জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক নীহাররঞ্জন রায় /নির্মল বর্মন


বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক নীহাররঞ্জন রায় 

নির্মল বর্মন

অধ্যাপক  ড.নীহার রঞ্জন রায় , শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, ঐতিহাসিক , শিল্পবিষয়ক গবেষণা, রাজনীতি ও বিভিন্ন প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রথমসারির কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন । অধ্যাপক রায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ যশ "বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদিপর্ব" পুস্তকটি। বিশাল মেধার অধিকারী ড .নীহাররঞ্জন  রায় ইওরোপের লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ও লণ্ডন থেকে গ্রন্থাগার পরিচালনায় ডিপ্লোমা লাভ করে বুদ্ধিজীবী মহলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৪৬-সালে  ভীরতীয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শিল্পকলার '"রানী বাগীশ্বরী'' অধ্যাপক পদ লাভ করে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিলেন। ড .রায় ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের সেক্রেটারি ছিলেন । দেশে ও বিদেশের  বহু বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণামূলক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকেছিলেন। ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলনে শরীর মন সঁপে দিয়ে  রাজনীতিতে  যোগদান করেছিলেন । পরবর্তী সময়ে সুভাষচন্দ্র সুপ্রতিষ্ঠিত "লিবার্টি'', পত্রিকা'র সাহিত্য বিভাগের গুরু দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক রায় মহোদয়ের নানাবিধ কার্য ও কর্মকুশলতা'র নিরিখে ভারত সরকার "পদ্মভূষণ'' উপাধিতেও ভূষিত করেছিলেন।
প্রাবন্ধিক নীহাররঞ্জন রায় বিরোচিত প্রবন্ধ গ্রন্থগুলি  :- ''রবীন্দ্র সাহিত্যের ভূমিকা'' (১৯৪১), ''বাঙালী হিন্দুর বর্ণভেদ'' (১৯৪৫), ''প্রাচীন বাংলার দৈনন্দিন জীবন'' (১৯৪৭), ''বাংলার নদনদী'' (১৯৪৮), ''বাঙালীর ইতিহাস : আদিপর্ব" (১৯৪৯), ''কৃষ্টি কালচার সংস্কৃতি'' (১৯৭৯)।
ড .রায় ইংরেজিতে বিরোচিত  গ্রন্থ:- ''ক্যালকাটা রিভিয়্যু", ''চতুরঙ্গ'', 
''সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা'', ''বিশ্বভারতী পত্রিকা'', ''ক্রান্তি', 'জিজ্ঞাসা'', ইত্যাদি পত্রপত্রিকার নিয়মিত লেখালেখি  করেছেন ।
শিক্ষাবিদ ও গবেষক রায় বাবু রবীন্দ্র গবেষক । তাঁর সৃষ্টি ''রবীন্দ্র সাহিত্যের ভূমিকা'' রবীন্দ্র সাহিত্যের পাঠকের কাছে ঈর্ষণীয় ও আকর্ষণীয় বটে। এই পুস্তকে রবীন্দ্রমনন ও রবীন্দ্রসাহিত্যের কালজয়ী বিবর্তন, রবীন্দ্র কবির ব্যক্তিজীবন ও সমকালীন ভাবনা  ও সমাজ ইতিহাসের প্রেক্ষাপট তথ্যসমৃদ্ধ আদলে বিস্তৃত । বস্তুতঃ বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা,  ছোটগল্প , উপন্যাস ও নাটক সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করা হয়েছে । প্রাবন্ধিক রায় সাহেব রবীন্দ্রসাহিত্যালোচনায় কালজয়ী সমালোচকের ভূমিকা যত্নসহকারে পালন করেছেন । দৃষ্টান্তস্বরূপ:- "চোখের বালি"  উপন্যাসে 'বিনোদিনী'র পরিণতি সম্পর্কিত মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:-
            "লেখক বিনোদিনীকে একটা অনিবার্য পরিণামের দিকে লইয়া যাইতেছিলেন পাঠকের মনের একান্ত বাস্তবানুভূতির মধ্য দিয়া, কিন্তু শেষ সীমায় পৌঁছিবার অব্যবহিত পূর্বে হঠাৎ সামাজিক বাস্তবনিষ্ঠা তাঁহার শিল্পী-মানসকে অভিভূত করিয়া দিল, বিনোদিনীর অনিবার্য পরিণাম না ঘটাইয়া তাহাকে তিনি কল্পলোকের ভাবাদর্শের মধ্যে বিসর্জন দিলেন। জীবন যাহাকে বঞ্চনা করিয়াছে শিল্পী রবীন্দ্রনাথও তাহাকে বঞ্চনা করিলেন।"
              অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় সাহেব বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে পাথেয় করে ''বাঙালীর ইতিহাস'' নামক আকর পুস্তকটিতে  গুরুত্বপূর্ণ প্রতিভার স্মারক স্থাপন করে গেছেন। বর্তমান সময় ও সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে বাঙালি  জনগোষ্ঠীর  ইতিহাস সম্বলিত মূল্যবান বাংলা ও বাঙালির জনজীবনপ্রবাহ, মানসিক সংস্কৃতি, উৎপাদন , সমাজ গঠনেয পরিকাঠামো, গ্রামসভা ও নাগরিক রূপ, শিল্প,ব্যবসা-বাণিজ্য, ধর্মভাবনা-কর্মজীবন, লোকজীবন ইত্যাদি বিষয়গুলো স্থান লাভ করেছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিকবিদ যদুনাথ সরকার মহোদয় ড.রায়ের "বাঙালীর ইতিহাস"  মূল্যায়ন প্রসঙ্গটিও প্রযোজ্য:-, 
                    "এই গ্রন্থ বাঙালীর লোক- ইতিহাস; ইহাতে বাঙালীর জনসাধারণের, বাঙালী জাতির সমগ্র জীবনধারার যথার্থ পরিচয় দিবার জন্য আদ্যন্ত চেষ্টা করা হইয়াছে।"
সুযশ প্রাবন্ধিক  সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের 'সংস্কৃতি শিল্প ইতিহাস' গ্রন্থের  সমপোযোগী অধ্যাপক নীহাররঞ্জন বাবুর "কালচার,কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অনুসন্ধান"।  'কালচার, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অর্থসন্ধান' প্রবন্ধে 'কালচার' বলতে রায় সাহেব বোঝানোর চেষ্টা করেছেন:-
         "কালচার কথাটার সঙ্গে কাল্টিভেশন কথাটার আত্মীয়তা যে খুব ঘনিষ্ঠ তা বুঝবার জন্য কিছু পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন হয় না। বিশেষ্য বা ক্রিয়াপদ যে হিসেবেই হোক কালচারের প্রথম আভিধানিক অর্থই হচ্ছে, কাল্টিভেশন, কর্ষণ, কৃষি; আর কাল্টিভেশনও যে কৃষিকর্ম তা তো বিদ্যালয়ের বালকও জানে।"
ফলতঃ কৃষ্টি সাধারণত বৈদিক শব্দ।যার আক্ষরিক অর্থ  জাতি, মূল অর্থ কর্ষণ পক্রিয়া। এ প্রসঙ্গে ড.নীহাররঞ্জন রায়ের মন্তব্য আকর্ষণীয়:-
      "যে স্তরে কৃষ্টি অর্থে দেশ, দেশের মানুষ বা জাতি বোঝান হচ্ছে সে স্তরে কৃষ ধাতুর অর্থ প্রসার ঘটেছে, এবং যাঁরা কৃষিকেই প্রধান জীবনোপায় বলে মেনে নিয়েছেন তাঁদেরকেই শুধু বোঝানো হচ্ছে, কারণ তাঁরাই তখন তদানীন্তন সভ্যতার উচ্চতম স্তরে। অনু-দ্রুহু-তুর্বশ-যদু-পুরু-এই পাঁচটি আর্যভাষী জনেরাই বোধহয় প্রথম কৃষিসভ্যতার পত্তন করে থাকবেন সপ্তসিন্ধুর দেশে, এবং এইজন্যই তাঁরা পঞ্চকৃষ্টয়ঃ।”
                 অধ্যাপক নীহার রঞ্জন রায়,কৃষি, কালচার, কাল্টিভেশন  শব্দগুলোর প্রসারিত অর্থ সম্পর্কে লিখেছেন:-
 "এই তিনটি ক্রিয়ার সামাজিক উদ্দেশ্য শুধু multiplication বা পরিমাণগত বৃদ্ধি নয়, গুণগত বৃদ্ধিও বটে এবং সে-বৃদ্ধি ও জীবধর্মের নিয়মানুগ। ...এই গুণগত পরিবর্তনই সংস্কৃতি, যেমন কৃষির ফল হচ্ছে কৃষ্টি।"
                সাহিত্যিক  ইতিহাসের সরণী অতিক্রম করে কৃষ্টি  এবং সংস্কৃতি'র যে জটিল অর্থ  আবিষ্কার করেছেন তা গ্ৰহনযোগ্য   
🍂
        "ভারতীয় আর্যভাষায়ও কৃষ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন কোনো শব্দ (আমার ধারণায় কৃষ্টি), কোনো এক প্রাচীনকালে, এই একই অর্থে, অর্থাৎ মানুষের দেহ-মন-চিত্তভূমি চাষ, জীবন কর্ষণক্রিয়া অর্থে ব্যবহৃত হত। কৃষি বা কর্ষণের যে প্রসারিত অর্থের দিকে আমি বারবার ইঙ্গিত করছি, ভারতীয় পরম্পরায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই কল্পমূর্তি বা বাক্ প্রতিমার প্রচলন না থাকলে রামপ্রসাদ কোথা থেকে পেলেন চাষ আবাদের এই প্রসারিত অর্থ? এর সঙ্গে তো কোথাও ইংরেজি কালচার- কাল্টিভেশনের প্রসারিত অর্থের কোনো অমিল নেই!"
   ‌‌             প্রাবন্ধিক, গবেষক ও অধ্যাপক ড.নীহাররঞ্জন রায় , তথ্যানুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি,প্রখরযুক্তিবোধ, সুতীক্ষ্ণ ইতিহাসজ্ঞান, উদার মন  মানসিকতার জন্য  স্বাতন্ত্র্য হলেও কালের অমোঘ নিয়মে আজ বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক।

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

1 Comments

  1. ভালো লেখা পড়লাম

    ReplyDelete