জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—জাপান (এশিয়া)সপ্তম ভগিনীর ভাগ্য /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—জাপান (এশিয়া)
সপ্তম ভগিনীর ভাগ্য
চিন্ময় দাশ

অনেক দিন আগের কথা। সাতটি মেয়ে থাকত জাপানের ছোট্ট একটা দ্বীপে। সাত জন বোন তারা। সাত জনই অনাথ। মা-বাবা গিয়েছিল সমুদ্রে মাঝ ধরতে। হঠাৎ ঝড় উঠেছিল। ডিঙিনৌকা উলটে, দুজনেই মারা যায়। 
বড় ছ’টি বোন মহা ধুরন্ধর। ছ’জন মিলে অত্যাচার করে ছোট বোনটার উপর। সাতজনের সংসারে কাজকর্ম কম নয়। সব কাজই তারা ছোট বোনকে দিয়ে করায়। ঘরদোর সাফ করো। বন থেকে জ্বালানি জোগাড় করে আনো। রান্না করে খাওয়াও। কাপড়-চোপড় কেচে আনো। তার সাথে ছ’জনের ছোটখাটো ফাই-ফরমায়েস তো আছেই। 
নিজেরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে বেড়ায়। হাসি-ঠাট্টা, হৈ-হুল্লোড় লেগেই আছে ছ’জনের। ছোট বোনটা খেটে মরে। তাতেও মন ভরে না তাদের। ছোট বোনটি তাদের দু’-চক্ষের বিষ। একজনও তাকে দেখতে পারে না।
এক দিন বনে কাঠ কুড়োতে গিয়েছে মেয়েটি। পাশেই নদী। ছোট ভাবল, আজ নদীতে স্নান করে নিই। শরীরটাও সাফসুতরো হবে একটু।
নদীতে নেমেছে, দেখে ছোট্ট একটা রঙীন মাছ তার সামনে। দু’হাতের আঁজলায় তুলে নিয়েছে মাছটাকে— আরেব্বাস! তুই মাছ, না কি আকাশের রামধনু? রঙের কী বাহার তোর!
মাছের চোখে তো পলক পড়ে না। সে চেয়ে আছে মেয়েটার দিকে। ছোট বলল—কিন্তু বড্ড রোগা রে তুই। ভালো করে খেতে পাস না, মনে হয়। দাঁড়া, তোর খাবারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি আমি। 
মাছটা আঁজলায় ধরা । নদীর জল ছেড়ে উঠেই, লম্বা এক ছুট। একটা পুকুর ছিল পাহাড়ের তলায়। সেই পুকুরে গিয়ে ছেড়ে দিল মাছটাকে। বলল—এখন থেকে এখানেই থাকবি তুই। আমি তোর খাবার দাবারের ব্যবস্থা করে দেব। 
আবার দৌড় লাগিয়ে ঘরে ফিরে এলো মেয়েটা।
ছ’জন বোনের খাওয়া সারা হলে, যা পড়ে থাকে, তাই জোটে ছোটর কপালে। নিত্য দিন তা থেকেই একটু খাবার সরিয়ে রাখে সে। পুকুরে গিয়ে মাছকে খাইয়ে আসে। তাতে মাছটা হৃষ্ট-পুষ্ট হয়ে উঠছে। আর, বড়ও হচ্ছে সেই সাথে।
বড় বোনেদের কেমন একটা সন্দেহ হতে শুরু করেছে। প্রতিদিন খাওয়া শেষ করে কোথায় যায় মেয়েটা? কৌতুহল বড় ভয়াণক জিনিষ। একদিন চুপিসারে ছোটর পিছু নিয়েছে তারা। পুকুরে নেমে মাছকে খাওয়াচ্ছে ছোট। পিছনে তার বোনেরা যে পাড়ে দাঁডিয়ে আছে, জানবে কেমন করে?
মাছকে খাওয়ায় ছোট। গল্প করে। গায়ে মাথায় হাত বুলোয় মাছের। প্রতিদিন এভাবেই কিছুটা সময় কাটিয়ে যায় মেয়েটা। 
বড় বোনেরা যেমন এসেছিল, তেমনি ফিরেও গিয়েছে চুপি চুপি। পরদিন ছোটকে কাঠ কুড়োতে পাঠিয়ে দিল বড়রা। তারা গিয়ে পুকুর থেকে মাছটা ধরে এনেছে। কাটাকুটি করে, ভেজে খেয়ে ফেলেছে।
ছোট তো কিছুই জানে না। কিচ্ছুটি জানতে দেওয়া হয়নি তাকে। পুকুরে নেমে সে অবাক। মাছের দেখা নাই। দেখা নাই তো নাইই। হাতে খাবার নিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটা। মাছ এলো না। চোখের জল মুছতে মুছতে ঘরে ফিরে এল ছোট। 

🍂

বোনকে বিষন্ন দেখে, ছ’জনের ভারি মজা। মুখে মুচকি হাসি তাদের সবার। 
এভাবে ক’দিন গেল। ছোটর মন মরা ভাব কাটছে না। তা দেখে বোনেদের আরও মজা। তারা বলাবলি করছে—সারা জীবন মন মরা হয়েই থাকতে হবে ওকে। মাছটা যে আমরাই ভেজে খেয়েছি, জানতেই পারবে না কোনদিন।
আর একজন বলল—কাঁটাগুলো যে বাগানের কোণে পুঁতে দিয়েছি আমরা, সেটাও জানতে পারবে না ও।
খাওয়া-দাওয়ার পর, বোনেরা গল্প করছিল। রান্নাঘর নিকোতে গিয়ে কথাগুলো শুনতে পেয়ে গেল ছোট। ভীষণ কষ্ট হোল তার। এমন কাজ কী করে করতে পারল এরা? এত সুন্দর একটা মাছকে মেরে ফেলতে হাত উঠল কী করে। চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল তার।
বাগানে মাটি খুঁড়ে মাছের কাঁটাগুলো পেয়ে গেল ছোট। তুলে নিয়ে সেই পুকুরের পাড়ে পুঁতে দিয়ে এল কাঁটাগুলোকে। বনে কাঠ কুড়াতে যায়। নদীতে স্নান করে ঘরে ফিরবার আগে, একবার পুকুরের পাড়ে যায় নিয়ম করে। কিমোনো (জাপানের মেয়েদের পোষাক)-এর জল নিংড়ে দিয়ে আসে গর্তটাতে। 
একটা অবাক করা কাণ্ড ঘটল তাতে। ক’দিন যেতে না যেতেই, সুন্দর একটা গাছ গজিয়ে উঠল সেখানে। গাছটা বাড়তেও লাগল খুব দ্রুতই।
আরও অবাক কাণ্ড ঘটল, গাছটা একটু বড় হতেই। গাছের কাণ্ডগুলো হোল লোহার। পাতাগুলো সোনার। আর, ফল? সেগুলো সবই মুক্তোর।
সমুদ্রে ঘেরা দেশ। মাঝে মাঝেই ঝড় ওঠে এদেশে। একদিন তেমনি ঝড় উঠেছে। প্রবল ঝড়। সেই ঝড়ে গাছটার একটা পাতা ছিঁড়ে, উড়তে উড়তে গিয়ে পড়েছে পাশের এক দ্বীপে। সে দেশের রাজার ছেলের চোখে পড়ে গেল পাতাটা। 
সে ছেলে তো অবাক। ভাবতেই পারছে না, গাছের পাতা সোনারও হতে পারে! কোথায় আছে সেই দেশ? খুঁজে বের করতেই হবে আমাকে। নিজের চোখে দেখা দরকার আশ্চর্য গাছটাকে। 
জলে জাহাজ ভাসল রাজাকুমারের। এই দ্বীপে খোঁজ করে। ওই দ্বীপে খোঁজ করে। কোথাও গাছের দেখা নাই। যখন একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়ার জোগাড়, তখন জাহাজ এসে ভিড়ল সেই দ্বীপটাতে। খুঁজতে গিয়ে পেয়েও গেল গাছের দেখা। পাহাড়ের তলায়, একটা পুকুরের পাড়ে, দাঁড়িয়ে আছে গাছটা।
রাজার ছেলে তো আনন্দে আটখানা। এবার তার খোঁজ শুরু হোল—কার গাছ এটা? কে লাগিয়েছে? 
কিন্তু আশেপাশে কোন গ্রাম নাই সেই পাহাড়তলিতে। লোকজনের দেখা পাওয়া যাবে কী করে? শেষে এক রাখাল ছেলের সাথে দেখা। রাজার ছেলে বলল—এই গাছটা কে লাগিয়েছে, জানিস কিছু?
রাখাল বলল—না, হুজুর। আমি জানি না। তবে, সাত বোনের কাছে খোঁজ করলে, হয়তো তারা বলতে পারবে।
রাজার ছেলের লোক এসে হাজির হোল সাত বোনের বাড়িতে—চলো তোমরা। রাজকুয়ার ডেকে পাঠিয়েছে।
রাজকুমার ডেকে পাঠিয়েছে! শুনেই ছ’জন বোন আনন্দে ডগমগ। ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হয়ে গেল রাজার সামনে। কিন্তু উত্তর দেবে কী, এমন আশ্চর্য একটা গাছ দেখে তারাও অবাক। এই পুকুরে তারা দু’-দু’বার এসেছে। কিন্তু এমন গাছ তো ছিল না এখানে!
রাজা বলল—তোমরাও যে সংবাদ জানো না, দেখেই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তোমরা তো দেখছি, ছ’জন এসেছ। কিন্তু সপ্তম, মানে সাত নম্বর বোনটি কোথায় তোমাদের? তাকে আনোনি কেন?
রাজকুমারের লোক আবার ছুটল গ্রামে। ছোট বোনকে ডেকে আনা হোল। সে এসে গাছের তলায় দাঁড়াতেই, আর এক অবাক কাণ্ড। গাছের ডালগুলো নুয়ে পড়ল মাটির দিকে। ছুঁয়ে দিল মেয়েটিকে। মেয়েটিও হাত বুলোতে লাগল পাতার গায়ে, ডালের গায়ে।
রাজকুমার অবাক চোখে দেখে যাচ্ছে ব্যাপারটা। দেখতে দেখতে, দেখতে দেখতে কোথায় গেল দুঃখিনী মেয়ের চেহারা! অপরূপ সুন্দর এক রাজকুমারির চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছের তলায়। 
রাজাকুমারের তো আনন্দ ধরে না। মেয়েকে বলল—চলো তুমি আমার সাথে। তোমাকে বিয়ে করব আমি। আমাদের রাজ্যের রানি হয়ে থাকবে তুমি।
জাহাজ ভাসল সাগরে। উতল হাওয়া এসে পালে লাগল। সাগর পাড়ি দিয়ে রানি হতে চলল ছোট বোনটি। তার আঁধার জীবনে সূর্য উঠতে চলেছে আজ। 
আর, বাকি ছ’জন? ভেসে যাওয়া জাহাজের দিকে তাকিয়ে, তারা ভেবেই যাচ্ছে, কতো ভুলই না করেছে তারা!

Post a Comment

0 Comments