের সেবার ব্যঞ্জন তৈরি করতেন। কোনদিন লবন জুটতো আবার কোনদিন তাও জুটতো না। বেশ কিছুদিন পরে শ্রীবিগ্রহ একদিন স্বপ্নে সনাতনকে দর্শন দিয়ে বললেন 'শোনো তোমার নিবেদিত ওই ভোগ আর খেতে পারছি না। একইভাবে আটার ডেলা এবং বুনো শাক আর কতদিন খাব?' এই কথা শুনে সনাতন কাতর কণ্ঠে বললেন "প্রভু তুমি তো জানো, আমি তোমার এক দীনহীন সেবক, তুমি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অভিপতি। তোমার উপযুক্ত রাজভোগ আমি কোথা থেকে জোগাড় করব? তোমার যদি আমার নিবেদিত অন্নব্যঞ্জনে অরুচি হয় তাহলে তুমি নিজেই নিজের সেবার যথাযোগ্য ব্যবস্থা করে নাও"। ভগবানের লীলা সত্যই মানুষের অজ্ঞাত। তিনি মথুরাতে চৌবে গৃহিনীর আরাম ও সমাদর ছেড়ে দিয়ে এই কাঙ্গাল বৈষ্ণব সাধকের ঝুপড়িতে এলেন, এখন আবার বায়না ধরেছেন সুস্বাদু আহারের জন্য। সাধন ভজনের মাঝখানে সনাতনের একমাত্র চিন্তা স্বপ্নে গোপালজী যে বায়না ধরেছেন কিভাবে তার ব্যবস্থা করা যাবে। সনাতনের কাতর আকুতিতে এবং চোখের জল দেখে একদিন অন্তর্যামীর দয়া হলো। কিভাবে সেই ঘটনা ঘটলো সেটি সংক্ষেপে বলছি। 
                                             
(পরবর্তী অংশ দ্বাবিংশতি পর্বে)

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments