জ্বলদর্চি

ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় (স্বাধীনতা সেনানী, সাহিত্যিক, তমলুক)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৯৩
ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় (স্বাধীনতা সেনানী, সাহিত্যিক, তমলুক) 

ভাস্করব্রত পতি

তিনি ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সেনানী। তিনি ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়। ইংরেজি ভাষায় লেখা ভারতীয় সাহিত্যিকদের মধ্যে আমেরিকা ও ইউরোপে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ১৮৯০ এর ৬ ই জুলাই তমলুক শহরের রূপনারায়ণ নদের পাড়ে পায়ররাটুঙি খালের কাছে তাঁর জন্ম হয়। মৃত্যু হয় ১৯৩৬ এর ১৪ ই জুলাই আমেরিকার নিউ মিলফোর্ডে। বাবা কিশোরীলাল মুখোপাধ্যায় ছিলেন নামকরা আইনজীবী। 

প্রথম জীবনে তমলুক হ্যামিল্টন হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়। পরে তমলুকে কলেরা ছড়িয়ে পড়লে মা দাদার সঙ্গে তমলুক ছেড়ে কলকাতা চলে যান। সেখানে গিয়ে ডাফ কলেজিয়েট স্কুলে (বর্তমানের স্কটিশ চার্চ হাইস্কুল) ভর্তি করা হয় তাঁকে। ইতিমধ্যে তাঁর দুই দাদা যাদুগোপাল এবং ক্ষীরোদগোপাল যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। তাঁদের থেকেই অনুপ্রাণিত হন ধনগোপাল। এই যাদুগোপালকে ব্রিটিশ পুলিশ বিনাবিচারে ১৯২৩ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত বন্দি করে রেখেছিল। দাদার প্রতি অদম্য ভালোবাসায় একসময় লিখেছিলেন "আমার ভাইয়ের মুখমণ্ডল" (My Brother’s Face) নামে একটি স্মৃতিকথা।

১৯০৮ সালে ক্ষীরোদগোপাল স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজে গেলেন বার্মাতে। আর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়তে জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন ধনগোপাল। সেখানে এক বছর থেকেই চলে যান আমেরিকায়। সেখানে স্ট্যানফোর্ড এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। মেদিনীপুরের আরেক বিখ্যাত বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের প্রকৃত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। সেই নাম বদলে এম এন রায় করেন এই ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়। 

এরপর ধনগোপাল ফিরে আসেন শান্তিনিকেতনে। কিন্তু তার আগে কিছুদিন আটকে যান এলাহাবাদে জওহরলাল নেহেরুর কাছে। ১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানে যাদুগোপাল শান্তিনিকেতনে গঠনমূলক কাজে নেমে পড়েন। পরে তিন ভাইই যুক্ত হন। যাদুগোপাল পরিকল্পনা করতেন। বাকিরা কাজে লেগে পড়তেন। আমেরিকায় থেকে ভারতের হয়ে কাজ করতেন ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়। ব্রিটিশ পুলিশ অবশ্য তাঁকে কব্জায় আনতে পারেনি। স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত মিস ম্যাকলাউড যাদুগোপালকে জানিয়েছিলেন, 'স্বামীজীর পরে ধনগোপালই পাশ্চাত্যের কাছে ভারতকে পরিচিত করার উপযুক্ত মানুষ'। এই দুজন ধনগোপালকে নির্দেশ দেন ভারতকে পাশ্চাত্যবাসীর কাছে উপস্থাপিত করার দূতের কাজ করতে। 

১৯১৬ সালে তিনি প্রথম লিখেছিলেন 'রজনী, সংস অফ দ্যা লাইট' নামে কবিতার বই। এছাড়াও লিখলেন 'লয়লা অ্যাণ্ড মজনু' নামের একটি নাটক। ১৯১৭ তে লিখলেন 'সন্ধ্যা, সংস অফ টোয়াইলাইট'। ১৯২২ তে প্রকাশিত হয় 'অরণ্য জীবনের কাহিনীমালা' সিরিজের প্রথম বই 'করি, দ্যা এলিফ্যান্ট'। এটি ছাপে আমেরিকার বিখ্যাত প্রকাশক 'ই পি ডাটন অ্যাণ্ড কোং'। অনেক ভাষায় অনূদিত হয় দারুণ জনপ্রিয়তার জন্য। ১৯২৩ এ আবারও দুটি বই প্রকাশিত হয়। একটি ছিল  আত্মজীবনীমূলক 'কাস্ট অ্যাণ্ড আউটকাস্ট'। আর সিরিজের দ্বিতীয় বই 'জঙ্গল, বিস্ট অ্যাণ্ড মেন'। ১৯২৭ এ তিনি লিখলেন, 'গে নেক, দ্যা স্টোরি অফ এ পিজিয়ন'। যা ১৯২৮ সালে সেরা শিশু সাহিত্য হিসেবে আমেরিকার লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন 'জন নিউ বেরি' পুরস্কার দেয়। এ ছাড়াও শিশুদের জন্য অন্যান্য যেসব বই তিনি লিখেছেন, সেগুলি হল -- The Jungle Lad, Kari the Elephant, Ghond, The Hunter, Jungle Beasts and Men, Hari, The Chief of the Herd (১৯২৯) ইত্যাদি। 

তিনি তাঁর মাকে খুব ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় মায়ের মুখে শোনা ১০ টি বাছাই করা গল্প নিয়ে মাকে উৎসর্গ করে লিখলেন, 'হিন্দু কেবলস ফর লিটল চিলড্রেন'। তিনি ধর্মদর্শনমূলক একটি বিখ্যাত গ্রন্থ Divotional Passages of the Hindu Bible (১৯২৯) লিখেছিলেন। যা গীতা ও উপনিষদের সংকলন গ্রন্থ। 
ধনগোপালের জনপ্রিয় বইয়ের তালিকায় 'এ সন অব মাদার ইন্ডিয়া অ্যানসার'কেও রাখতে হবে। মিস মেয়োর লেখা 'মাদার ইন্ডিয়া'তে ভারতকে হেয় প্রতিপন্ন করায় তিনি এই বইটি পাল্টা প্রতিবাদ হিসেবে লিখেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী প্রথম ইংরেজিতে লিখেছিলেন এই ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়। বইটির নাম ছিল, 'দ্যা ফেস অফ সাইলেন্স'। পাশ্চাত্যে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মাহাত্ম্য প্রচার করা হয়েছে এই The Face of Silence (১৯৩০) বইয়ের মাধ্যমে। এটি পাঠ করেই ফরাসি মনীষী রোমাঁ রোলাঁ রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের জীবনী রচনায় উৎসাহিত হন। ১৯৩০ এ লিখলেন, 'দ্যা পাথ অফ প্রেয়ার'। তখন তিনি উপার্জনহীন, অবসাদগ্রস্ত। ধ্যান আর প্রার্থনা ছিল তাঁর সঙ্গী তখন। এছাড়া ভারত নিয়ে তিনি লিখেছেন, 'ভিজিট ইণ্ডিয়া উইথ মি' বইটি। 

এই মহামানব দেশহিতৈষী মানুষটি চিত্রশিল্পী এথেল রে ডুগানকে বিয়ে করে আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিলেন। ভারতে এসেছিলেন দুবার (১৯২২ এবং ১৯৩০ সালে)। এইসময় তিনি বেলুড় মঠে থেকেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি শিবানন্দ স্বামীর শিষ্য ছিলেন। মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে অবশেষে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

Post a Comment

0 Comments