জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় /ষষ্ঠ পর্ব /আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
ষষ্ঠ পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী


রোগশয্যায় এপাশ-ওপাশ ফেরার আকুলতার মতোই নিত্য ছন্দে দিন পরে যায় দিন, বছর পেরিয়ে বছর। খেলনাবাটি খেলার বয়স এবং অসুখ-বিপদ-সমস্যা পেরিয়ে ছোট্টো বিরজাও ক্রমশ ডাগর হয়ে উঠতে থাকে খুড়িমা-জ্যাঠাইমার প্রশ্রয়ে। 
তখনকার দিনে গাঁয়ে ঘরে মেয়েদের পড়াশোনার পাট তেমন না থাকলেও, প্রতিটি সন্ধ্যায় বিরজা তার ছোটদাদার সঙ্গে বই-স্লেট নিয়ে বসতো পন্ডিত মশাইয়ের কাছে। একে মা-মরা,তায় বড্ডো জেদি ছিলো যে মেয়েটি। বাড়ির সবাই ছোট থেকেই তাই সমঝে চলতো তাকে। 

এদিকে পাশের বাড়ীর সমবয়সী সইয়ের বিয়ের ঠিক হয়ে যায় আগামীর বৈশাখে, টনক নড়ে বিরজার কাকামশাইয়েরও। বড়ো দাদার বিয়ের পর থেকেই জ্যাঠাইমা গুণগুণ করলেও এবার কিন্তু প্রস্তুতি শুরু হয় জোরকদমে। বড়োদিদিদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো, বড়ো দাদারও বিয়ে হয়ে যায় আগের বছরে। এবার বিরজার জন্য খবর যায় ঘটকের কাছে, আনাগোনা শুরু হয় সম্বন্ধের। 
তবে এসব ব্যাপারে তেমন কিছু ভাবনা ছিলো না বিরজার। তার ছোট্টো জীবন ভরে ছিলো পুকুরপাড়ে নিজের হাতে লাগানো গাছগুলিতে সকালে জল দেওয়া, ফুল তোলা, দুপুরে পুকুরে মাছ ধরা,সন্ধ্যায় বইপত্র নিয়ে হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসা। ব্যপারটা সেকালের যুগে স্বাভাবিক না হলেও কেন কে জানে, পড়াশোনা করতে ভালোই লাগতো ছোট্টো বিরজার, আলপনা আঁকার মতো, সময় পেলেই এঁকে যেত অ -আ-ক-খ…; জ্যাঠাইমার শিখিয়ে দেওয়া বাসন মাজা-দুয়ার ঝাঁটা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুণগুণিয়ে গান গাওয়ার মতো আওড়ে যেত নামতা…তিন দুগুণে ছয়;তিন তিরিক্কে নয়…

ততদিনে দাদারা কলকাতা গিয়েছে পড়াশোনার জন্য, শহর ছাড়িয়ে দেশে-গাঁয়ে বিদ্যাসাগরের মেয়েদের পড়ার কথা খুব ছড়িয়েছে, তাই তারাও চাইছিলো, খানিক পড়াশোনা করুক বোন;বিরজা তখন মাত্রই আট বছরের।
🍂
তাই,বিয়ে করবো না;-একথা বলার মতো কাণ্ডজ্ঞান তার তখনও হয়নি। সে শুধু জানতো, বিয়ে হলে অনেক লোক বাড়িতে আসবে। আলোর ম্যারাপ বাঁধা হবে, মিষ্টির ভিয়েন বসবে, মিহিদানা ছাঁকা হবে, নদী পেরিয়ে হ্যাজাকের আলো জ্বালিয়ে বর আসবে ইত্যাদি ইত্যাদি। 
তবু তারমধ্যেই, বিয়ের কথা শুরু হতেই ছোটদাদার মন খারাপ শুরু হলো, দুজনে ছিলো পিঠোপিঠি, প্রতি সন্ধ্যায় তার সঙ্গেই পড়তে বসতো বিরজা; যদিও ছোটদাদার চাইতে পড়ায় তার মাথা ঢের বেশী ভালো ছিলো, এমনটাই বলতেন পন্ডিত মশাই।সঙ্গীছাড়া হবার ভয়ে হোক,ভালোবেসে হোক,ছোটদাদা বোনটিকে কাছ ছাড়া করতে চায়নি। কিন্তু এক্ষেত্রে কারও তো কিছু করার নেই। তখনকার  দিনে, একে পাড়াগাঁয়ে মেয়েদের তেমন পড়াশোনার চল ছিলো না,লোকভয় কাজ করতো, অক্ষর পরিচয় করলেই নাকি বিধবা হয়ে যায় মেয়েরা, এমনটাই ভাবা হতো। 
তায় পাত্রের বাড়ি ছিলো কলকাতায়,বাবা ছিলেন সওদাগরী অফিসের ম্যানেজার।দেশে অঢেল জায়গা-জমি। তাদের তিন শরিকে ছেলে বলতে পাত্র একাই। এমন সৎপাত্র পেয়ে হারানো আহাম্মকী ছাড়া কী! 
 অতয়েব জোরকদমে চলেছিলো প্রস্তুতি। 
এখনও মনে পড়ে, সেদিনও ছিলো হয়তো এমনই বসন্ত দিন। শীত চলে যাচ্ছে, বাতাসে ঝরা পাতার মর্মর। তারা নামের সেই চঞ্চলা বালিকা ঘুম ভেঙে উঠেই অভ্যাসমতো শিরীষ গাছতলায় এসে পৌঁছেছে, মৃদুমন্দ হাওয়ায় পাতা নড়ছে, লাল লাল বুরুসের মতো ফুলে হালকা কেমন যেন একটা গন্ধ মনকেমনের মতো গাছতলায় জমা হচ্ছে…কাল রাতে ঘুমোবার আগে, জ্যাঠাইমা বলে দিয়েছেন,আজ তাকে দেখতে আসবে পাশের গ্রামের জমিদার বাড়ি থেকে। সে যেন লক্ষী হয়ে থাকে।
সেদিন সকালবেলায় কাজকর্ম কিছুই করতে দেয়নি কেউ, উপরন্তু চানের আগে, দুধের সর আর হলুদবাটা মাখিয়ে, নিজের হাতে চান করিয়ে তার নিজের আকাশমনি রঙের একখানা সিল্কের শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিলো বৌদিদি। তাকে অমন শাড়ি জড়ানো অবস্হায় দেখে জ্যাঠাইমা আদর করেছিলো চিবুক ছুঁয়ে, মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলেছিলো, 
-’চির আয়ুস্মতী হও’... 
যথাসময়ে  দুপুরবেলায় পাত্রপক্ষ এসে তাকে পছন্দও
 করে গিয়েছিলো। যদিও সেকালের নিয়ম মতো, শুধু পুরুষরাই এসেছিলেন,তবে তাঁরা যে বিরজাকে রাধারাণী বলেছিলেন,তা শুনে তার বেশ আনন্দ হয়েছিলো খুড়িমা-জ‍্যাঠাইমার, এটুকু বিরজার বেশ মনে আছে। 
তার কয়েকদিন পরেই, বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো মহাসমারোহে, বেশ আড়ম্বরে; শুধু মাতৃরূপা জ্যাঠাইমার আশীর্বাদখানি সত্যি হয়নি। যদিও হওয়ার উপলক্ষ্য ছিলো ঢের। 
এখনও মনে আছে, বর এসেছিলো ঘোড়ার গাড়ি চড়ে, লাল টুকটুকে বর। বরযাত্রীর দল এসেছিলো কলকাতা থেকে আনা আতশবাজি ফাটিয়ে। গাধার পিঠে চাপিয়ে এসেছিলো মিষ্টির ভার, কেওড়া জল ছিটিয়ে। সে কী হৈ চৈ…
তারপরে, সারা রাতের বিবাহ, খাওয়া-দাওয়া এবং ছড়া কাটা, গান শোনানো বাসররাত্রি যাপনের পরে আটবছরের কন্যে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলো চতুর্দোলা চড়ে, বেনারসী পরে। ধন্য ধন্য পড়ে গিয়েছিলো চতূর্দিকে, এমন গৌরীদান, এমন জাঁকজমকের বিয়ে নাকি অনেক দিন দেখেনি আশেপাশের গাঁয়ের লোক। 

তবে বিয়ের পরে, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বিরজা দেখেছিলো, দালানবাড়ি কাকে বলে! বিরজার পিতৃগৃহে অভাব না থাকলেও বাড়িটি ছিলো মাটির,গ্রামগঞ্জের আর পাঁচটা গৃহস্থ বাড়ি যেমন হয়; জ্যাঠাইমা, খুড়িমা,নতুন বৌদিদির প্রতিদিনকার যত্নে বাড়িটি সবসময়েই ঝকঝকে তকতকে থাকলেও। 
তবে উঁচু উঁচু কড়ি বরগা দেওয়া বড়ো বড়ো জানলা ঘেরা ইয়াব্বড়ো কোঠা বাড়ি দেখেনি কখনো। দেখেনি আটচালা সমেত খিলান দেওয়া শ্বেতপাথরের গোবিন্দ মন্দির;রাসমঞ্চ, দোলমঞ্চ, প্রাত্যহিক সকাল-সন্ধ্যার গোপালসেবা,রাজারতি,ভালো ভালো খাবার এবং আরও কতো কি। মনে আছে, আজন্ম শাক্ত পরিবারে মানুষ হওয়া মেয়েটিকে প্রথম শ্বশুরবাড়ি আসার সন্ধ্যায় কাকীশ্বাশুড়ি খাইয়েছিলেন ঘী চকচকে কাজু-কিসমিস দেওয়া মোহনভোগ আর লুচি, তার স্বাদ জীবনভ'রই যে লেগে রইলো মুখে! আর তাই হয়তো অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরের প্রসাদ খেতে গিয়েও সবাই যখন অপূর্ব,দেবভোগ‍্য এইসব বলছিলো,বিরজার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো,'একেবারে আমার স্বশুরঘরের মোহনভোগের মতো!'
হয়তো জীবনের ধর্মই তাই। যা প্রথম, তা যে অমৃত মাধুরী নিয়ে আসে, পরের অভিজ্ঞতা তার চাইতে ভালো হলেও তা অতুলনীয়ই রয়ে যায়। স্নেহ, মায়া, প্রেম… সবই;হয়তো বিচ্ছেদও।
তাই হয়তো পরে আরও একবার যখন যেতে হয়েছিলো শ্বশুরবাড়ি পরিনত বয়সে বৈষয়িক কারণে; কৈশোরের অনুরাগী চোখে নববধূর সেই প্রথম আচুম্বিত শ্বশুরালয় দর্শনের অমর্ত্য মূর্চ্ছনার মুগ্ধতা অনুভূত হয়নি, তেমন রোমাঞ্চ বোধও হয়নি।
তা নইলে, যে মানুষ তাঁর নিজের মতে বাঁচতে চেয়েছেন ভবিতব্যকে অস্বীকার করেই, বিদায়বেলায় আতুর মনে  কেন মনে পড়ছে ফেলে আসা সেই রিক্ততর অতীতকে… আপাত সফল বর্তমানকে দূরে ঠেলে! 
এর উত্তর বিরজাসুন্দরীর কাছে নেই, আমাদের কাছেও আছে কি?

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments