জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন /পর্ব --৪/মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া



||  ভাঙা আয়নার মন ||
পর্ব --৪

নীল শেজবাতির আলো...

মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া 

মাংস নামাবো,ডেকচিটা দে দেখি বেবি। লিচু তলায় ইট পেতে রান্নাবাটি খেলছে সে বাচ্চু বেবির সাথে।সজনে গাছের দলা দলা আঠা ছিঁড়ে মাংস রান্না করছে ঝিনি। দে না ডেকচিটা।পাচ্ছি নে।তা'লে সস প্যানটা দে।নেই তো। আচ্ছা হাঁড়িটা দে।নেই।গেল কোথায় তবে?খেলাঘরের আনাচ কানাচ,পুতুলের বাক্স ঝেড়েঝুড়েও হাঁড়ি -বালতি কাপডিস তার প্রিয় টুকটুকে লাল জাগ  কিচ্ছুটি পাওয়া গেল না।
       ভালো করে খোঁজ না। খুঁজদিছ তো।না পেলি কী করব? আমি বলো নেইনি ওসব। পাচ্ছি নে কেন বল তো।গেল কোথায়
সব তা'লে?তুই আমার মানিকে চোর বলতিছিস? বাচ্চু আচমকাই ঝিনিকে ধাক্কা দেয়। বছরদুয়ের বড় তার দিদি বেবিকে সে মানি বলে। আচমকাই ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে  উল্টে পড়ল ঝিনি ইটের ওপর। বাচ্চু বেবি হি হি করে হাসে।
       কপালে ঢিপলি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েই সে হাত পা চালিয়ে দিল।চিৎ করে ফেলে বেবির পেটে চেপে বসল। বাচ্চুর আঁচড় কামড় তাকে ঠেকাতে পারল না।ফ্রক জামা উল্টে বেবির ফিতে বাঁধা ঘটি প্যান্ট দেখা যাচ্ছে যার পকেটে সসপ্যানের ডান্ডি উঁকি দিচ্ছে। হাত ঢুকিয়ে বার করে আনে খেলনাটা। তাই রোজ আমার খেলনা হারিয়ে যাচ্ছে? দাঁড়া না আজ মাসিকে বলেই দেব।ঝিনি দৌড়তে থাকে পেছনে বাচ্চু বেবি।রাস্তা পেরিয়ে বাচ্চু বেবিদের দোতলা বাড়ির উঠোনে মাসি ও মাসি বলে চেঁচায়। দুদ্দাড় সিঁড়ি বেয়ে বাচ্চুরা ঘরে ঢুকে গেল।
         একটু পরে মাসির দুপাশে দুজন আর পেছনে ওদের দাদা উঁকি দিল।কান্তিদা দাদামনির চাইতেও বড়।ফরসা  মুখের পাশে কোঁকড়ানো কালো চুল সাজানো টুকটুকে লাল ঠোঁটে মাসিকে দেখতে লক্ষী ঠাকুরের মতো কিন্তু সবসময় রাগী রাগী মুখ। চেঁচাচ্ছিস কেন? মাসির  মুখ দেখে ঝিনির সাহস উড়ে গেল। ঢোক গিলে তবু সে আস্তে আস্তে বলল ওরা আমার খেলনা নিয়ে নেয়।কী করে জানলি ওরাই নেয়?মরিয়া হয়ে সে সসপ্যানটা দেখিয়ে বলে ওর পকেটে ছিল। বাকিগুলো পাচ্ছি না।তুই দেখেছিস ওদের চুরি করতে? মাটির দিকে তাকিয়ে সে মাথা নাড়ে।মা দ্যাখো আমাদের মেরেছে ঝিনি।গায় হাত দিয়েছিস ওদের এতবড় আস্পদ্দা? দাঁড়া তোর মাকে বলছি আমি। লেখাপড়া শিখলেই কি আর ছোট জাতের ধম্ম যায়? রিফিউজির পাল সব। উদ্বাস্তু হয়ি দলকে দল এপারে আসপে তারপর জমিবাড়ি করি চাকরি বাকরি সব খেয়ি এখন এসি চুরির কথা বলতিছ। চোরের মায়ের বড় গলা আর কারে বলে!যা এখান থেকি আর ওদের বাড়ি খেলতি গেলি তোদেরও ঠ্যাঙ ভাঙব বলতিছ আমি।মাসি দুই মেয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। দরজাটাও দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল।
          খানিক চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সে চলে আসছিল। দাঁড়া ঝিনি।হঠাৎই দরজা খুলে কান্তিদা উঁকি দিল। একটু দাঁড়িয়ে যা আমি না বলা অবধি যাবি নে।কান্তিদার কথায় সে পুতুলের মতো দাঁড়াল। ভেতরে তুমুল চিৎকার, মা মেজদা আমাদের বাক্স উল্টি দেচ্ছে বলো। দু চারটে চড় থাপ্পড়ের আওয়াজ আর দুবোনের কান্না।বড় বাড় বেড়িছ তোর কান্তি আজ আসুক তোদের বাবা ...এই অবধি শুনে ঝিনি  ছুট লাগালো।  দুপুর রোদে গরম হয়ে উঠেছে পাকা রাস্তা। লিচু তলার খেলাঘরে সে ফেলে এসেছিল তার হাওয়াই চটি। মারপিটের উত্তেজনায় খালি পায়েই দৌড় দিয়েছিল বাচ্চুদের বাড়ি। ফেরার সময়েও পায়ের তলায়  সে টের পাচ্ছিল না ভালো করে।দাঁড়া দাঁড়া ঝিনি কান্তিদাও দৌড়ে এসে তাকে ধরল,এই নে তোর জিনিষ আর মার কথায়... আচ্ছা বাড়ি যা দুপুর রোদির মধ্যি  ছোটদের বেরোতি হয় না বুইচিস? এতক্ষণ কী একটা হচ্ছিল তার।যেন খুব গরম কিছুর গায় এত জোর তার হাত ঠেসে ধরেছিল কেউ ভালো করে কিছু টের পাচ্ছিল না সে। 
          কান্তিদার নরম গলা শুনে কী যেন ফুঁপিয়ে উঠল। কোচড়ে রান্নাবাটির  জিনিসগুলো নিয়ে খুব আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি ফিরল ঝিনি। গরম পিচের ছ্যাঁকা এতক্ষণে ঠাওর হলো। পা দিতেই কষ্ট হয় অত গড়ম সড়কে তবু দৌড়োলো না সে। রাস্তার পাশে ধুলো আর কাঁকড় ভরা মোরামে নেমে আস্তে আস্তে হাঁটছিল ঝিনি।ভালো লাগছিল না তার ।খেলনাগুলোর দিকে তাকাতেও মন চাইছিল না। কী যেন একটা সত্যিকারের হারিয়ে ফেলেছে  নাকি ভেঙে গেছে খুব দামি কোনো কিছু।
   বাপির কলেজে পড়ার সময়কার উঁচু স্ট্যান্ডের সেই  নীলচে কাচের ডুম দেওয়া কেরোসিনের বাতিটা যাকে বাপি শেজ বাতি বলত, ঝিনির  হাত থেকে পড়ে সেবার ভেঙে গেলে মা তাকে মেরেছিল খুব তাতে সে কাঁদেনি। সন্ধেবেলা বাপি সব শুনে শুধু অল্প হেসে ইচ্ছে করে তো আর ভাঙোনি কী আর করা বলে কেমন চুপ করে গেল।কিচ্ছু বকল না বলেই যেন তার বেশি খারাপ লাগছিল । হাঁটু ধরে বাপির দিকে তাকিয়ে মনে হলো চোখের শাদায় ভাঙা শেজবাতির নীলচে ডুমটার ছায়া ফুটে আছে। তাকেই কি দুঃখ বলে?তার জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছিলো না।
       ঠিক সেদিনকার মতো আজকেও মনে হচ্ছে সেজবাতিটার মতোই কী যেন ভেঙে গেছে তার,কী একটা জিনিষ খুব যত্নের খুব যেন আঁকড়ে থাকার এমন কিছু সে হারিয়ে ফেলেছে একেবারে খুঁজলেও আর কোথাও তাকে পাওয়া যাবে না। খেলনাগুলো বারান্দায় ছুঁড়ে ফেলে হাত পা না ধুয়ে 
সে বসে রইল চুপ করে।যতক্ষণ না রুবিদি এসে হিড়হিড় করে নিয়ে গেল কলতলায়।হাত পা ধুইয়ে
 ঝুঁটি বেঁধে দিল রঙিন ফিতে দিয়ে।
        রোজকার মতো বিকেল হলেই মণি টেনি বুবাই ঝুমারা ডাকতে এল ঘুরচণ্ডী আর লাফদড়ি খেলতে।কিছুতেই যাবে না সে।মুখ গোঁজ করে বসে আছে তো আছেই।খেলতি যা।ঘটের নাহান বসায় রাহিছে কেডা ক'দিনি?রুবিদি বলল।মাসি  ইস্কুলের কাজ কততি বারাসাত গেইছে তো হতিছে ডা কী?এই পিলে ভুতির মতো ত্যাহোনের থে বসিই রইছিস কী অততি?ওরম ওরলি চলে?বাস টিরেনের রাস্তা।মাসির ফেরার আ্যহোনো কলাম দেরি আছে।কান্দবিনে কিন্তু। তোগেও কতিছি কির'ম বন্দু  তোরা হাত ধরি ডাকে নিতি পাততিছিস নে ?রুবিদি তাড়া দিয়ে তাকে খেলতে পাঠিয়ে দিল।
   অন্যদিন জোড় বেঁধে লাফদড়ি খেলতে কী ভালোই না লাগে।যেন ওড়বার অভ‍্যেসে দুহাত ছড়িয়ে দেয় তারা।লাফদড়ি খেলায় শূন্যে উঠে যায় কতবার। কতবার উড়ান উড়ান ভেবে যেন দুধারের আকাশ ধরে ফেলে  হাতে আর ফুরফুর করে বুকভর্তি বাতাসের আলাভোলা দিন। হাওয়ার নৌকো যেন  উড়বে ভেবে যখনই  ধাক্কা দেয় দুপায়ে নোঙরে ঝনঝন শব্দ ওঠে।
     একশ দুশো তিনশ স্কিপিং লাফায় এক এক দমে। উল্টো স্কিপিং,ক্রস লাফ কিছুতেই শেষ হয়না খেলা অন্যদিন।
      যেন শালিখের মতো দুপুরের হলুদ খুঁটে খুঁটে হালকা হয়ে গেছে সকলের হাড়।উড়তে পেরে যাবে ভেবে ঠোঁট আর জিভের আগায় নকল করেছে রোদের চিকন শিস। পুরনো আলো তবু আদ্দেক লাগে। দুহাতে ঘাসকুটো সরিয়ে গোল হয়ে দেখে বিকেলের নীল অন্ধকার। দেখে ইস্কুল ঘরের মাঠকোঠা  ঘিরে পোড়োবাড়ির মতো সন্ধে নামছে আবার।আজ অবশ্য একশ লাফিয়েই দড়ি পায়ে জড়িয়ে আউট হয়ে গেল ঝিনি। তোরা লাফা বলে একধারে দাঁড়িয়ে গেল সে। আধা তৈরি মেয়েদের ইস্কুল ঘরের উল্টোদিকে জাম গাছটা থেকে ভেঙে পড়েছে কী একটা পাখির বাসা। নীলচে ডিমের ভাঙা খোল পড়ে আছে।ঝড় হয়িলো না কাল দুকুর বেলা? একটা পাটকাঠি দিয়ে বাসাটা উল্টে দিয়ে 
খোকন বলল,দোয়েল পাখির বাসা আমি দেখিলাম দুখানা ডিম পেড়িলো।ভেঙি গেছ বলি কী ডাকতিলো কাল পাখি দুটো। এখন ওদের কী হবে বলতো?কী আর হবে খোকন বড়দের হাবভাব নিয়ে বলে আবার বাসা বেঁধি ডিম পাড়ব্যান।    
      এতক্ষণ খেলছিল ওরা। জামতলায় ঝিনি আর খোকন কী একটা মন দিয়ে করছে দেখে ইস্কুলে ঘরের সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় নেমে এল বুবাই-ঝুমারা।ওদের খিলখিল হাসি শুনে ঝিনি তাকিয়ে দেখল হাওয়ার ডালপালা ধরে নামতে নামতে  ফ্রকের ঝালর লেগে বিকেল উড়ছে ।নিরালা ছাদে পড়ে আছে তাদের স্কিপিং দড়ি।

🍂

              "ছোট জাত" কাকে বলে মা? বারাসাত থেকে ফিরে কাপড় ছেড়ে চা মুড়ি নিয়ে মা বসলেই ঝিনি জিজ্ঞেস করে।খুব বাজে পচা মেয়ে? রিফিউজি মানে কি? খুব দুষ্টু আর খারাপ? কোথায় পেলে এসব কথা?ওই যে বাচ্চু বেবির মা আছে না,সেই মাসি বলল তো আমায়। কেন? তুমি কী করেছো?তিনি এলেন কখন? আসেনি তো আমি গেছিলাম ওদের বাড়ি।জাতের ধম্ম কে গো মা?পড়া করে না এমন বাজে মেয়ে?ঝিনি সব বলে মাকে।অচেনা শব্দর জল  হাতড়ে হাতড়ে সে তীরে পৌঁছতে চায়।
    ওগুলো সত্যি খুব মন্দ কথা। মা তাকে জড়িয়ে ধরে।তুমি মোটেও তা নও। এসব একেবারেই ভুল কথা।বানানো, মিথ্যে কথা। বড় ছোট কোনো জাতই হয় না।বড় হও নিজেই বুঝতে পারবে।তা'লে বলে কেন?ভুল করে বলে।অন্যায় করে বলে।     
      তোমার খেলনা খুঁজে পাচ্ছো না, সেটা বলেছো ঠিকই তবে ওদের বাড়িতে না গিয়ে তুমি আমায় বলতে পারতে আমি আবার কিনে দিতাম। মারপিটও তো করেছ।দস্যি হচ্ছো দিনদিন। কই দেখি ওষুধ লাগিয়ে দিই। মারামারি করার জন্য বা রাস্তা পেরিয়ে বাচ্চুদের বাড়িতে একলা চলে যাওয়ার জন্যও মা কিছুই বকল না আজ তাকে।আর কেমন নরম চোখে  তাকিয়ে খুব আদর করছিল তাকে। তাদের মা কত জানে। মা তো ইস্কুলের বড়দিদিমণি।মা তবে নিশ্চয়ই ঠিক কথা  বলেছে।সারা দিনের ভার নেমে গেল তার। হালকা হয়ে হাসতে শুরু করলো নিজেই।আচমকাই দৌড়ে গিয়ে রুবিদিকে জড়িয়ে পিঠে ঝুলে পড়ল।
      পাছো পাছো কাজ আগোয় কততি পাততিছি নে।নাতি খাতি বেলা গেল আ্যকন না করলি মাসি বকপেনে।রাত্তিরির রান্না চাপায় দিয়ি পিঠি করি নে ঘুরোয় আনবানে।উমনো ঝুমনোর গল্প কবানে।
        বড় ঘরের মেঝেতে বিছানা পেতে মশারির দড়ি বাঁধে রুবিদি।ঝিনি তাড়াতাড়ি খাটের একেবারে ধারে এসে শোয় যাতে গল্পটা ভালো করে শোনা যায়।বালিশে মাথা রেখে শুরু করে রুপি দিদি ইতুপুজো ব্রতকথার উমনো ঝুমনোর কাহিনি।
      যেন রাত্রি অনন্ত,রূপমালা দিদির গল্পও চলেছে সেই শেষ না হওয়া রাত্তির ধরে। বাবা ভুলিয়ে গহীন বনে নিয়ে এসেছে যাদের। ঘোর জঙ্গলে হারিয়ে ফেলেছে রাস্তা দুইবোন। ঘুমন্ত মেয়েদের কোল থেকে ফেলে গেছে বাপ তাদের। বাঘের ডাক  শুনে ভয়ে কাঠ দুইবোন গাছ দেবতা গাছ দেবতা  আশ্রয় দাও বলে কাঁদে আর গাছও দুফাল হয়ে কোল পাতে। হাওয়া দেয় কি না দেয় শ্বাস নেয় কি না নেয় উমনো ঝুমনো ঢোকে জাদু কোটরে।
        এ কাহিনি ইতু ঠাকরুন জানে,অক্ষয় বট,মায়া বিরিক্ষ জানে ।জানে কাঁচা মাংসের নেশায় কারা নখ আঁচড়ায় বৃক্ষ বাকলে। আরও কিছু কাল পর ঝিনিও হয়তো জেনে যাবে ব্রতকাল ধরে কিভাবে 
সিঁদুরের রক্তে ঘট ভেসে যায়। জানবে পৃথিবীর এই পিঠে  শিকারি কুকুরের দল ঘিরে ধরে মেয়েদের ব্যাকুল মিথ। পান সুপুরি হাতে যেখানে মেয়েরা আজন্ম চলেছে ব্রতের আলপনার কলকা পথ ধরে। মরা কন্যা ভ্রূণ কোলে কাঁখে করে তারা সংসারের কল্যাণ কামনায়  ছুঁয়ে আছে ধানদুব্বোর ভরা কলস। কাঁখের মরা মেয়েরাও দুলে দুলে বলছে ব্রত করলে কী হয়? নির্ধনের ধন হয় অপুত্রের পুত্র হয়...সীতার মতো সতী হয়...
   অথচ এতদিন পরে শিকারের ঘাড় কামড়ে ধরার আগে যত বেয়াদব বেতমিজ কিসসা থেকে মুখ তুলে পশু মানুষরা থমকে দেখেছে ব্রতের পাঁচালী রেখে উঠে দাঁড়াচ্ছে ছেঁড়াখোঁড়া দেবী।
      লাল পাড় হাওয়ায় আছড়ে পড়ছে প্রদীপ ও ভাঙা পিলসুঁজ। পৃথিবীর উল্টোপিঠেও খিলখিল হেসে উঠছে ইসাবেলার উড়ন্ত পোশাক...

Post a Comment

1 Comments

  1. অসাধারণ এই অংশটা।

    ReplyDelete