ভোলগা তীরের পাহাড়
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩৯
বিজন সাহা
বলগার বা বুলগারের পথে
পয়লা সেপ্টেম্বর ২০২১ আমরা কাজান থেকে রওনা হলাম উলিয়ানভস্কের পথে। অনেক পরিচিত বন্ধুবান্ধব থাকার পরেও সেরকম কিছু এখানে করা যায়নি দিলীপের জন্য। ভেবেছিলাম তানিয়া একটা ফ্যামিলি ফটোসেশনের ব্যবস্থা করতে পারবে। সেটাও হয়নি শেষ পর্যন্ত। একটা কাজ হয়তো করা যেত। পয়লা সেপ্টেম্বর রাশিয়ায় নতুন শিক্ষা বর্ষের শুরু। দীর্ঘ তিন মাস ছুটির পর স্কুল মুখরিত হয় শিশুদের কলরবে। বিশেষ করে যারা জীবনে প্রথম বারের মত স্কুলে যাচ্ছে সেটা তাদের ও তাদের বাবা-মাদের জন্য যাকে বলে ঐতিহাসিক ঘটনা। সেই দিনের গল্প চলবে অনেক দিন, পারিবারিক অ্যালবামে স্থান পাবে সেদিনের অসংখ্য ছবি। হয়তো বা চেষ্টা করা যেত দিলীপকে নিয়ে সেরকম কোন এক স্কুলে যেতে। তবে তখন মনে হয়নি আর সময়ও তেমন ছিল না।
ফারহাদ বলেছিল উলিয়ানভস্ক যাবার পথে আমরা কামা নদীর তীরে জেলেদের পল্লীতে যেতে পারি। দিলীপকে সেটা মনে করিয়ে দিলাম, তবে ও ইতিমধ্যে হতাশ হয়েছে এসব ব্যাপারে। আসলে এতদিনেও আমি দিলীপকে বোঝাতে সক্ষম হয়নি যে এদেশের মানুষজন আমাদের দেশের মত নয়, নিজ নিজ কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের দেশে যদি যেকোনো টি-স্টলে বসলে রাজ্যের খবর পাওয়া যায় এখানে সেরকম কিছু নেই। হয়তো কিছু বৃদ্ধ বৃদ্ধা বাড়ির সামনে বেঞ্চে বসে রাজ্যের খবরাখবর বিনিময় করেন, তবে কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে নিয়মিত এসব আড্ডা তেমন দেখা যায় না। তাই জেলে পল্লীতে গেলেই যে সবাই এগিয়ে এসে বিভিন্ন কথা বলবে সেই গ্যারান্টি নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় এমনকি যখন আমাদের ইনস্টিটিউটে বা শহরে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ভিজিটে আসেন আমরা সেটা জানতে পারি রাতের খবর থেকে। অথচ আমাদের দেশে এমনকি এক এম পি এলাকায় এলে কয়েকদিন আগে থেকেই মাইকিং শুরু হয়। যাহোক, দিলীপের অনিচ্ছা দেখে ঠিক হল পথে দেরি না করে আমরা সোজা চলে যাব উলিয়ানভস্ক। আমার অবশ্য ইচ্ছা ছিল বুলগার যাবার। সে কথা বলেওছিলাম, তবে দিলীপের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া পাইনি। তাই বাকি রইল দেমিদের সাথে চোখে চোখে কথা বলার।
কামস্কোয়ে উস্তিয়ে
আমি প্রথম বুলগারের নাম শুনি বন্ধু কাম কল্যাবরেটর টোডর বয়াদঝিয়েভের মুখে। ও বুলগেরিয়া থেকে। আমার চেয়ে বছর পনেরর বড়। তবে অনেক দিন একই রুমে বসেছি আর একসাথে কয়েকটি পেপারও লিখেছি। ও গণিতবিদ। একদিন এক সেমিনারে নিজেই এসে বলল
- তুমি তো নিউমেরিক্যাল মেথড তেমন জান না। আমি এটা করি। চাইলে তোমাকে সাহায্য করতে পারি। এক সাথে কিছু পাবলিকেশন করা যায়।
আমিও রাজী হলাম। দেখা গেল আমার মত টোডরও ছবি তুলতে পছন্দ করে। ইতিহাসের ব্যাপারে আগ্রহী। ওর কাছেই শুনি ভোলগা তীরের বুলগার জাতিরাই এক সময় বর্তমান বুলগেরিয়া গিয়ে বসবাস শুরু করে। ও বুলগেরিয়ায় বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকা ঘুরে নানান ধরণের ছবি তুলত, অনেকটা এরিক ফন দানিকেনের মত এসবের উৎস খোঁজার চেষ্টা করত। আর বাশকিরিয়া, তাতারস্তান এসব এলাকায় দীর্ঘ ভ্রমণে যেত সময় পেলে। বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলাম আমরা। ২০০৯ সালের অক্টোবরে আমার ডিএসসি ডিফেন্ডের মাস দেড়েক পরে হার্ট অ্যাটাক করে, মারা যায় সে বছর ডিসেম্বরের শেষে। আজ যখন এসব এলাকায় ঘুরছিলাম, বার বার মনে পড়ছিল টোডরের কথা।
এসব ভাবতে ভাবতে পথে দেখলাম বুলগারের নির্দেশিকা। দেমিদ আমার সাথে তাল মিলিয়ে বলল পথে তো খেতেই হবে। আমরা বরং বুলগার ঘুরেই যাই। দেখা ও খাওয়া দুটোই হবে। আমরা ওদিকেই মোড় নিলাম। বুলগার কামা ও ভোলগার মিলনস্থল থেকে একটু ভাটিতে প্রাচীন জনপদ। এখানে কামা মনে হয় সাগর। নিয়ম অনুযায়ী দুটো নদী যখন মিলিত হয় তখন মিলনের আগে যে নদীর জলের পরিমাণ বেশি সেই নদীর নামানুসারে পরবর্তী অংশের নাম হয়। অনেকের ধারণা সেই হিসেব অনুযায়ী এখান থেকে নদীর নাম ভোলগা না হয়ে কামা হওয়া উচিৎ। তবে অনেক হিসেব নিকেশ করে দেখানো হয়েছে যে ভোলগা নামই ঠিক আছে।
কোন কোন নাম আমাদের স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকে। যখন কামার উপর দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম মনে পড়ল আরেক সহকর্মী মিখাইল মারৎসেনিউকের কথা। ইনি পেরম নামক এক শহর থেকে। দুবনায় কাজ শুরু করার প্রথম দিকে প্রায়ই আসতেন। কিছু যৌথ কাজ আছে ইলেক্ট্রোডাইনামিক্সের উপর। পরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মূলত আমি পুরোপুরি গ্র্যাভিটেশন আর কসমোলজির উপর কাজ শুরু করলে। আমি ১৯৯৪ সালের মে মাসে দুবনায় জয়েন করার মাস দুয়েক পরে উনি দুই ছাত্র সহ ভিজিটে আসেন সপ্তাহ দুয়েকের জন্য। একদিন দুপুরে জিজ্ঞেস করলেন
তুমি খাবে আমাদের সাথে?
চলুন।
তাহলে ফ্রিজ থেকে হ্যাম আর বাটার নিয়ে আস।
ফ্রিজ কোথায়?
উনি আকাশ থেকে পড়লেন। এই দুই মাস আমি যে টেবিলে বসে কাজ করছিলাম, তার পাশেই ফ্রিজ। কীভাবে যে এতদিন ও আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে ছিল সেটা আজও রহস্য!
বুলগার আমি প্রথম যাই ২০১৯ সালের ০২ সেপ্টেম্বর। ঠিক ২ বছর পরে ২০২১ সালের ০১ সেপ্টেম্বর আবার সেখানে ফেরার একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সেবার অবশ্য আমরা গেছিলাম জাহাজে ভোলগার পাহাড়ের মত উঁচু পাড় আর সমুদ্রের মত কামার জলরাশি দেখতে দেখতে। মনে পড়ছিল আরিচার কথা। আরিচা থেকে গোয়ালন্দ যাবার পথে যেখানে পদ্মা আর যমুনা মিলিত হয়েছে সেখানেও ছিল এমন জলরাশি। পদ্মার ঘোলা জল আর যমুনার নীল জল তাদের মিলনকে বাঁধা দিত, মনে হত এই দুই নদী কোন এক অদৃশ্য দেয়াল দিয়ে পরস্পর থেকে আলাদা করা হয়েছে। যখন বুলগারের পথে যাচ্ছিলাম কত মুখ যে ভেসে উঠছিল মনে! ব্রাজিল, ইটালি, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ভারত, সাউথ আফ্রিকা – অনেক দেশের লোকজন সেবার ছিল কনফারেন্সে। এটা ছিল ব্রিকসের উদ্যোগে আয়োজিত কনফারেন্স। যদিও সোভিয়েত আমলে আমি ইয়ারোস্লাভল থেকে রোমানভ-বরিসোগ্লেবস্ক, রীবিনস্ক, উগলিচ, কালিয়াজিন, বেলি গোরাদ, কিম্রি, দুবনা, তভের এসব জনপদ পাড় হয়ে মস্কো পৌঁছেছিলাম আর পরে দুবনা থেকে কালিয়াজিন গেছিলাম, তবে ভোলগা সেখানে একেবারেই ভিন্ন রূপী। এসব এলাকা মূলত সমতল ভূমি বা মালভূমি। মাঝে মধ্যে ভোলগা বেশ প্রশস্ত হলেও নদী তীর ঠিক ততটা উঁচু নয়। কিন্তু কাজান থেকে বুলগার যাবার পথে মনে হচ্ছিল যেন ভোলগার এক তীরে পাহাড়েরা ঘুমিয়ে আছে। কোথাও লাল মাটি। কোথাও সেই উঁচু ভূমিতে ছোট্ট গ্রাম। গ্রাম থেকে উঁকি দিচ্ছে গির্জা বা মসজিদ। এখান থেকে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে ল্যান্ডস্কেপ। আসলে এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা মস্কোর সাথে একই অক্ষ রেখায় বা আরও উত্তরে ছিলাম। কাজানের পর থেকে শুরু হল দক্ষিণ মুখী যাত্রা। আশেপাশের বনে গাছগুলির চেহারা বদলে যেতে শুরু করল।
কামার বিশাল জলরাশি
যদিও বুলগারের মূল কমপ্লেক্সে ফেরি ঘাট আছে তবুও আমাদের নামানো হয় বেশ দূরে। সেখান থেকে বাসে এসেছিলাম। এবার আসছি গাড়িতে, বুলগারের অন্যান্য অংশ দেখতে দেখতে। কোন শহর বা জনপদ যখন পর্যটকদের জন্য বিশেষ ভাবে ঢেলে সাজানো হয় তখন কিছু কিছু জায়গা মানে ট্যুরিস্ট স্পট বাদে বাকি সবকিছু অবহেলিত না হলেও অনেকটা দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়। এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি। সেবার মূল স্পট থেকে দূরে কিছু পুরানা স্থাপনা দেখতে পেয়েছিলাম। আজ ভাবছিলাম সেবারের না দেখাটা পুষিয়ে নেব। কিন্তু তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বুঝলাম, এখানে নেমে সময় কাটালে দিলীপ আর দেমিদের প্রতি অন্যায় করা হবে। তাই সোজা চলে গেলাম রাষ্ট্রীয় ভাবে সংরক্ষিত ইতিহাস ও স্থাপত্যের যাদুঘর বুলগারে, যা ছিল দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভোলগার বুলগার রাজ্যের রাজধানী। বেশ বড় এলাকা নিয়ে এই যাদুঘর। গাড়ি বাইরে রাখতে হবে। আবহাওয়া বেশ ভালো মনে হল। তাই গাড়ি থেকে নামার আগে প্যান্ট শার্ট খুলে হাফ-প্যান্ট আর টিশার্ট পরে নিলাম। বিশ দিনের এই ট্রিপে এটাই ছিল একমাত্র সুযোগ, যদিও পরে নদীর তীরে গিয়ে বুঝলাম সিদ্ধান্তটা তেমন সঠিক হয়নি। গাড়ি থেকে নামতেই এক ফ্যামিলির সাথে দেখা। তাতার। পোশাক দেখেই বুঝলাম। বৃদ্ধ, বৃদ্ধা আর তাদের বয়স্ক ছেলে, মনে হয় আমার বয়সী। বৃদ্ধা জগ থকে জল ঢেলে দিচ্ছেন বৃদ্ধের হাতে, উনি হাত মুখ ধুচ্ছেন। দিলীপের পীড়াপীড়িতে তাদের অনুরোধ করলাম আবারও সেটা করতে যাতে আমরা কয়েকটি ছবি নিতে পারি। যাক, দিলীপ একটা মন মত ছবি পেল ভেবে আশ্বস্ত হলাম। ওনারাও দূর থেকে এসেছেন বুলগার, নিজেদের অতীত স্মৃতির সাথে পরিচিত হতে। তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা রওনা হলাম কমপ্লেক্সের দিকে।
ছবিতে ভোলগা কামা
http://bijansaha.ru/album.php?tag=280
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
3 Comments
👍👍👍
ReplyDelete👍
Delete👍
ReplyDelete