জ্বলদর্চি

কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা নিয়ে কলম ধরেছেন/কবি গৌতম বাড়ই

কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা নিয়ে কলম ধরেছেন কবি

গৌতম বাড়ই 


কীলক লিপি নিয়ে প্রসঙ্গান্তরে আর যাচ্ছি না। আজ থেকে পাঁচ- ছয় হাজার বছর আগে সুমেরীয় সভ্যতার ব্যবহৃত কিউনিফর্ম লিপি। সম্ভবত এ পৃথিবীর প্রাচীনতম লিখন পদ্ধতি। 

এ কাব্যগ্রন্থের নামকরণের মধ্যে তাই প্রথম থেকে এক কৌতূহল জড়িয়ে ছিল। কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীর সমস্ত কবিতা বা কাব্যচেতনার মধ্যেই আছে এক বহুত্বের সন্ধান। একদম ছোট আকারের কাব্যগ্রন্থ , সাকুল্যে চল্লিশটি ছোট আকারের কবিতা। কিন্তু পড়তে গিয়ে আমায় দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়তে হয়েছে। যত পড়ছি আমি তত যেন এই বিশ্ব থেকে মহাবিশ্বের পথে অতিক্রম করতে লেগেছি। কীলক লিপি বা বাণমুখী লিপির মতন শব্দচেতনার তিরগুলি এক এক করে ছুটে গিয়েছে আর উথাল পাথাল হয়েছে আমার ঘোরের ব্রহ্মাণ্ডে। আমাকেও ছিন্ন ভিন্ন করেছে গভীরে। কবি এই বিশ্বকে টুকরো টুকরো করে দেখেছেন বা দেখছেন বিভিন্ন আকৃতিতে, হয়ত আমাদের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করতে, যদিও দূরূহ তা। আমরা কী আজও পেয়েছি এ মহাবিশ্বের মাঝে আমাদের স্পেস বা অবস্থান? কবি সেই চেতনা বোধের মধ্যেই হয়ত কবিতাগুলো লিখে গিয়েছেন স্বীয় ভাষার লিপিতে কিন্তু চেতনায় খেলা করে গিয়েছে সুমেরীয় সভ্যতার কিউনিফর্ম লিপি। ত্রিভুজ, বৃত্ত, সেমিকোলন, গুণ, ভাগ, যোগ, বিয়োগ জীবনের সমস্ত হিসেবের অপরিহার্যতা রয়েছে শব্দে শব্দে ছড়িয়ে। কবি ও সম্পাদক ঋত্বিকবাবুর একটি বাক্যবন্ধ পেলাম যা আমার খুব প্রিয়- " চেয়েছি বলেই দেশ নইলে একটাই পৃথিবী হয়।" এই কাব্যগ্রন্থের 'সংজ্ঞার বিপরীতে ' কবিতাটিতে আছে। এ এক অমোঘ সত্য। এখানে আবার বহুত্ব থেকে এককে ফিরে আসবার ভাবনা। 

তিরের ফলার মতন এদিকে ওদিকে ছুটছে ভাবনাগুলো। এ কী উপনিষদের চেতনা থেকে সৃষ্টি? মন্ত্র এবং কবিতা এক হয়ে গিয়েছে বিশালত্বের বোধে। বিশ্বব্যাপ্ত ঈশ্বরের বোধ সমস্ত সাম্প্রদায়িক চেতনার ওপরে। অসত্য থেকে সত্যের পথে নিয়ে চল, তমসা থেকে জ্যোতিতে এবং মৃত্যু থেকে অমরত্বে এই প্রার্থনা মানুষের ইতিহাসের নিরন্তর প্রার্থনা।
 সংগ্রহ করতে পারেন 👇
তাঁর কবিতায় বারবার তাই ফিরে ফিরে এসেছে সেই অমৃত ভাবনা। এই মনুষ্য নশ্বর জীবন ছায়ামাত্র আমাদের, খুব ক্ষণিকের। তাই তো তার পাড়ি বৃহতের সন্ধানে। 

তার কয়েকটি উল্লেখ করছি:

১) আশ্চর্য নততল: আমার এখন আর কোনও দুঃখ নেই --------- কিংবা কোনও দুঃখই দুঃখ নয় এখন আমার
২) মহাকবির ব্যঞ্জনা :হতে পারে তিনবাহু তিনসত্তা...
৩) মানুষের কথা: মানুষের কথা ততটাই যতটা বৃত্তের পরিধি....
৪) অলৌকিক প্রকল্প: কখনও কখনও আমার বুকে হাত রেখে শুয়ে থাকে আমার ছেলে...
৫) কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা: কর্ষণ অযোগ্য জেনেও গড়ে ওঠে ভূমি ও ভূমা.....

ত্রিভুজ শব্দটি অনেকবার এসেছে তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে । আসলে কীলকলিপির চেতনার মধ্যেই তো গ্রথিত রয়েছিল  ত্রিভুজের ফলা। আর ত্রিভুজ নামকরণেও রয়েছে একটি গোটা কবিতা। যেখানে কবির স্বউচ্চারণ-" অবশ্যম্ভাবী ত্রিভুজের কাছে রেখে দিতে পারি ঋতু বদলের সমস্ত পাপ সমস্ত মুগ্ধতা। তিন ( বা ত্রি)  শব্দটিও যথেষ্ট ব্যাঞ্জনাময় , বারবার ব্যবহৃত হয়েছে ঋত্বিক ত্রিপাঠীর এ কাব্যগ্রন্থে।

বইমেলার অন্তিম সময়ে হাজির হয়ে সিগনেটের স্টল থেকে এই কাব্যগ্রন্থটি সংগ্রহ করি। এই কাব্যগ্রন্থ গভীর অধ্যয়নের। এর গভীরতার তলদেশ খুঁজে পাওয়া খুব সহজ নয়, বলতে গেলে এই দূরত্ব ছোঁয়া প্রায় অসম্ভব। বারবার পড়ে নিজের বোধের দর্শনে এই কাব্যগ্রন্থটির আলোচনা করলাম। কবিকে ধরতে চাওয়া মূর্খামি, নিজেকেই শব্দেরকীলকে খুঁজে পেতে নিতে চেয়েছি। কবিতা পাঠক মাত্রেই , অন্তত যারা একটু সিরিয়াস পাঠক— এই অপূর্বলেখনীর কাব্যগ্রন্থটি সংগ্রহ করতে পারেন। অভিনন্দন রইলো কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠী-কে।

🍂


Post a Comment

0 Comments