উদয়ের পথে
মলয় সরকার
অষ্টম পর্ব
আকিহাবারায় ইলেক্ট্রনিক মলের ,যখন, বাইরে এলাম তখনও বৃষ্টি পড়েই চলেছে। চোখে তখনও যেন ঘোর লেগে রয়েছে।হঠাৎ ভগবানের বরের মত পেয়ে গেলাম এক খালি ট্যাক্সি। এখানে ট্যাক্সির মাথায় লাল আলো জ্বলার অর্থ ওটা খালি, সবুজ আলোর অর্থ ভর্তি। আগেই বলেছি,এখানে ট্যাক্সি থামলে নিজে দরজা খোলার নিয়ম নয়। ড্রাইভারই রিমোটে খুলে দেবেন, এটাই দস্তুর। কাজেই ট্যাক্সি এলে অপেক্ষা করাই নিয়ম।এখানেও চীনের মতই একটি সুন্দর নিয়ম , ট্যাক্সিতে টিপস দেওয়ার নিয়ম নেই। যা ভাড়া তাই নেবে ওরা। এক টাকাও বেশি নয়। চীনে দেখেছিলাম, খুচরো এক টাকাও ওরা ফেরত দেয়। ওদের ড্রাইভারদের দেখলেই সম্ভ্রম জাগে।
পরদিন সকালে বেশ চকচকে রোদ। আজ ছাড়তে হবে রাজধানী টোকিও। তাই এলাম, শুধু জাপানের নয়, পৃথিবীর ব্যস্ততম স্টেশন শিনজুকুতে।এই সেই শিনজুকু, যেখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছিলেন, বিখ্যাত বিপ্লবী , আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠাতা,বর্ধমানের রাস বিহারী বসু। এখানেই ছিল তাঁর শ্বশুরবাড়ি, যে বাড়ির মেয়ে তোশিকো সোমা ভালবেসে বরণ করেছিল এই বিপ্লবীকে।
১৮৮৫ সালে শুরু হওয়া এই স্টেশনটিতে এখন প্রতিদিন প্রায় ৩৬ লক্ষ মানুষ যাতায়াত করেন। এখান থেকে সব ধরণের ট্রেনই ছাড়ে। এই স্টেশনের প্রায় ২০০ টি বাইরে যাওয়ার দরজা আছে, প্রধান চারটি গেট ছাড়াও।এখানে বেশ কিছু আণ্ডারগ্রাউণ্ড প্ল্যাটফর্মও আছে। দেখার ইচ্ছা ছিল পৃথিবীর ব্যস্ততম স্টেশনকে । তবে এসে বুঝলাম একে দেখা বলতে এই একটু ছুঁয়ে দেখা ছাড়া আর বেশি কিছু করতে পারব না। কারণ এই ভুলভুলাইয়াতে যাঁরা নিত্য যাতায়াত করেন, তাঁরাও নাকি পথ হারিয়ে ফেলেন।আমরা পথ হারালে আর কোন কপালকুণ্ডলাকে যদি না পাই, “ পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ” জিজ্ঞাসা করার জন্য। তাই ও চেষ্টা খুব বেশি করি নি। তবে স্টেশনে যে, নেই এমন কোন জিনিস নেই, তা বুঝেছি।তবে, এখানে ব্যবস্থা খুব ভাল। আর একটা বড় কথা, এখানে অনেক স্টেশনেই মালপত্র রাখার জন্য স্বয়ংক্রিয় লকারের ব্যবস্থা আছে।
🍂
আর দু একটা জিনিস চোখে পড়ার মত। এত মানুষ যাতায়াত করছেন, তা সত্বেও প্ল্যাটফর্মে কিন্তু কোথাও নোংরা বা আওয়াজ নেই। ওদের হাঁটা চলাও যেন বিড়ালের পায়ের মত নিঃশব্দে।কি যাদুমন্ত্র কাজ করে দেশে , যে, বলে বোঝানো যাবে না।
আসলে আমি প্রতি পদে এত বেশি চমৎকৃত হচ্ছি যে, বার বার মুখে ওদের ভাল গুণগুলো স্বতোৎসারিত হয়ে যাচ্ছে, যেটা হয়ত অনেকের ভাল লাগবে না।এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
এই স্টেশনের বিল্ডিঙও পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয়, প্রথমটি অবশ্য জাপানেরই নাগোয়া স্টেশন।
আমাদের আজকের গন্তব্য হাকোনে। আমরা সব মালপত্র নিয়ে চলে এলাম ট্যাক্সি করে শিনজুকুতে। তারপরও বেশ কিছুটা সময় আছে। তাই মালপত্র রাখা হল লকারে। এরকম লকার ,স্টেশনে অনেকগুলো এবং অনেক জায়গাতেই আছে।এখানে কম্পিউটার স্ক্রীনে দেখে, বুঝতে হয় কত নম্বর লকার খালি। তারপর সুইচ টিপে , পয়সা দিয়ে জিনিসপত্র লকারে ভরে লক করতে হয়। কোনো অসুবিধা হলে অবশ্য সাহায্য করার জন্য লোক আছেন।
আমরা এখান থেকে কাছেই , গভর্ণমেন্ট বিল্ডিংএ গেলাম। কারণ গভর্ণমেন্ট বিল্ডিঙটির কিছু আলাদা গুরুত্বও আছে। এটি ২০০৭ পর্যন্ত টোকিওর সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং ছিল, যার উচ্চতা ৭৯৭ ফুট। এতে তিনটি টাওয়ার আছে। তার মধ্যে ১ নম্বর টাওয়ারটি সবচেয়ে উঁচু । এটি ৪৮ তলা, যার মধ্যে তিনটি তলা মাটির নীচে রয়েছে।এতি সর্বসাধারণের দেখার জন্য সকাল ৯.৩০ থেকে রাত দশটা পর্যন্ত উন্মুক্ত। এটি দেখতে পয়সাও লাগে না।
এর ৬৬৩ ফুট উচ্চতায় ৪৫ তলা তে একটি অবজারভেশন ডেক আছে। যেখান থেকে সারা টোকিওর বহুদূর দেখা যায়। ডেকটি একটি বড় হল ঘরের মত।নীচে থেকে অনবরত লিফট সার্ভিস চলছে মানুষকে এখানে দেখতে আনার জন্য।অবজারভেশন ডেকে চিহ্নিত করা আছে, কোনখান থেকে কি দেখা যাবে, এবং কোনদিকে তা রয়েছে ।অন্যান্য সমস্ত টাওয়ারে উঠতে গেলে পয়সা লাগে, টিকিট কাটতে হয়। অথচ , এখানে কিছুই লাগে না। ব্যবস্থাও ভাল। আমাদের টোকিও টাওয়ারে ওঠা হয় নি। তাই ভাবলাম দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই। তবে ঘোলটাও দুধের চাইতে কোন অংশে কম নয়।এই অবজারভেশন ডেকে ছোট দু-একটি দোকানও রয়েছে চা কফি খাওয়ার।খুব আনন্দ হল এই আকাশ ছোঁয়া বাড়িতে এসে।
গভ। বিল্ডিং এ অব্জার্ভেশন ডেক
সবাই মিলে অনেকক্ষণ “গগন বিহার করে–”, অবশ্য একে গগন বিহার বলে কিনা জানা নেই, যাই হোক নামা গেল মাটিতে।আবার গন্তব্য শিনজুকু স্টেশন। সেখান থেকে যাওয়া হবে হাকোনে।
আমাদের হাকোনে যাওয়ার টিকিট কাটাই আছে।স্টেশনে যেহেতু সব কিছুই প্রায় জাপানীতে লেখা, আমাদের শরণাপন্ন হতেই হল তার জন্য বিশেষ কাউন্টারে। সবাই লাইন দিয়ে সুষ্ঠু ভাবেই কাজ সারছে। কাউন্টারের মেয়েরাও যথেষ্ট ধৈর্য ধরে সকলকে সাহায্য করে যাচ্ছে।এখানে এই একটা ব্যাপার , সব জাপানীতে লেখা। বাইরের মানুষদের পক্ষে কিছু অসুবিধা তো বটেই।
শিনজুকু স্টেশনে
কিন্তু ভাবছিলাম, একটা কথা। এখানে গোটা দেশ যে, এক ধারায় চলছে, অর্থাৎ সবার একই চরিত্র-তা পরিচ্ছন্নতাই বলি বা ব্যবহার , বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সব যে প্রায় একই, এর কারণটা কি! এটাই কি দেশকে এতটা এগোতে সাহায্য করেছে?এটা কি এই কারণে যে, জাপান কখনও পরাধীন হয়ই নি। জাপান বরাবরই জাপানীরাই শাসন করেছে। ফলে ওদের দেশে একই ধারার প্রবর্তন হয়েছে। হতে পারে হয়ত। আমাদের দেশে এত রকমের সংস্কৃতি, এত ধর্ম, এত বার পরাধীনতার ফলে এত রক্তের মিশ্রণ-এগুলোই এর পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছে কিনা কে জানে।আমাদের দেশেই দাক্ষিণাত্য তুলনামূলক ভাবে কম পরাধীনতার ফলে আজও ওদের সংস্কৃতি অনেকখানি ধরে রেখেছে। কিন্তু উত্তর ভারতে শক হুণ পাঠান মোগল, গ্রীক ও আরও কত জাতির দ্বারা বিজিত হতে হতে নিজেদের আদি সংস্কৃতি হারিয়ে এক মিশ্র জাতিতে পরিণত। ফলে মত, পথ চরিত্র কিছুই এক হয় নি। কাজেই এত ভাষা, এত বিভেদপন্থা, এত ধর্ম, এত রাজনীতি যা একটা দেশকে এক হওয়ার পক্ষে বাধা সৃষ্টি করে বরং বিভেদকামী হতে সাহায্য করেছে।
যাক গে, যা হয় নি, তা আর কখনও হবে কিনা এটা ভাবা যেতেই পারে, নিদেন স্বপ্ন দেখা তো যেতে পারে।
আমরা ট্রেনে চেপে এলাম ওডাওয়ারা স্টেশনে।এই স্টেশনে আমাদের ট্রেন পালটাতে হবে পাহাড়ী লাইন হাকোনের জন্য।ট্রেন পালটে আমরা চেপে বসলাম হাকোনের ট্রেনে। রাস্তাটি দেখার মত। পাহাড়ের পাশ দিয়ে, ঝরণার গা ঘেঁসে,জঙ্গলকে চুমু দিয়ে, ফুলের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে এগোল ছোট্ট ট্রেন। মনে হল যেন চলেছি সুইজারল্যাণ্ডের কোন ট্রেনে। রাস্তায় মানুষের বাড়িতে বাড়িতে ফুলের সমারোহ।
চলতে থাকুন আমার সঙ্গে। দেখা হবে পরের পর্বে–
ক্রমশঃ-
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments