জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব- ৭/স্বপন কুমার দে

চিত্র- শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ৭

স্বপন কুমার দে

অবিনাশবাবু পার্টির  মাঝারি মাপের নেতা। দলের ভেতরে এবং এলাকায় তাঁর খুব প্রভাব রয়েছে। তাঁরই ছোট ছেলে সুজন প্রমোটারি ব্যবসায় বেশ হাত পাকিয়েছে। বাবার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে রমরমিয়ে চলছে ব্যবসা।  শহরেউঠছেবিশালবিশালবহুতলফ্ল্যাটবাড়ি। প্রচুর টাকার লেনদেন এই ব্যবসায়। মুনাফার পরিমাণও অনেক। সুজনের দাদা বিজনের রয়েছে বিল্ডিংস মেটেরিয়ালের ব্যবসা। দুজনের ব্যবসার মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। যেদিক থেকেই হোক পয়সাটা এক জায়গাতেই ঢোকে। ঝক্কি ঝামেলাও আছে। সেসব ক্ষেত্রে দরকার পড়লে অবিনাশবাবু মাঠে নামেন। অনেক জলা জায়গাও রাতারাতি ভরাট হয়ে যায়।

সুজনদের বাড়িতে দুটো ফোর হুইলার, - একটা তার বাবার, পার্টির কাজে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। একটা সুজনের, ব্যবসার খাতিরে যখন তখন কাজে লাগে। এছাড়াও তিনটে বাইক। সুজন অবশ্য বেশিরভাগ সময়ই বাইকে ঘোরে।

সুজনের বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা দেওয়ার ঠেক আছে। তার মধ্যে একটা আছে মল্লিকাদের পাড়ায়। ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে যখন তখন ফিস্ট করে। এই  তো কিছুদিন আগে একটা নতুন ক্যারমবোর্ড কিনে দিয়েছে। সুজনের দৃষ্টি আছে মল্লিকার উপর। এজন্য সে লোকও লাগিয়েছে কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি।

সেদিন সন্ধ্যেবেলায় ক্লাবঘরে আড্ডা দিচ্ছিল। নেশাটাও অল্প অল্প জমে উঠেছে। হঠাৎ বলে ওঠে," কিরে নেপাল, কী খবর? মহারানী কিছু ইঙ্গিত দিল?"
না গো,সুজনদা, ব্যাপারটা সহজ নয়। এসব নিয়ে ও পাত্তাই দেয় না। ওর একটাই জেদ ওকে পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে।"
কথাটা শুনে চোখ দুটো বড় বড় করে সুজন, " কী নিয়ে পড়ছে রে?"
" শুনেছি, ম্যাথ অনার্স পড়ছে। "
" তা পড়ুক। কে বারন করছে? খরচ আমি দেবো।আমাকে কেবল একটু আধটু সময় দিতে হবে।" একটু থেমে দুটো বাদামভাজা মুখে ছুড়ে দেয়। তারপর আবার বলতে থাকে, " এতে বরং ওরই লাভ হবে। আমার ছায়ায় থাকলে ওকে কেউ ডিসস্টার্ব করবে না। শুধু লেবেলটা পড়লেই হলো।"
বিষয়টা অন্য ছেলেদের পছন্দ হলো না। হাজার হোক মল্লিকা এই পাড়ারই মেয়ে, কাজেই তারা প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দেয়। এক সময় আড্ডা ভাঙে। যে যার বাড়ি চলে যায়। রাত বাড়ে, ক্রমশ নির্জন হয় পাড়ার গলিটা। স্ট্রিট লাইটের আলো সব জায়গায় পৌঁছায় না। কিছু কিছু জায়গা খুব অন্ধকার। অন্ধকারকে ভয় পায় মল্লিকা। কিন্তু এটাও বুঝেছে অন্ধকারের ভেতর দিয়েই লড়াই করেই তাকে আলোর সকাল খুঁজতে হবে। আলো চাই, আকাশ চাই, জীবন চাই। অন্ধকারকে ভয় পেলে চলবে না।

রাত আরও বাড়ে। কিন্তু মল্লিকার চোখে ঘুম নেই। একান্ত নিষ্ঠা ও মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে যায়। সে জানে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প হয় না এবং এই পরিশ্রমের সুফল একদিন সে পাবেই। রাত্রি যতই গভীর হোক একদিন ভোর হবেই। আবার সূর্য উঠবে। সে সেই প্রভাতের অপেক্ষায়।

সকাল হয়। ঘুম ভাঙে ব্যস্ত শহরের। সূর্যের আলোয়,মানুষের ব্যস্ততায়, চারদিকের চিৎকারে সকাল হয়। ধীরে ধীরে বেলা বাড়ে। সাংসারিক কাজকর্ম, টিউশন সেরে মল্লিকা কলেজে হাজির হয়। এভাবেই জীবন গড়িয়ে চলে। এর মাঝখানে কত নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়, কত মন দেওয়া নেওয়া।  কত পুরানো সম্পর্ক ভেঙে যায়, কত নতুন সম্পর্ক তৈরি হয়। পড়াশোনার বাইরেও শুনতে পাওয়া যায় কত গল্প, কত কাহিনী।
🍂

আজ টিফিন পিরিয়ডে বিপাশা নিজের উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে খবর দিল," মল্লিকা, তোর তো চওড়া কপাল রে!"
" কই না তো।এই তো তোদের মতোই। "
" না রে, আমি ঐ কপালের কথা বলছি না।আমি বলছি ভাগ্যের কথা। অবিনাশবাবুর ছেলে সুজনদা"  তোর প্রেমে পড়েছে। জানিস,ওদের কত টাকা?"

রাগে মল্লিকার মুখ চোখ বিকৃত হয়ে উঠেছিল। তবু কিছুটা সংযত থেকে বিদ্রূপের সঙ্গে বল ," ওহ্ ,তুই কি আজকাল এইসব কাজও করছিস নাকি? তা, এক  কাজ কর না,আমার আমার বদলে তুই রাজি হয়ে যা না। তাহলে,নিজের ভাগ্যটাও খুলে যাবে।"
" কি যে বলিস্, তোর মতো কি আমি সুন্দরী? ওরা রূপ খোঁজে।"
" নিজেকে এতটা সস্তা ভাবতে তোর লজ্জা করলো না? নিজের মান সম্মান সব খুইয়ে বসে আছিস।" মল্লিকা রাগে ফুঁসতে থাকে। উত্তরে আমতা আমতা করতে থাকে বিপাশা। মল্লিকার ইচ্ছা করছিল দুটো চড় কষিয়ে দেয় বিপাশার দু'গালে। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে বলল," শোন,তোকে একটা কথা স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, তুই এই ধরনের কথা আমাকে আর কখনও বলবি না। আর ঐ লোকটাকেও বলে দিবি, আমার পেছনে যেন না ঘোরে।নাহলে, ওর ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে।"

খবরটা সুজনের কানে পৌঁছায়। কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায়, সিগারেট ধরায়। ধোঁয়ার গোল গোল কুন্ডলী ছাড়তে থাকে। মনের মধ্যে একটা জেদ ক্রমশ চাপতে থাকে। চালচুলোহীন একটা গরিবের মেয়ের এতটা আস্পর্ধা হয় কী করে? এত টাকা আছে তার, সম্পত্তি, ব্যবসা, বাবার প্রভাব-- এতকিছু তার আয়ত্তে ।আর সামান্য একটা মেয়ের কিনা এত তেজ, এত দম্ভ। প্ল্যান কষতে হবে,হাতি ধরার ফাঁদ বানাতে হবে। ধরা সে দেবেই।দিতে বাধ্য।

                              * * * * *

পরপর দু'দিন ছুটি কাটিয়ে রূপসা আবার কাজে ফিরল।অদ্ভূত প্রাণ চঞ্চল মেয়ে এই রূপসা। কখনও পাহাড়ি নদীর মতো খরস্রোতা। সারাদিন কল্ কল্ করে বয়ে চলেছে, বিশ্রাম নেই। কখনও বা গাম্ভীর্যে অতি পুরাতন বড়সাহেবকেও হার মানায়। দারুণ উৎসাহী আবার কাজের প্রতি গভীর মনোযোগী। এক নাছোড়বান্দা মনোভাব রয়েছে তার মধ্যে। প্রতিটি পেপার খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস আছে। ফাইল পেন্ডিং রাখতে ভালোবাসে না। তাই রূপসা বড়সাহেবের একটা ভরসার জায়গা। অফিসে যখন আসে তখন সাজগোজ খুব সাধারণ। সাধারণ পোশাকেও যে অসাধারণ সৌন্দর্য থাকে তা তার কথায়,আচরণে প্রকাশ পায়। এমন একজনকে বন্ধু হিসাবে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার এবং অন্যদের চোখে ঈর্ষার কারণ।

টিফিন আওয়ারে কথা বলার সুযোগ পেল সম্পূরক। একটা অদ্ভূত খুশির আবেশ তার চোখে মুখে। কথা বলতে বলতেই সম্পূরক অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল। আজ সকাল থেকেই অফিসে প্রচুর কজের চাপ ছিল। কেউ কারো দিকে দেখবার ফুরসত পাচ্ছিল না।
প্রথমেই সম্পূরক রূপসার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে নিয়েছিল, বলল," কবে ফিরলে?"
" কাল সন্ধ্যায়।"
এই পর্যন্তই, তার বেশি নয়।এখন আধ ঘণ্টা টিফিন আওয়ার। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সবাই কথা বলছিল। এতজনের মাঝে 'স্পেশাল' কথা বলা উচিত নয়। সাধারণ কথা, সবাই একসঙ্গে টিফিন করতে গেলে যেমন হয় আর কি। কেবলমাত্র এই কথাটাই সম্পূরক নীচু স্বরে জানাতে পেরেছিল, "আজ একসঙ্গেই বাড়ি ফিরবো।" প্রত্যুত্তরে 'হ্যাঁ ' বা ' না' কোনো কথাই অপর প্রান্ত থেকে শোনা যায় নি।তবুও সম্পূরক পাঁচটায় অফিস থেকে বেরিয়ে দেখতে পেল, রূপসা তার জন্য অপেক্ষা করছে।

একটা ফাঁকা টোটোয় ওরা দু'জন উঠল। গন্তব্য, সম্পূরকের ইচ্ছামতো একটা কফি শপ। একটা টেবিলে ওরা মুখোমুখি বসল। অর্ডার দেওয়া হয়েছে  সম্পূরকের পছন্দ মতো। সম্পূরককে আজ অনেকটা ফুরফুরে দেখাচ্ছে। রূপসার সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে পেরে তার চোখে মুখে তৃপ্তির আনন্দ।
" এই দু'দিন কেমন কাটলো?" সম্পূরকই আরম্ভ করলো।
" খুব এনজয় করেছি। উৎসব অনুষ্ঠানে যেমন হয় আর কি। অনেক চেনা অচেনা আত্মীয় এসেছিল, তাদের কথা আলাদা আলাদা করে কী বলবো। এত ভালো লাগছিল যে, মনে হয়েছিল আরও দু'চারদিন থেকে যাই।"
" তা রইলে না কেন?"
" ছুটি ছিল না যে।"
সম্পূরক দেখল যে,তার প্রতি টান তাহলে প্রধান কারণ নয়। অফিসের তাড়ায় মাত্র দু'দিন। 'সত্যি' গোপন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
" কী হলো সম্পূরক, হঠাৎ চুপ হয়ে গেলে কেন?"
" না, মানে, আমার কথা মনে হয়নি?"
" তা হবে না কেন? তবে তুমি তো আমার সবদিনের বন্ধু।তা বলে,নতুনদের বাদ দেবো কেন? অবশ্য তাদের মধ্যে একজন....না, বলবো না।"
গম্ভীর হয়ে যায় সম্পূরক। খিল খিল্ করে হেসে ওঠে রূপসা," কী ব্যাপার, রাগ হচ্ছে নাকি?"
" রাগ হওয়াটা কি অন্যায়?"
সম্পূরকের পিঠে একটা কিল মেরে রূপসা বলে," শোনো,তোমার চিন্তা করার কিছু নেই। আমি নতুন করে কিছু করলে তোমাকে জানিয়ে দেবো। তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলে,এখনও আছো। "
সম্পূরকের ডান হাত স্পর্শ করলো রূপসার বাম হাত। মনে মনে বলল," দিনের আলো নিভে গেলেও তোমার ভালোবাসার আলো আমার গভীর অন্ধকারেও আলো দেখাক। আমার মর্মবীণায় সুর উঠুক তোমার অঙ্গুলি চালনায়। আমার সকল সুখের সুখী,সকল দুঃখের দুঃখী হয়ে আমার অন্তর শতদলকে বিকশিত করো।"

মাঝখানে ওয়েটার দু'বার খাবার দিয়ে গেছে।ওরা খাচ্ছে অল্প অল্প করে কথা বলছে বেশি। এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছে। সম্পূরক কখনও বা অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছে। রূপসার কথা বলার ধরণ, তার হাসি,তার অনাবিল সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে পান করছে। এই মুগ্ধতাবোধ, ভালোলাগা সে অন্য কোনও মেয়ের কাছ থেকে পায়নি। তার মধ্যেও বুদ্ধির প্রখরতা আছে,কাজের দক্ষতা আছে, নিষ্ঠা, পরিশ্রম করার ক্ষমতা আছে,কিন্তু অপরকে মুগ্ধ করে তোলার ক্ষমতা নেই। রূপসা তার বান্ধবী,তার ভাবী স্ত্রী।তবে এ বিষয়ে কোনও কথাই সে রূপসাকে বলে উঠতে পারেনি।তার মায়ের কথাটা মনে পড়ে গিয়েছিল। তাই কিছুটা অস্ফুটে রূপসাকে বলল," আমার মা বলছিল আমাদের ব্যাপারে তোমাদের বাড়ির লোকের সঙ্গে আমাদের বাড়ির লোক কথা বলতে চায়। "
" কেন?"
" আমাদের বিয়ের ব্যাপারে।"
" ও...চলো এবার ফেরা যাক।"
সম্পূরক অবাক হয়ে দেখলাম,রূপসা তার কথার কোনও গুরুত্বই দিল না।
কফি শপ থেকে বেরিয়ে ওরা যে যার বাড়ির পথে রওনা দিল।

Post a Comment

0 Comments