জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৪১ /সালেহা খাতুন

আইডেনটিটি কার্ড : অস্তিত্ব

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৪১ 
সালেহা খাতুন 

আমাদের বন্ধুত্ব শুধু সহপাঠিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়ের পথ ধরে ট্রেনে হাওড়া স্টেশন যাওয়ার পথে লেডিজ কমপার্টমেন্টে আমাদের অনেক সিনিয়র দিদিদের সঙ্গেও গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। এঁদের মধ্যে একজন হলেন ফতেমাদি। চেঙ্গাইল থেকে উঠতেন। তিনি ছিলেন কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো বইয়ের দোকানদারদের একজন। তাঁর স্বপ্ন ছিল প্লেব্যাক সিঙ্গার হবেন। যাতায়াতের পথে ট্রেনে প্রায় রোজই আমরা একসঙ্গে ফিরতাম তাঁর গান শুনতে শুনতে। লতার কণ্ঠে গান গাইতেন। “কোয়েল কুকে কু কু কু” তাঁর গলায় অনেকবার শুনেছি।

 তিনি সিঙ্গেল মাদার ছিলেন। ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করতেন। তখন অতো বুঝতাম না তাঁর প্রতিকূলতা কতটা ছিল। ক্ষণস্থায়ী দাম্পত্যজীবন তাঁর। অথচ আমাদের জন্য সম্বন্ধ দেখতেন। তাঁর কোনো এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় তখন মেডিকেল পড়ছে। একদিন আমাকে এক অদ্ভুত কথা বলেন। কথাটা হয়তো স্বাভাবিক কিন্তু আমার অদ্ভুত লাগে। বলেন শোন তুই প্রেম কর ওর সঙ্গে। কিছুদিন দুজনে ঘুরলি বেড়ালি একে অপরকে চিনলি জানলি তারপর ডিসাইড করবি পরস্পর ঘর বাঁধা যায় কিনা! আমি বলেছিলাম অসম্ভব। এমন প্রস্তাব আমার শোনাও পাপ। 

বাবা শুধু পড়াশোনা করার জন্য বাইরে বেরোনোর ছাড়পত্র দিয়েছেন। সঙ্গে সময়ও বেঁধে দিয়েছেন। সন্ধে ছটার মধ্যে ঘরে ফিরতেই হবে। কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে চারটের ক্লাস শেষ করে ছটায় বাউড়িয়ার সাহাপুরে ফেরা এক একদিন দুরূহ হয়ে উঠতো। কেননা জ্যামে পড়েই অনেক সময় নষ্ট হয়ে যেতো। সন্ধেতে ভাই সাইকেল নিয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতো। ট্রেন থেকে নেমে ওর সঙ্গে ঘরে ফিরতাম। এখন বুঝি ওর কত সময় নষ্ট হয়েছে আমাদের জন্য। ছেলে বড়ো হয়েছে ফলে বাবাকে আর হ্যারিকেন নিয়ে এগিয়ে আসতে হয় না। তবে তখনো আমাদের পড়াশোনা নির্ভর করতো সূর্যালোক আর কেরোসিন শিখার উপর। 

ঘরে ফিরে সন্ধেতেই ভাত খেয়ে নিতাম। রাতে শোওয়ার সময় এক গ্লাস দুধ খেতেই হতো। বাবার নির্দেশ অমান্য করা যাবে না। বাবা গর্ব করতেন আর কিছু খাওয়াতে পারি না পারি আমার ছেলেমেয়েদের অঢেল গরুর দুধ খাইয়েছি। ছোটোবেলায় নিজেদের গরু ছিল। তবে সব সময় গরু দুধ দিতো না। ঘোষ বাড়ির শিবনারায়ণ জ্যেঠুর সঙ্গে বাবার চুক্তি করা ছিল যখন তাঁর গরু দুধ দেবে না তিনি আমাদের বাড়ি থেকে দুধ নিয়ে যাবেন আর বিপরীত ঘটলে আমরা তাঁর বাড়ি থেকে দুধ আনবো। শিবনারায়ণ জ্যেঠু আমার অঙ্কের মাস্টারমশাই মানুদার বাবা। ফলে পড়তে গিয়ে আমি একসঙ্গে দুধ আনার কাজটাও করতাম। শিবনারায়ণ জ্যেঠু বলতেন দুধে অল্প জল মেশাতেই হবে নাহলে বাছুরের মাথা ঘুরবে। এটা কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে বলতেন না, এটা তাঁর গভীর বিশ্বাস ছিল।
🍂
কেরোসিনের আলোয় বেশিক্ষণ পড়া যেতো না তার উপর সারাদিনের ক্লান্তি থাকতো। প্রায় দিন নটাতেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ভাই তখন জ্বালাতন করতো। আমার দুপায়ের পাতায় হাত বুলোতে বুলোতে বলতো আহারে এই ছোট্ট ছোট্ট পা দুটি সারাদিন কত পরিশ্রম করেছে। তখন বিরক্ত হতাম। আর এখন পা যন্ত্রণাতে ছিঁড়ে গেলেও নিজেই ভোলিনি লাগিয়ে নিই।

সকালে উঠেই বেশিরভাগ দিন উলুবেড়িয়া লোকাল ধরে হাওড়া যেতাম। তারপর চুয়াল্লিশ নম্বর, দুশো উনিশ নম্বর, দুশো পনেরো নম্বর, চব্বিশ নম্বর কিংবা একাত্তর নম্বর বাস ধরে কলেজ স্ট্রিট মোড়ে নেমে প্রেসিডেন্সি কলেজ, হিন্দু স্কুল পেরিয়ে চলে যেতাম আমাদের প্রিয় আশুতোষ বিল্ডিংয়ে। দশ নম্বর রুমে আমাদের ক্লাস হতো। আমাদের সময়ে তিনশো চল্লিশ জন শিক্ষার্থী ছিলাম। এ বি সি তিনটে সেকশন ছিল। বন্ধুরা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লাম। আমার আগের বন্ধুরা বেশিরভাগ সি সেকশনে চলে গেল। এ সেকশনে অনেক নতুন বন্ধু পেলাম। ফার্স্ট বেঞ্চে ফুলবাগানের সুমনা মজুমদার, বারুইপুরের সোমা, জলপাইগুড়ির নিবেদিতা, হাওড়ার আমি, নৈহাটির মোনালিসা প্রায় দিন বসতাম। মুর্শিদাবাদের সুতপার সঙ্গেও বন্ধুত্ব ছিল। মমতাজ আর আমার আগে পরে রোল নম্বর ছিল। এম.এ.তে আমার রোল নম্বর ছিল আঠারো। এম. এ.পড়ার সময় সবথেকে বেশি এক্সপ্লোর করেছি অনিতার সাথে।

আর দিকপাল সব অধ্যাপকদের ক্লাস পেয়েছিলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁরা এমন পড়াতেন যে তা আজীবন স্মৃতিকে জাগরূক রেখেছে। তাঁরা পড়াতেন হৃদয় দিয়ে। তখনই বুঝেছি-The best teachers teach from the heart, not from the book. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ.পড়তে গিয়ে পেলাম অগাধ সমুদ্রের সন্ধান। এসে পড়লাম বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার দিকপালদের সান্নিধ্যে। পরেশচন্দ্র মজুমদার,রামেশ্বর শ ', দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়, বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়, হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, উজ্জ্বলকুমার মজুমদার, নরেশচন্দ্র জানা, জ্যোতির্ময় ঘোষ, মণিলাল খান,পল্লব সেনগুপ্ত, সুখেন্দুসুন্দর গঙ্গোপাধ্যায়, মানস মজুমদার,বন্দিতাদি, মন্দিরাদি,অপূর্বকুমার রায়, সুভদ্র সেন প্রমুখ।

বড়ো বড়ো ক্লাসে লেকচার মেথডে সাহিত্য পড়ানোর ইতিহাস গড়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলা বিভাগের সেইসব ক্লাস আমরা স্মৃতি বাদে আজ আর পাবো না। দুর্ভাগ্য। লেকচার ভিডিও থাকলে কত উপকার হতো। আসলে মাপে বড়ো ক্লাসে প্রতিদিন ১ঘন্টার ডিউরেশনে ৩/৪টে ক্লাসে মোটামুটি সিরিয়াস কথা বলার আদর্শ তৈরি করেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। 
বিশ্বমানের সেইসব ক্লাসের স্মৃতি নিয়ে আজও আমরা ঋণী হয়ে আছি।

(ক্রমশ)

সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments