দূর দেশের রূপকথা—রাশিয়া (এশিয়া)
বুড়ির নাতনির বাড়ি ফেরা
চিন্ময় দাশ
বনের গায়ে একটা গ্রাম। সে গাঁয়ের একটেরে একটা কুঁড়ে। বনের লাগোয়াই বলা যায়। কুঁড়েটাতে থাকে এক বুড়ি, আর তার নাতনি। মাশা নাম সেই নাতনির।
একদিন মাশার কয়েকজন বন্ধু তার বাড়ি এসে হাজির—চল, মাশা। বনে যাব সবাই। ছাতু আর বেরি জোগাড় করব বন থেকে। ভারি মজাও হবে।
মাশা তার ঠাকুমাকে বলল—ঠাকুমা, আমি যাবো বন্ধুদের সাথে?
--কেন যাবে না? বন্ধুরা তোমাকে ডাকতে এসেছে বাড়ি পর্যন্ত। যাও। ঠাকুমা বলল—তবে, সতর্ক থেকো। বন্ধুদের সাথেই থাকবে সব সময়। দলছুট হয়ে গেলে, হারিয়ে যাবে গভীর বনে। পথ খুঁজে পাবে না তখন।
মাশা বলল—না, ঠাকুমা। একসাথেই থাকব, সব সময়।
বন্ধুদের সাথে মাশা এসে বনে ঢুকেছে। দল বেঁধে বনে ঢুকবার দারুণ মজা। সবাই এদিক ওদিক ছাতু খুঁজছে, বেরি কুড়োচ্ছে। মাশাও ঘুরছে এদিক ওদিক, এই ঝোপ ওই ঝোপ। কিন্তু খেয়ালই নাই মেয়ের, কখন দলছুট হয়ে একলা হয়ে গিয়েছে।
যখন খেয়াল হোল, বন্ধুরা কেউ নাই ধারেপাশে। ভয় পেয়ে, কতো হাঁক পাড়ল বন্ধুদের নাম ধরে। কোন সাড়াই এল না কোনও দিক থেকে। ভয় পেয়ে গেল মাশা। এদিকে যায়, বন্ধুরা নাই। ওদিকে যায়, বন্ধুরা নাই। এই করতে করতে, আরও ভিতরে ঢুকে পড়েছে বনের। মাশার বুঝতে দেরি হোল না, সে হারিয়ে গিয়েছে এই গভীর বনের মধ্যে।
ঘুরতে ঘুরতে একটা ঘর দেখতে পেল মাশা। একটু ভরসা এল মনে। ঘর আছে, মানে, কেউ তো আছে নিশ্চয়। গিয়ে কড়া নাড়ল—ভেতরে কেউ আছো? দরজা খোল।
সাড়া নাই কারও। আবার কড়া নাড়ল। আবারও সাড়া নাই। এবার একটু ঠেলা দিতেই, দরজা খুলে গেল হাট হয়ে। কেউ নাই ভেতরে। মাশা ভিতরে ঢুকে পড়ল। অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে, একটু জিরিয়ে নেবে বলে।
আসলে ঘরটা এক ভালুকের। সে বেরিয়ে গিয়েছিল। যেই না সবে সন্ধ্যা নামছে, ভালুক ঘরে ফিরে এল। নিজের ঘরে একটা মেয়েকে দেখে, ভালুক তো ভারি খুশি। এদিকে, হঠাৎ আস্ত একটা ভালুক দেখে, মাশার তো বুক ধুকপুক। কান্না কান্না গলায় বলল—পথ হারিয়ে ফেলেছি আমি। আমাকে বাড়ির রাস্তা বলে দাও। আমি বাড়ি ফিরে যাব।
হা-হা করে হেসে উঠল ভালুক—বাড়ি ফিরে যাবে? তাই আবার হয় না কি? আজ থেকে এখানেই থাকবে তুমি। রান্নাবান্না করবে আমার জন্য। ঘরদোর সাফসুতরো করবে। এই ঘরের বাইরে এক পা-ও যাবে না কক্ষণও।
কত কান্নাকাটি, কত অনুনয়-বিনয়-- কিছুই কাজে এল না। ভালুকের ঘরে বন্দী হয়ে, রয়ে যেতে হল মাশাকে।
সকাল হলে ভালুক বেরিয়ে যায়। সাবধান করে যায় মাশাকে-- আমার ফিরতে দেরি হতে পারে। খবরদার, বাইরে বেরোবে না। তাছাড়া, এই ঘন বন থেকে তুমি রাস্তা খুঁজে পাবেই বা কী করে?
মাশা এ কথার কী জবাব দেবে? চুপ করে আছে। ভালুক বলল-- বেরোলেই আমি কিন্তু টের পেয়ে যাব। নখ দেখেছ তো আমার? ছিঁড়ে ফালাফালা করে ফেলব তখন।
দিন যায়। অবস্থা বদলায় না। মাশা কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না, কী করে মুক্তি পাওয়া যায়। বাইরে তাকায়। যতদূর চোখ যায়, শুধু বন আর বন। কী করে বেরোবে সে এখান থেকে। কোন দিকে তার গ্রাম, কোন রাস্তায় পৌঁছানো যাবে সেখানে—কে বলে দেবে তাকে? অথচ, এভাবে একটা ভালুকের সাথে কি থাকা যায়? যে কোনও সময় ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। যেভাবেই হোক, একটা উপায় খুঁজে বের করতেই হবে তাকে।
এক দিন ঘরে ফিরে, খেতে বসেছে ভালুক। মাশা বলল—একবার বাড়ি যেতে দাও আমাকে। যেদিন যাবো, পরদিনই ফিরে আসব।
ভালুক বলল—আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করবে না।
--চালাকি করলাম কোথায়? তোমাকে বলেই তো যাব। ফিরে আসব পরের দিন। এর মধ্যে চালাকি করলাম কোথায়?
--ফিরে আসব বলে গেলে। তারপর আর ফিরলে না। তখন কী হবে? তাছাড়া, বাড়ি যাওয়ার এত তাড়া কিসের তোমার?
মাশা বলল—ঘরে বুড়ি ঠাকুমা ছাড়া, কেউ নাই আর। বুড়ো মানুষটার দু’বেলা খাবার-দাবার আমিই জোগাড় করে দিই। আজ ক’দিন কী করে যে চলছে তার, ভগবানই জানেন। চিন্তা হচ্ছে খুব।
ভালুক একটু খুশিই হোল এ কথা শুনে। বলল—ওহ, এই কথা। ঠাকুমার খাবারের জন্য চিন্তা হচ্ছে তোমার?
মাশা বলল—হ্যাঁগো, এক্কেবারে সেজন্যই। নইলে আমার আর বাড়ি যাওয়ার দরকারটাই বা কী? বেশ তো আছি এখানে। খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমাচ্ছি। নিশ্চিন্তে দিন কেটে যাচ্ছে।
শুনে, ভালুক ভারি খুশি। মেয়েটার তাহলে মন বসেছে এই জঙ্গলে। এবার একটু বিশ্বাস করা চলে। সে বলল—এক কাজ করো তাহলে। কিছু খাবার বানিয়ে দাও তোমার ঠাকুমার জন্য। আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসব বুড়িকে।
মাশার তো আনন্দ ধরে না। মনে মনে এটাই তো চাইছিল সে। সে বলল—তাহলে তো ভালোই হয়। ঠাকুমারও চিন্তা থাকে না কোনও। আমাকেও ছোটাছুটি করে যেতে আসত হয় না। একটু থেমে বলল—একটা ব্যবস্থা করা যাক তাহলে।
--কী ব্যবস্থা? ভালুক জানতে চাইল।
মাশা বলল—খাবার নিয়ে গ্রামে যাবে তুমি। বলা যায় না, কার মনে কী আছে। বনের জীব তুমি, লোকজন কিছু করে না বসে?
ভালুক দেমাক দেখিয়ে বলল—মানুষই আমাকে ভয় করবে। আমার আবার চিন্তা কীসের?
মাশা দরদ দেখিয়ে বলল—নাগো, কাউকে ভরসা করা ঠিক নয়। বনের জীব, গ্রামের মানুষের কাছে বেশি যাওয়া আসা করা ভালো নয়। সেজন্যই আমি একটা কথা ভেবেছি।
--বলে ফ্যালো, কী কথা?
--ঠাকুমার খাবার নিয়ে যাবে তুমি। তবে ঘন ঘন যাবে না। মাঝে মধ্যে যাবে। আমি বরং কষ্ট করে বেশি করে খাবার বানিয়ে দেব। একসাথে এক মাসের খাবার। একবার পৌঁছে দিলেই, এক মাস নিশ্চিন্ত। বারবার যেতে হবে না। তাতে বিপদও কম তোমার।
ভালুকের বেশ মনে ধরল কথাটা। বলল—সেটা তো খুব ভালো কথা। সেই ব্যবস্থাই করো।
--সে আমি করে দিচ্ছি। দিতে পারবও। তবে, একটা অসুবিধা আছে তাতে।
--এতে আবার কী অসুবিধা?
মাশা বলল—একজন মানুষের পুরো এক মাসের খাবার। ওজন তো ভালোই হবে। অতটা রাস্তা তুমি কি বয়ে নিয়ে যেতে পারবে?
শুনে আঁতে ঘা লাগল ভালুকের। বলল—তাগড়াই চেহারাট দেখতে পাচ্ছো না আমার? পারব না মানে? তুমি শুধু খাবার-দাবার যা দেওয়ার, বানিয়ে দাও। পৌঁছে দেওয়ার ভার আমার। তোমাকে অতশত ভাবতে হবে না।
মনে মনে এটাও তো শুনতে চায় মাশা। সে বলল—ঠিক আছে। ঐ কথাই রইল তা হলে। আমি খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করি। তারপর তখন যাওয়ার ব্যবস্থা হবে।
দিন কয় বাদে, মাশা বলল—বনের যত রকমের ফলমূল জোগাড় করে ফেলেছি। বাকি শুধু পিঠে আর পায়েস। সে আমি আজ রাতেই বানিয়ে ফেলছি। একটা বড় বাক্সও জোগাড় হয়ে গেছে। তুমি যাও। ঘুমিয়ে পড়। কাল অতটা পথ যেতে হবে তোমাকে।
ভালুক খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। মাশা গেল রান্নাঘরে। খান চার-পাঁচেক পিঠা বানাল। পায়েস রাঁধল বড়জোর এক বাটি। কাজ সেরে, টেনে ঘুম।
সকাল হতেই, বেরোবার তোড়জোড়।
--খাবার দাবার সব বাক্সে ভরে দিয়েছি। সাবধানে নিয়ে যেও। এক হাঁড়ি পায়েসও আছে। বেশি নাড়াচাড়া কোর না যেন। মাশা বলল—তুমি যা পেটুক, কোন বিশ্বাস নাই তোমাকে। রাস্তায় বাক্স খুলে, খেতে বসে যাবে না তো?
ভালুক হাঁ-হাঁ করে উঠল—কী যে বলো না তুমি। এই তো ভর পেট খেয়ে বেরুচ্ছি। পথে আবার খেতে যাবো কেন?
মাশা বলল—ও তুমি যাই বলো, একটুও বিশ্বাস নাই তোমাকে। সামনে উঁচু বার্চ গাছটা দেখছো তো। আমি চললাম। গাছের মগডালে উঠে বসে থাকছি। ঐ উঁচু থেকে একেবারে আমাদের গ্রাম পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। খাবার চেষ্টা করেছ কি, আমি ঠিক ধরে ফেলব।
ভালুক বলল—আরে না, না। সে ভয় নাই।
মাশা বলল—কোন ভরসাও নাই তোমাকে। সে যাকগে। রাস্তায় কী করো না করো, সবই দেখতে পাবো আমি। এখন একবার বাইরে ফাঁকায় গিয়ে দেখে এসো, আকাশে মেঘ আছে কি না। আমি চললাম বার্চ গাছে চড়তে। সাবধানে যেও কিন্তু। ঝুড়িটা সাবধানে নিয়ে যেও। ফেলেটেলে দিও না যেন। তাতে কিন্তু কষ্টের শেষ থাকবে না আমার।
🍂
ভালুক চলে গেল আকাশ দেখতে। অমনি টুক করে বাক্সের ভিতর সেঁধিয়ে গেল মাশা। বাক্সটা তো ফাঁকাই ছিল। চারটা পিঠে আর ছোট এক ভাঁড় পায়েস—এই মাত্র। ভালুক কিছু জানতেই পারল না।
আকাশ পরিষ্কার। ভালুক খুশি তা দেখে। রাস্তায় হয়রাণ হতে হবে না। পিঠে বাক্স চাপিয়ে সে রওণা হয়ে গেল।
বন-পাহাড়ের উঁচু-নীচু রাস্তা। পিঠের বাক্সটাও বেশ ভারি। বেশ কিছুটা রাস্তা চ্লবার পর, হাঁফ ধরেছে ভালুকের। একটু বিশ্রাম না নিলে চলছে না। ভাবল, বাক্স নামিয়ে, একটু জিরিয়ে নিই।
বাক্স নামিয়ে, একটু আড়মোড়া ভেঙে নিচ্ছে, এমন সময় কার যেন গলা কানে এল—জিরিয়ে নিচ্ছ, নাও। কিছু বলব না। বাক্সের ডালায় কিন্তু হাত ছোঁয়াবে না।
ভারি চমকে গেল ভালুক। এ তো মেয়েটারই গলা। ভয়াণক মেয়ে তো? এত দূর থেকেও দেখতে পাচ্ছে!
বাক্স পিঠে তুলে, আবার চলতে শুরু করেছে ভালুক। অনেকটা গিয়ে আর পারা যাচ্ছে না। হাড়গোড় সব যেন ভেঙে যাবে মনে হচ্ছে। বাক্সটাও যেন পর পর ভারি হয়ে উঠছে। একটা বুড়িমানুষ! পেটে আর কত ধরবে তার? এত এত জিনিষ ভরে দেওয়ার কী দরকার ছিল? সারা শিরদাঁড়া টনটন করছে। পেটেও যেন টান পড়ছে এবার। বিড়বিড় করে বলেও ফেলল-- এবার একবার না নামালে, মরেই যেতে হবে। তার উপর খিদেও লেগেছে। দু-একটা পিঠে খেয়ে নিলে হয়। জানছেটা কী করে?
মেয়েটা পই-পই করে বলে দিয়েছে, পায়েসের হাঁড়ি আছে ভেতরে, বাক্স যেন সাবধানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাই, বেশ যত্ন করেই নামাল বাক্সটা।
সবে বাক্সটা নামিয়েছে পিঠ থেকে, অমনি সেই গলা ভেসে এলো—কাহিল হয়ে পড়েছ, দেখতেই পাচ্ছি। সামনের গাছটার নীচে একটা পাথর আছে। সেটায় গিয়ে বসো। খবরদার, বাক্সের ওপর বসতে যেও না। আর, পিঠে খাবার কথা মুছে ফেলো মন থেকে। ঘরে ফিরে এসো। অনেক সুন্দর করে পিঠে বানিয়ে দেব। তখন পেট পুরে খেও। আজ নয় কিন্তু।
মুখে কথা জোগাচ্ছে না ভালুকের। কী খর চোখ রে বাবা, এ মেয়ের। এত দূর চলে এসেছি। তা-ও তার নজরে পড়ছে সব কিছু। আসলে, মাথায় বুদ্ধি আছে খুব। ঐজন্যই উঁচু গাছটার মাথায় চড়ে বসে আছে। তাতেই সব কিছু ধরা পড়ে যাচ্ছে চোখে।
পিঠে খাওয়ার কথা ভুলেই গেল ভালুক। এখন কোন মতে এই ভারি বাক্সটা বুড়ির ঘরে নামিয়ে দিতে পারলে, বাঁচা যায়।
পা একটু জোরেই চলছে এখন। এক সময় পৌঁছেও গেল বুড়ির ঘরে। বাক্স নামিয়ে সবে বেড়ার আগড় ঠেলেছে, ক্যাঁচ করে একটা শব্দ। তাতেই কয়েকটা কুকুর ঘেউ-ঘেউ করে চেঁচিয়ে, তাড়া করে এল।
ভালুক গেল চমকে। এতগুলো কুকুর একসাথে তাড়া করে আসছে।
রইল পড়ে বাক্স। রইল বাকি বুড়িকে তার নাতনির কথা বলা। প্রাণ নিয়ে সরে পড়ল ভালুক।
আচমকা একপাল কুকুরকে ডেকে উঠতে শুনে, বুড়িও বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। ব্যাপারটা কী, দেখার জন্য। ভালুক পালিয়েছে দেখে, মাশাও বেরিয়ে পড়েছে বাক্সের ডালা ঠেলে।
তখন সে এক দৃশ্য! গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছে বুড়ির ঘরের সামনে। বুড়ি আর নাতনি দুজনেই জড়িয়ে ধরে আছে দুজনকে। কথা সরছে না কারও মুখে। কেবল চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে অবিরল ধারায়।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments