জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় /দ্বাদশ পর্ব/আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
দ্বাদশ পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

পরের সকালে বাড়িতে তুমুল হৈ চৈ। তারার শ্বশুর বাড়ি থেকে পালকী এসেছে, মেয়ে পাঠাতে হবে। 
ভোর রাত থেকে রান্নাঘরে মায়েদের কসরৎ; কড়া ভর্তি গরম তেলে গুড়পিঠে ছাঁকা হচ্ছে, ঘরের নারকেল কুরিয়ে খোয়া মিশিয়ে নাড়ু বানানো চলছে, সুগন্ধি বাসমতী চাল জলে ভিজিয়ে, শিলে বেটে নাদভাঙা আখের গুড় আর নারকেল পাকের সুমধুর মালপোয়া আর পাটিসাপটা তৈরি হচ্ছে নরম আগুনে। টাটকা ঘীয়ের গভীর সুগন্ধে বৈশাখী সকাল আনন্দময়। 

বিরজাও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে তৈরি, নতুন শ্বশুরবাড়ি যাবে যে। কলকাতা থেকে পাঠানো নতুন লাল টুকটুকে ঢাকাই শাড়িটি পরিয়ে পা দুখানি আলতায় রাঙিয়ে দিয়েছে বৌদিদি, তার ওপরে রূপোর তোড়া,আঙুলে আঙট। 
বলতে নেই,ছোট থেকেই ভীষণ ফর্সা রঙ তার।সবাই বলে, অন্ধকারেও নাকি দেখা যায় তাকে! আর এখন সিঁদুর পরে তো… 
খানিক পরে, হাতের কাজ সামলিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে জ্যাঠাইমা চিবুক ছুঁয়ে আদর করে বললেন, 
-’কি সুন্দর লাগছে তারাকে আমার। পা দুটি যেন ঠাকরুণের পায়ের মতো, এক্কেবারে যেন মা লক্ষ্মী!মুখ ফেরায় কার সাধ্যি! ’
কথাটি শুনেই পাকা গিন্নীর মতো ঘোমটাটি টেনে  হেসে উঠলো তারা, 
-’হুঃ! সে নাকি ঠাকরুণের মতো দেখতে!’
একবার যদি দেখতো সেই গম্ভীর ছেলে;তারও কি তাই মনে হতো! 
আচ্ছা! সেও কি এসেছে গাঁয়ে বাবা মায়ের সঙ্গে;নাকি আসেনি! পড়ার অজুহাতে থেকে গেছে কলকাতাতেই… 
দাওয়ার পাশের শিরীষ গাছটির ঝলমলে নতুন পাতাগুলির দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিল ছোট্টো মেয়েটি। ঘোর ভাঙলো বৌদিদির ডাকে, 
-’কি ভাবছো গো ঠাকুরঝি? ঠাকুর জামাইয়ের কথা মনে পড়ছে নাকি!’
বলে না বলেই খিলখিল হেসে গলা জড়িয়ে ধরলে নওলকিশোরী, আজকের হিসেবে সে নাবালিকা হলেও ইতিমধ্যেই স্বামীসঙ্গের সৌভাগ্য তার হয়েছে। তাই বয়সে ছোটো নববিবাহিতা ননদিনীকে খানিক রঙ্গ রসিকতা করার অধিকার তার জন্মেছে বৈ কি! 
আজকের দিনে এমন সব কথাবার্তা অবান্তর মনে হলেও, তখনকার দিনে গ্রামেগঞ্জে এমন ধারা রীতি কানুন চলতো; মেয়েদের জীবন যেহেতু একেবারেই গৃহ কেন্দ্রিক ছিল, তারা নিজস্ব জগতে নিজেদের মতো কল্প জগৎ গড়ে তুলতো, যার শুরু হতো পুতুল খেলা দিয়েই। পরে পরে যথারীতি সংসার যাপন… গার্হস্থ্য, দাম্পত্য, সুখ-অসুখে নিত্য বহমান জীবনতরী… তবু তার মধ্যেও থাকতো এমন সব আনন্দের স্বচ্ছতোয়া আয়োজন। আর থাকতো বলেই জীবন একঘেয়ে ঠেকতো না, একথা জীবন দিয়ে বুঝেছেন, মনে রেখেছেন বিরজাসুন্দরী। 
তা নইলে, জীবনের প্রান্তবেলায় এসেও কেন সেসব স্মৃতি মনের মনিকোঠায় উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে রাখবে! কেন আজও শিরীষ গাছের ঝরা পাতার হিন্দোলে মনে পড়ে যাবে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময়কার সেই অঘটনের কথা! 
হয়েছিল কি, সাজিয়ে গুছিয়ে দুটি মাছ ভাত খাইয়ে জ্যাঠাইমা তারাকে তুলতে এসেছেন বাইর উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা পালকিতে, কাহারেরা গুড় মুড়ি খেয়ে বিশ্রাম সেরে তৈরী… পেছনের গরুর গাড়িতে সাজানো হচ্ছে তত্ত্ব:সকাল থেকে বানানো পিঠেপুলি, সুগন্ধি চাল, ঘি, বড়ি, সবজি, পুকুরের মাছ আরও নানাবিধ কতো কি! হঠাৎ কোথা থেকে একটা কালো বিড়াল এসে কামড় দিলে তত্ত্বের ঝুড়িতে থাকা রুইমাছের  এক্কেবারে মাথায়! 
🍂

কাহারেরা লাঠি নিয়ে রৈ রৈ করে তার দিকে দৌড়ে যেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে একবার ম্যাও বলে গর্জন করেই পুকুর ধারে উধাও হয়ে গেল। কেউ তাকে আর দেখতে পায়নি। কোথা থেকে যে এলো, কি করে যে ওখানে গেলো, কোথায় যে আবার পালালো, কেউ কিচ্ছু বুঝতেই পারলো না। কারণ, ঐ ধরনের কোন কালো বেড়াল গ্রামে ছিলো না, শ্বশুর বাড়ির পালকিতে চড়ে যে আসবে, তেমন কথাও নয়। 
তবে এসেছিল এবং মাছের ঝুড়ি উল্টে মাছ এঁঠো করে দিয়েছিল। সময়ও ছিলোনা নতুন করে জাল ফেলে পুকুর থেকে মাছ তুলে পাঠাবার;সুতরাং তত্ত্ব অসম্পূর্ণ রইলো। 
একে ধর্মনিষ্ঠ গোঁড়া বাহ্মণ পরিবার, তায় মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার মুখে এমন অঘটন এবং বার তিথির শুভলগন পার হয়ে যাওয়ার ভয়… তিন ত্রহ্যস্পর্শে বাড়ির গুরুজনেরা তখন প্রায় দিশেহারা এবং সন্ত্রস্ত। 
হাল ধরেছিলেন সে মুহুর্তেও জ্যাঠাইমা, তাড়াতাড়ি মাছের ঝুড়ি সরিয়ে গোবর লেপে জায়গাটি শুদ্ধ করে, দুগ্গা দুগ্গা বলে মেয়ে বিদায় করেছিলেন,কানে কানে বলে দিয়েছিলেন, 
-’এসব কথা যেন আবার কাউকে বলে বসিস না মা!
সব কথা সবসময় সবাইকে বলতে নেই!’
হয়তো নিজের সংসার হয়নি,সম্পুর্ণ আত্মিক পারিবারিক যাপনও সম্ভব হয়নি বিরজার; তবু অগ্রজার শিখিয়ে দেওয়া সেই প্রাতঃকালীন জীবনপাঠ তিনি ভোলেননি, আর ভোলেননি বলেই আজ আগাছা হয়েও ওষধি জীবনকৃতিত্ব তাঁর আয়ত্তাধীন।
 কে বলে, সাধারণ গৃহস্থ ঘরে মেয়েদের কথা বা ভূমিকা পরিবারে নগন্য ছিল!
আসলে, ব্যতিক্রমী কিছু মানুষ তো থাকেনই সমাজে এবং সংসারে, সেকালে ছিলেন, এ কালেও আছেন, হয়তো আগামীতেও থাকবেন, যাঁদের অস্বীকার করা যায়না, বাঁধাও যায় না কোন ছকে। জ্যাঠাইমা ছিলেন তেমনই একজন, সাধারণী হয়েও অসাধারনী… 

পরবর্তী জীবনে, কখনই এসব কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেননি বিরজা, আর সেই ছোট্টো মেয়েটির তো সেসব বোঝার বয়সই হয়নি তখনও;শুধু শুনেছিল অন্ধের মতো জ্যাঠাইমার কথা, বলেওনি কাউকে সেকথা, তবু এড়ানো যায় নি দুর্ভাগ্য।
তাই কালো বেড়ালের সেই জ্বলন্ত চোখদুটি জেগে আছে আজও মনে… তারপর থেকে সারাজীবন যখনই সাঁঝ আঁধারে কালপেঁচার কুবকুব ডাক ভেসে এসেছে মাঠপারের হাওয়ায় অথবা কালো বেড়াল হেঁটে গিয়েছে সামনে দিয়ে, কেমন যেন এক অমঙ্গল আশঙ্কার মেঘ ছেয়েছে মনের আকাশে; যুক্তিবাদী মন যার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি কখনও। মনে মনে ওড়ে বেড়ায় নিবিড় অসহায়তা! কি যেন ছিলো, থাকারও ছিল, তবুও নেই.. 

আদিগন্ত চক্রবালে ওড়া, শঙ্খচিল সুখের ব্যথা জানে
 তাই বুঝি ঐ অসম্পৃক্ত দূরে,কাছে থেকেও 
অধরা রয়ে যায়,অনপনেয় উদাসী অভিমানে
         মঙ্গলের চরণ ছুঁয়ে অমঙ্গলের পারে
          আকাশমেঘে ভ্রুকুটি ছায়া যখন এসে নামে
    একলা রাতে চোখের পাতায় কাঁদন লেখা হয়…
এই জীবনের আগাছা দুখও ওষধি সুখে ভাসে!

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments