জ্বলদর্চি

লাগলো না সেই সুরে /পুলক কান্তি কর

লাগলো না সেই সুরে 
                                                           
পুলক কান্তি কর

সেই ছোটবেলা থেকেই আমার হলং-এর বাংলোয় থাকার খুব সাধ। তখন প্রায় ফি বছরই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পুজোর সময় হলং এর বাংলোয় গিয়ে থাকতেন বলে পাড়ায় চায়ের দোকানে কত কী আলোচনা হ’ত। তখন থেকেই আমার হলং প্রেম। এবার একটা সরকারী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রন পেয়ে সেই বাংলোয় ওঠার সুযোগ হল গতকাল। সত্যি কী চমৎকার জায়গা।কাঠের ঘর যে এমন বিলাস বহুল করে বানানো যায়, না থাকলে বোঝা হ’ত  না কখনও। এর আগেও ‘রাজাভাতখাওয়া’র জঙ্গলে কাঠের বাংলোয় থেকেছি আমি। তবু হলং যেন হলং ই। বর্ষাকালে জঙ্গল- সে যে কী অসীম আনন্দের জায়গা, সাবধানী মানুষদের পক্ষে বোঝা বড় মুশকিল। চারপাশে সেগুন কদমের বড় বড় গাছ। বৃষ্টিধারায় যখন তারা স্নান করে- সে বড় দৃষ্টি মনোহর! ঘরের লাগোয়া বারান্দায় বসে সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে দেখছিলাম বৃষ্টির রূপ। কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইল থেকে গান শুনতে শুনতে হঠাৎ একটা গানের কলি এসে ভেঙে দিল সব মুগ্ধতা। ‘সেই কথাটি লাগালো না সেই সুরে, যত প্রয়াস করি পরাণ পণে’- কী হল কথাটা? গানটা আবার দিতে যেতেই স্ত্রী’র গলা পেলাম- ‘কী গো চা টা দিতে বলেছ?’ ঘরের দরজা খুলে উঁকি মেরে দেখছে সে আমাকেই।

- না। ভাবলাম তোমার বৈকালিক নিদ্রা ভঙ্গ হলেই তোমার সাথে চা-সঙ্গ করব।

- বাবা! মুডটা ভালো আছে মনে হচ্ছে। লিখলে নাকি কিছু? বলতে বলতে পাশে এসে বসল কুহু।  

- না, লেখা হয়নি।

- ঘুমোলে না তো কী করলে সারা বেলা?

- এই তো বৃষ্টি দেখছি, গান শুনছি।

- কী গান? বাদল বাউল?

- না না। তবে রবি ঠাকুরই।

- কার গান শুনছিলে? দেবব্রত নাকি?

- না গো। সাগর সেনের একটা অ্যালবাম শুনছি।

- এখন কী শুনছো? জোরে দাও না। শুনি!

- ‘কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে’। শোনো। মন দিয়ে শোনো। বলেই আমি আবার চালিয়ে দিলাম গানটা। সাগর সেন যেন তৈরীই ছিলেন। নতুন শ্রোতা পেয়ে উদাত্ত গলায় আবার দরলেন- যে কথাটি বলব তোমায় বলে, কাটল জীবন নীরব চোখের জলে। সেই কথাটি সুরের হোমানলে উঠল জ্বলে একটি আঁধার ক্ষণে...

-কী অপূর্ব গান না? আগে এত ভালো করে শুনিনি। কুহু বলল স্বগতোক্তির মতো।

- বলতো কুহু, গানের কোন জায়গাটা আজ তোমাকে সবচেয়ে বেশী হন্ট করল?

- একটু ভেবে কুহু বলল-‘ সেরকম স্পেশাল কোনও লাইন মনে পড়ছে না। আসলে গান একটুখানি শোনার পরই মন অন্য কোথাও চলে যায়। সব সময় সব লাইন মন দিয়ে শোনা হয় না।

- এই দ্যাখো। এই জায়গাটা- ‘ভেবেছিলাম আজকে সকাল হলে, সেই কথাটি তোমায় যাব বলে। ফুলের উদাস সুবাস বেড়ায় ঘুরে। পাখির গানে আকাশ গেল পুরে। সেই কথাটি লাগল না সেই সুরে। যত প্রয়াস করি পরাণ পণে...’ গেয়ে শোনালাম আমি।

- সত্যি! কী অপূর্ব। কুহুর গলায় মুগ্ধতা।

- দ্যাখো যে কথা আমি এতদিন বলার জন্য ব্যাকূল ছিলাম, অথচ বলতে পারিনি, আজ স্থির করেছি- যে ভাবেই হোক বলব সে কথা। কিন্তু বলা হল না – কেননা আজ এমন করে গাইছে আকাশ – সে সুরে আমার সুর মিলবে না, যে সুরে গাইছে পাখি- সেই সুরে আমার কথা ভাসবে না; হয়ত কোনও দিন বলা হবে না সেই কথা –সুরে সুর মিলবে না বলে- দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি।

- ‘কী গো, কারও কথা মনে পড়ছে বুঝি?’ কুহুর গলায় রহস্য ঘনিয়ে এলো।

- না। তেমন কিছু না, তবে...  

- তবে কি?

- এই একটু মুডটা খারাপ হয়ে গেল।

- ধন্যি বাবা! তোমার মুড নিয়ে আর পারি না!

- কুহু ঘরে গিয়ে একটু চা টা বলে দাও না প্লিজ।

- সে না হয় বলছি। তুমি কিন্তু মুড খারাপ ক’রো না। সত্যি! তোমাদের মতো কবি লেখককে নিয়ে ঘর করা বড় জ্বালা! এই এখন কদিন মুড সামলাতে হবে কে জানে! কী খাবে? চা-না কফি?

- চা ই বলো।

    কুহু চলে যেতে গানটা শুনতে ইচ্ছে হ’ল আবার। আমার এমন ই হয়। যখন যে গানটা ভালো লাগে, বার বার শুনতে ইচ্ছে করে। খানিক বাদে অনুপ টি-পটে করে চা নিয়ে এল বারান্দায়। বলল, ম্যাডাম বানাবেন, না আমি তৈরী করে দেব?

    কুহু বললে- ‘তুমি রাখো। আমি করে নেবো।‘

- আমারটায় অল্প একটু চিনি দিও কিন্তু!

- কেন সুগার ফ্রী এনেছি তো!  

- দাও না। এমন দিনে কি ’না চিনি, না চিনি’ ভালো লাগে?

- কিন্তু তোমায় চিনি এমন চেনে, বাইরে বিপদ-আপদ না হলেই বাঁচি।

- না, না, কিছু হবে না। ‘দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।‘

- এই বার মুড ঠিক হয়ে গ্যাছে মনে হচ্ছে!

- ‘হ্যাঁ।‘ আমি হড়বড়িয়ে জবাব দিলাম। মুড ঠিক না হলেও এমন ভাব করি যাতে কুহুর সন্দেহ না হয়। নইলে এখন হাজার বার ‘কী গো ঠিক হলো?’, ‘কী গো ঠিক হলো?’ বলে মুডের চৌষট্টি পূজো করে দেবে।

- তা মুডটা কেন খারাপ হল, শুনি! কাকে কোন্‌ কথা বলতে পারনি কোনও সকালে?   

- আরে না, না। তেমন কিছু নয়!

- কিছু তো বটেই। তোমার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারি সব। আচ্ছা বল- এটা আমার ‘জানা’ না ‘না জানা’।

- না জানা।

- ভগবান! কত না জানা কথা এখনও লুকিয়ে রেখেছ তোমার অলিন্দে? বিয়ের আজ পঁচিশ বছর হতে চললো!

-দ্যাখো, কবিরা চোখের পলকেই কাউকে হৃদয় দিয়ে বসে। এত কি মনে থাকে? নাকি মনে করে বলা যায়?কোনও প্রসঙ্গ এলে তবে কোনও কথা মনে পড়ে।  

- আচ্ছা, আমি তোমার বউ না হয়ে অন্য কেউ হলে কী করতে তুমি? কে এত বুঝতো তোমায়? এই ফাঁকে নিজেকে একটু জাহির করে নিল কুহু।

-সে আর বলতে! তুমি ছাড়া সব অন্ধকার!

-ফের বানিয়ে বলছ? তুমি বিশ্বাস কর একথা?

-একশ বার। মজা করলাম আমি, যদিও জানি মজাটা ঠিক সুরে বাজল না। কুহু বোঝে সব। বলল, ‘বলে ফ্যালো।‘ দেখবে ভালো লাগবে। নাম কি তার?

- তুমি চেনো।  

- কে গো?

- অহনা। নির্মলের বউ!

- নির্মলদা’র বউ? অহনাদি? বলো কি? নির্মলদা জানে এসব? সন্ত্রাসবাদীদের মুখে পড়লেও মানুষ এমন করে না, যেমন মুখ করে কুহু চেয়ে রইল।

- আরে না না। বলার মতো কিছু নয়।

- এই যে বললে!

- কী বললাম? বললাম তো সুরে মিলল না বলেই বলা হয়নি কোনও দিন। তাই কেউ জানে না।

- অহনাদিও না?

- না। অহনাও জানে না।

- কিন্তু নির্মলদার মুখ থেকে শুনেছি, তুমিও বলেছ- ওদের বিয়ের তুমি নাকি মেইন কারিগর? প্রথম প্রেমপত্রটি নাকি তোমারই লেখা।

- শুধু প্রথম কেন? প্রেমের প্রস্তাব থেকে যত পত্র নির্মল লিখেছে- সব আমারই লেখা।

- বলো কী!

- হ্যাঁ। নির্মল তো ইংলিশ মিডিয়াম। তাছাড়া একটু কাঠখোট্টা টাইপ। লিটারেচারের এত রস কষ বুঝতো না।

- আর অহনাদি তো একেবারেই ‘কলাবতী’। রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া বোঝে না।  

- আমার ও তাই মনে হয়, অহনা চিঠির প্রেমেই ওর প্রেমে পড়ে।

- অহনাদি জানলো কখন যে চিঠিগুলো নির্মলদার লেখা নয়? বিয়ের পরে?

- না, না। প্রেম শুরু হওয়ার বছর দুই পরে। নির্মলই বলেছে।

- অহনাদি তখন কিছু বলে নি? এই নিয়ে অশান্তি হয় নি?

- তেমন কিছু তো শুনিনি। আর প্রেম-ট্রেম হ’ল একটা অভ্যাস। কিছুদিন মিশলে অনেক অকিঞ্চিৎকর ব্যাপার-স্যাপার আপোষ হয়ে যায়।  

- এটাকে অকিঞ্চিৎকর বলছো? আমি হলে তো কাট্টি করে দিতাম?

- সবাই তো তুমি নয়। পৃথিবীতে সবাই আলাদা। এখানেই ভগবানের সৃষ্টির সৌন্দর্য্য।

-দ্যাখো, যেখানে প্রেমটাই দাঁড়িয়ে আছে একটা শৈল্পিক বচনের উপর- সেখানে সেইটা নড়ে যাওয়া মানে তো ভিতটাই নড়ে যাওয়া।

-হয় তো এইটুকুর উপর প্রেম দাঁড়ায় না। ওটা একটা টোটালিটি। মানুষটা কেমন, সে কেয়ার করে কিনা, ওর অনুভূতি কেমন- সব নিয়েই প্রেম। নির্মল মানুষটা তো খারাপ নয়। ও নিজেই অহনাকে বলেছে চিঠি লেখানোর কথা। সেরকম হ’লে তো চেপে যেতে পারতো।

- তবু! এই নিয়ে তোমার সাথে অহনাদি’র কথা হয়নি কখনো?

- হ্যাঁ, হয়েছে। ছাড়ো না ওসব কথা! আর বলতে ইচ্ছে করছে না এসব।

-বলো না শুনি। বউদের সব কথা শুনে রাখা ভালো! যখন বিপদে পড়বে, কে বাঁচাবে তখন? বেশ সিরিয়াস শোনালো কুহুর গলা।

- বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না কুহু! যে কথা কোনও দিন কোনও পক্ষে ভুল করেও উচ্চারিত হয়নি, তাতে আবার বিপদ আপদ কি? শুনতে চাইছো, ঠিক আছে। অন্য কোনও স্মেল নিওনা।

- আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে। এবারে বলো।

- নির্মল যখন চাকরী পেল, তাও ধর আঠাশ বছর হয়ে গেল, তখন প্রথম প্রবেশনারি পিরিয়ডে ন’মাসের জন্য ওর ট্রেনিং পড়ল ব্যাঙ্গালোরে। সেই সময় নিয়ম করে অহনা আমার কাছে আসতো।

- নিয়ম করে মানে? রোজ?

    আড়চোখে কুহুকে দেখলাম। স্ত্রী’রা বোধহয় কিছু ব্যাপারে এক। কোথাও যেন একটা আশঙ্কা, অচেনা প্রতিযোগিতা। কোথাও যেন সে হেরে যাচ্ছে অহনা’র কাছে- এমন এক উদ্বেগ নিয়ে চেয়ে আছে আমার দিকে। বললাম- ‘না। তেমন নির্দিষ্ট কিছু ছিল না। ধর সপ্তাহে দুদিন। শনিবারটা আসতোই। কখনও কখনও তার আগে কোনও দিন।‘

- কোথায় যেতে? সিনেমা?

- সিনেমা হয়তো দু-একবার গেছি। তবে বেশীরভাগ সময়ে নন্দন চত্বরেই যেতাম; কখনো হয়তো বাগবাজার গঙ্গার পাড়ে, কখনও বা এমনি রাস্তাঘাটে।

- সবই তো প্রেম করার জায়গা গো!

- কেন, নন্দনে প্রেমিক-প্রেমিকা ছাড়া যায় না?

- তা যায়। তবে বেশীরভাগটাই ওরা কিনা!

- আমাদের ওই অল্পভাগের মধ্যে ধরতে পারো! যা হোক, একদিন অহনাই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল- আচ্ছা মিহিরদা- তুমি শুনেছি নির্মলের হয়ে চিঠিপত্র লিখে দিতে। প্রথম যখন তুমি লিখেছিলে, তখন আমাকে দেখেছ? আমি বলেছিলাম- না। তবে নির্মল ফটো দেখিয়েছিল।

- আচ্ছা তুমি যা যা লিখেছিলে- তা কি তোমার কথা ছিল?

- তা কেন? আমি নির্মলের হয়ে লিখছি যখন, ওর মতো করেই লিখব। আমি তো তোমাকে চিনতাম না!

- আচ্ছা যখন চিনলে, তখনও তো কয়েকবার লিখেছ। তখনও কি অন্যের হৃদয়ের কথা লিখতে?

- অবশ্যই।

- এটা কি বিশ্বাস করা যায়? এতটা জীবন্ত করে হৃদয়ের কথা, এভাবে?- সত্যি বড় কঠিন!

- এজন্যই তো আমি লেখক,অহনা! লেখক-কবিরা লেখার গুনবত্তাই যাচাই করে শুধু। তারা যা কিছু লেখে- সব কি নিজের কথা?

     কুহু মাঝপথে কথার রেশ টেনে বললো, সত্যি মিহির, আমাকে লুকিও না, তুমি যা কিছু অহনাদি’কে লিখেছ তাতে নিজের হৃদয়ের ছিটেফোঁটাও ছিল না?

- না।

- কিন্তু তুমিই তো বলো, কবি লেখকেরা সবকিছুকে নিজের হৃদয়ের রসে নিষিক্ত করে লেখে। সেকি ঠিক নয়?

- সব কথা কি সব সময় কোনো এক প্রসঙ্গে লাগানো যায়, কুহু? প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা ক’রো না।

- আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে। বলো। অহনাদি কী বলল?

- অহনা চুপ করে রইল। আমি বললাম, আচ্ছা ধর যদি আমার কথাই লিখেছি, তবে?

- মিছিমিছি ধরব কেন? যেটা সত্যি নয়, সে কথা ধরিনা আমি।

- দ্যাখো অহনাদি নিশ্চই চিঠির লেখকের প্রেমেই পড়েছিল। কুহু ফুট কাটলো।

- তুমি বুঝে গেলে?

- তুমি নাকি লেখক? এ কথা থেকে বুঝলে না, ও তোমার থেকে কী শুনতে চাইছিল?

    আমার ও তাই মনে হয়। তবে স্বীকার করলাম না ওকথা। এবার যদি কুহু বিশ্বাস করে নেয়, এরপর অহনা ফোন-টোন করলে সন্দেহের চোখে দেখবে। কথা ঘোরানোর জন্য বললাম, যাবে নাকি  বাইরে? এখন তো বৃষ্টি একটু ধরেছে।

- এখন যাবে? এই তো সন্ধ্যা নামবে!  

- নামুক। চেঞ্জ করার দরকার নেই। কেড্‌স্‌টা বরং পায়ে লাগিয়ে নাও।

    আমরা দুজন বাংলোর বাইরে এসে দাঁড়ালাম রাস্তায়। দুপাশে সারি দিয়ে সেগুন গাছ। ওপাশে শিরীষ, প্রচন্ড ঔদ্ধত্য, তবু কোথাও যেন আবার নরম, বিশেষ করে পাতা গুলো। সারাক্ষণ ব্যাঙের অওয়াজ নেপথ্যের শূন্যতাকে যেন ভরিয়ে তুলেছে। কতরকমের পাখি। বৃষ্টি মাথায় বুঝি প্রাণ পণে ফিরে যাচ্ছে যে যার বাসায়। কুহু বলল- নদীর পাড়ে যাবে কি এখন?

- অনুপ বারবার করে বারণ করল যে! বলল, এখন নাকি ওদিকে যাওয়া নিষেধ করে গেছে ফরেষ্টের লোকজন।

- কেন?  

- তা তো জানি না। হাতি-ফাতিরা বেরিয়েছে বোধহয়।

- আচ্ছা মিহির, তুমি জঙ্গল নিয়ে কিছু লিখেছ?

- একটাই কবিতা লিখেছি বোধহয়। গল্প কিছু লিখিনি।

- লেখো বরং আজ।

     বুঝলাম আমি যাতে অহনার মুড থেকে বেরোতে পারি, কুহু তার জন্য তার মতো করে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বললাম- ওইসব আমি লিখতে পারি না। ও সব লালাদা’র জন্য।

- বুদ্ধদেব গুহ?

- হ্যাঁ। বিভূতিভূষন নইলে বুদ্ধদেব। জঙ্গলে শুধু ‘ব’ এর অধিকার! আমি তো ‘ম’।  

- তাই বলে বলো না- তোমার অধিকার পঞ্চ ‘ম’ কারে! আমি কিন্তু দু চক্ষে দেখতে পারি না ও সব। রাতে শুধু মাংসই চলতে পারে। অন্য কিছু নয়।

- রাতের খাবার বলে দিয়েছ আজ?

- না, না। তুমি থাকো, আমি বলে আসছি। কুহু বাংলোর দিকে ফেরার উদ্যোগ করল। আমি বললাম- যাচ্ছই যখন, আর এসো না। সন্ধে হয়ে এসেছে। আমি একটু পরে আসছি।

    একটা পুরোনো গুঁড়ি পড়ে আছে রাস্তার একপাশে। বোধহয় মাঝে মাঝে লোকজন বসে। চারপাশে তেমন আগাছা নেই। আমি তাও একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বসলাম তার উপর। ওদিকে কদম গাছ সারি সারি চলে গেছে গাঢ় হয়ে জঙ্গলের মধ্যে। আস্তে আস্তে একটা দুটো জোনাকি এসে জ্বলতে শুরু করেছে তার ভেতর। দশ মিনিটের মধ্যে, হাজার হাজার জোনাকি এসে ছেয়ে ফেলল চারপাশ। কী সুখে তারা ডানা মেলে দিয়েছে আনন্দে, দেখেও মন ভরে যায়। একদিন বাগবাজারের ঘাটে এরকমই এক সন্ধ্যায় অহনা বলেছিল, ‘আচ্ছা মিহিরদা, তুমি তোমার নিজের প্রিয়জনদের নিয়ে গল্প লেখো? বা নিজের উপর?’

- না অহনা। আমি চারপাশের থেকে বিষয় নিই, তবে কাছের লোকজনদের নিয়ে লিখি না। তাতে তারা বিড়ম্বিত হয়।

- তাই কি? আমার তো মনে হয়- কেউ যদি আমাকে নিয়ে লেখে- সেটা আমার পক্ষে ভাগ্যের। সম্মানের।

- আমি তো নামী নই, অহনা। দু একটা গল্প কবিতা এদিক ওদিক ছাপা হয়। তবে সত্যি যদি কখনও নাম হয়, তখন লিখব তোমাকে নিয়ে।  

- আমি কী করে বুঝব- ওটা আমি।

- সে ঠিক বুঝে যাবে। তোমার চরিত্র, তুমি চিনবে না?

- কী লিখবে মিহিরদা? কতটুকু চেনো আমায়?

- যতটুকু চিনি, তাতেই চলবে অহনা। বাকীটুকু কল্পনা করে নেব।

    অনেকক্ষন চুপ করে রইল অহনা। বললাম, নির্মলের সাথে কথা হয়েছে এর মধ্যে?

- হ্যাঁ। ও বুধবার আর রবিবার এস.টি.ডি করে রাত সাড়ে আটটায়। আসলে আমাদের মেসবাড়ীর কাকীমার ঘরে ফোন তো! সব সময় করা যায় না।

- আমাকে ফোন করেছিল কাল। ও তো বোধহয় সামনের মাসেই ফিরবে।

- হ্যাঁ। আমাকেও তাই বলেছে।

- দ্যাখো, দেখতে দেখতে আটমাস কেটে গেল। এবার আর আমার সাথে তোমায় বেড়াতে যেতে হবে না, অহনা।

- যাক্‌ বেঁচে গেলে।

- এভাবে বলছ কেন?

- কেন? তুমি কি আমায় মিস্‌ করবে?

    কী বলব একথার উত্তরে। মিস্‌ তো করবই। তবে সে কথা বলা কি ঠিক হবে? বন্ধুর হবু স্ত্রী। বিয়ে হবে এটা মোটামুটি দু’পক্ষের বাড়ীর লোকও জানে। আজ নতুন করে প্রগল্ভতা করে কী লাভ?

      চিন্তায় ছেদ পড়ল কুহু’র পায়ের শব্দে। কী গো! অন্ধকার হয়ে গেল, এখনও ফিরলে না?

-এই জোনাকির জ্বলা-নেভা দেখছিলাম। উঠতে ইচ্ছে করছে না। বোসো একটু।

-রাত হয়েছে; সাপ খোপ বেরোবে। বাড়ী চল। বারান্দা থেকে দেখব না হয়! বলেই হাত ধরে টান মারল কুহু। ওর আঁচলেও কয়েকটা জোনাকি এসে বসেছে। সে যেন এখন নিজেই জোনাকীর মতো জ্বলছে, নিভছে। কখনও মনে হচ্ছে- প্রজাপতির পাখা। কুহুর হাতটা মুঠোয় ধরে বললাম, রাগ করেছো?

- কেন, রাগ করব কেন? অহনাদি’র কথায়?

- না, না। এই আবার আমায় ডাকতে এলে অন্ধকারে!

- ওঃ এই কথা! এ তো তোমার স্বভাব! আমি কি তোমায় আজ নতুন দেখছি?

   কাব্য করে বললাম- ‘তুমি আমার পুরোনো সই, প্রাচীন কালের সখী’।

-রাত্রে মাংস ভাত খাবে তো? নাকি রুটি?

-ভাতই খাই। রুটি খেয়ে খেয়ে জিভ ভোঁতা হয়ে গেল।

-সুগার ধরানোর সময় মনে ছিল না? আসলে এত ফুলে মধু খাও, সুগার ধরবে না তো কী হবে! মিষ্টি করে হাসল কুহু।

-কখন খাবার দিতে বলেছো?

-এই ন’টা নাগাদ।

-তাহলে আর একবার চা বল না!

-আচ্ছা তুমি গিয়ে বস, আমি বলে আসছি।

    একটু বাদে কুহু এসে বসল আমার ঠিক পাশ ঘেঁসে, আর একটা চেয়ারে। বলল- কী হল? যেটা বলতে পারোনি সে কথা বললে না তো!

-থাক্‌, রাতে বলব। এখন চারপাশটা দ্যাখো। কী সুন্দর জোনাকীর আলো! এমনটা বোধহয় আগে দ্যাখোনি কখনও।

-না, তা দেখিনি। তবে এখন দেখার মন নেই।

-কেন, মন উচাটন হল কি সে? অহনায়?

-হ্যাঁ। এখন শুধু শোনার মন। বলো, তারপর কী হলো?

-তারপর আবার কী? বিয়ে হয়ে গেল- বেড়ানোর নটে গাছটি মুড়োল।

-আরে, বিয়ে তো হবে দেরীতে। এখনও অনেক মাস প্রিয়া তোমার কব্জায়! তার ডায়রিটা বলো।

-অত কি আর মনে আছে কুহু!

-সব মনে পড়ছে আজ তোমার। বলে ফ্যালো। দেখা হলে তোমরা কী বলতে?

-অহনা যখন আমার কাছে আসতো- বেশীর ভাগ সময়েই বিভিন্ন লেখা, কবিতা নিয়েই কথা হ’তো আমার সাথে। আমার নিজের লেখা শুনতে চাইতো খুব।

- বুঝেছি। যদি তাতে কোথাও নিজেকে খুঁজে পায়!

- ইয়ারকি মেরো না কুহু।

- না গো। সত্যি মনে হয়, ও তোমার লেখায় খুঁজতে চাইতো বোধহয় নিজেকে।

- সে যাই হোক, মেয়েটা সাহিত্যটা কিন্তু ভালো বোঝে। ফিজিক্স নিয়ে পড়েছে যদিও, কিন্তু ভীষণ সূক্ষ্ম রসবোধ।

- আমার চেয়েও বেশী?

     একটু ঈর্ষা কি কুহুর? কুহু খুবই বড় মনের মেয়ে, তবু নারী তো! গলায় নাটক এনে বললাম- তোমার চেয়ে বেশী বোদ্ধা পৃথিবীতেই কেউ নেই, অহনা তো কোন ছার!  

-সত্যি! বউ পটানো’র একটা কোচিং ক্লাস খুলতে পারো তুমি! অনেক সংসার বেঁচে যাবে তা হলে! যা হোক, বলো এবার।  

-দিন কাটতে লাগলো দ্রুত। ন’মাস আর কতটুকু। দেখতে দেখতে নির্মলের আসার সময় চলে এল।

-আচ্ছা নির্মলদা’কে নিয়ে তোমাদের মধ্যে কথা হ’ত না?

-খুব কম। কোন ইনফর্মেটিভ কথা ছাড়া তেমন হ’ত না। ও নিজে থেকে বলতো না। কিন্তু আমায় নির্মল যবে ফোন করত, সেই ইনফর্মেশনটা আমি দিতাম।

-অহনাদির সাথে তোমার দেখা হয় কিনা নির্মলদা জিজ্ঞাসা করত না?

-হ্যাঁ। সেই তো বেশী করে আমায় উৎসাহ দিত আমি যাতে অহনাকে সঙ্গ দিই, ও একা থাকে, গভীর মনের মানুষ ও, ইত্যাদি ইত্যাদি।

-নির্মলদা সত্যি কিন্তু খুব ভালো মানুষ।

-আমি কি তা অস্বীকার করেছি। নাকি তার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছি।

-না, তা নয়। ও  জেলাস হতে পারতো। তোমার সাথে ওর বাগ্‌দত্তা ডেটিং করছে।

-ডেটিং করছে বলো না। ও অহনাকে চেনে, আমাকেও চেনে। ওর জেলাস ফিল করার কারণ নেই। আর তাছাড়া বাগ্‌দত্তার অন্য কোনও পুরুষ বন্ধু থাকতে পারে না- এমনটা ভাবার মত গোঁড়াও নয় নির্মল।

-তুমি কি তবে অহনাদি’র বন্ধু ছিলে? বা এখনও আছো? সোজা চোখে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল কুহু।

-দ্যাখো কি ছিলাম- আজ বলা বড় মুশকিল। তবে বন্ধুই ছিলাম বোধহয়।

-তাই যদি হ’ত- তবে তার রেশ এখনও থাকতো। এখনতো তোমাদের মনে হয় না- বিশেষ বন্ধু বলে।

-তা হয়তো হবে। তবে ওই ন’মাস আমরা বন্ধুর মতোই কাটিয়েছি।

-কখনোই নয়। যদি বন্ধু হ’তে, তবে পরস্পর পরস্পরের কাছে মনের কথা শেয়ার করতে। তোমরা পরস্পর পরস্পরকে মেপেছ, কিন্তু ধরা দাও নি। কাব্য-কবিতায় শুধু আড়াল খুঁজে গ্যাছো ন’মাস। 

    ভেবে দেখলাম, কুহু একদম ঠিক কথাই বলছে। সত্যি আমরা শুধু জরিপ করেছি অন্যকে। অহনার কথা ‘ও’ই জানে, কিন্তু আমি সব সময় ভেবেছি- ও অন্যের- ওকে নিয়ে আমার ভাবা পাপ, অন্যায়। অথচ আমি যেমন মেয়ে পছন্দ করি, অহনা কি তার চেয়েও বেশী ভালো নয়? আমার লেখার এতখানি গুণমুগ্ধ পাঠিকা কি আমি আমার চারপাশে পেয়েছি? আজ এই বয়সে এসে মনে হয় কোথাও তার প্রতি আমার দুর্বলতা কি ছিল না? আজ কুহু যেন আঠাশ বছর আগের আয়নাটা দেখালো আমাকে।  

-কী গো, বল তারপর! নির্মিলদার ফিরে আসার সময় হল পর্যন্ত বলেছো।  

-হ্যাঁ। নির্মল আসার দিন বারো আগে হঠাৎ করে অহনার মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ওদের বাড়ী তো জানোই- বর্ধমানে। তো খবর পেয়ে অহনা বাড়ী চলে গেল। মাঝে একদিন আমি ওদের বাড়ী ফোন করে ওর মা’র খোঁজ খবর নিলাম। যেদিন নির্মল আসবে, তার আগেরদিন দুপুরবেলা ফোন করল সে। আমাদের হোস্টেলের নীচের ফ্লোরে একটা কয়েন ফেলা বুথ ছিল। ওটা শুধু হোস্টেলের ছেলেদের জন্যই। ফোনে অহনা বলল, “মিহিরদা, কালকে তো নির্মল আসছে। তুমি কি হাওড়া আনতে যাবে?

-হ্যাঁ। যাবোই তো! তুমি?

-হ্যাঁ। আমিও যাবো। কাল ভোরে বাড়ী থেকে মেসে ফিরব। তারপর স্নান-খাওয়া সেরে দুপুর তিনটে নাগাদ তোমার হোস্টেলে চলে যাব। সেখান থেকে একসাথে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নেওয়া যাবে।

-তুমি আবার এতদূর আসবে কষ্ট করে?  তার চেয়ে তিনটের সময় পাঁচমাথার মোড়ে দাঁড়াও না! ওখানেই মিট করে নেব।

আসলে অহনা আমাদের হোস্টেলে আসুক চাইছিলাম না মোটেই। নির্মলের অনুপস্থিতিতে ও মাঝে মাঝে আসতো বলে বন্ধু মহলে চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছিল- এই যেমন হয় আর কি! ‘বেশ তো বন্ধুর মাল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! কী রে, একফুল দো মালি কেস্‌ নাকি রে? নির্মলকে কেউ এসব কথা লাগাক, চাইছিলাম না আমি। ও বলল, ‘ঠিক আছে। তিনটেতেই দাঁড়িও। ট্যাক্সি পেতেও তো টাইম লাগবে। তাছাড়া পোস্তার জ্যাম!’

- ও তুমি চিন্তা ক’রো না। আমি ঠিক তিনটেতেই চলে যাব।

- আজ রাতে কি তুমি কোথাও যাবে, বা কোনও কাজ আছে?

- না, কেন বলো তো?

- না মানে, রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ একটু নীচে ফোনের আশেপাশে থাকবে? একটু দেরীও হতে পারে। বাড়ীর সবাই ঘুমোলে তবে ফোন করব।

- বাড়ীতে সব ঠিক আছে তো, অহনা?

- না, না, সবই ঠিকঠাক।

- আসলে মাসিমার শরীর খারাপ, তারপরেও তুমি চলে আসছো নির্মলকে রিসিভ করতে- তাই বলছিলাম আর কি!

- না, না। মা জানে তো, নির্মল আসবে কাল! তাছাড়া মায়ের শরীরও ভালো আছে এখন। সেসব কিছু না।

- তবে?

- অন্য কিছু কথা আছে।

   অন্য কী কথা থাকতে পারে অহনার? আমি ভাবতে ভাবতে কোনও কূল কিনারা পেলাম না। কী এমন কথা যা বাড়ীর লোক ঘুমোলেই বলা যাবে? কোনও বিপদ-আপদ হ’ল না তো! দুশ্চিন্তা নিয়ে কোনও কাজ, পড়াশুনাই হ’ল না সেদিন। রাত সাড়ে-দশটা বাজতে না বাজতেই আমি খেয়ে দেয়ে নীচের টিভি রুমে এসে বসলাম। চোখ টিভিতে রেখেছি ঠিকই, তবে কান রয়েছে টেলিফোনে। একসময় রাত সাড়ে-এগারোটা পার হ’ল। দু-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফোন এল অহনার।

-হ্যালো...।

-ও, মিহিরদা। ভালোই হয়েছে তুমি ধরেছো। এত রাতে অন্য কেউ ধরলে, তোমাকে ডাকাটা বড় এমব্যারাসিং হত। খেয়েছো?

-হ্যাঁ। তোমার খাওয়া হয়েছে? 

-দশটার মধ্যে আমাদের খাওয়া হয়ে যায়। মা-বাপি সবাই ঘুমোতে গেল। আমারও একটু গোছগাছের ছিল, তাই দেরী হল। কাল যাবো তো?

-হ্যাঁ। এবার বলো, কী বলবে বলছিলে।  

বেশ খানিকক্ষন চুপ থেকে অহনা বলল- কী বলব মিহিরদা, কিছু ভালো লাগছে না! মনে হচ্ছে, সব যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে, কোনও কিছু আমার নিয়ন্ত্রনে নেই...

    কী বলব এর উত্তরে? খানিকক্ষন চুপ  থেকে আমি বললাম- এইবার সব ঠিক হয়ে যাবে। নির্মল আসছে তো কাল!

- আমি তো তাই ভাবছি মিহিরদা। ও কাল আসবে, অথচ আমার মনে কেন আনন্দ নেই? কেন মনে হচ্ছে ও এখন না এলেও কিছু যেত আসতো না? 

-আসলে অনেকদিন ওকে দ্যাখো নি তো! অনেকদিন অদর্শনের এমন একটা অভ্যাস হয়ে যায়। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

-তুমি কি সবজান্তা? অমনি মেরে দিলে, অনেকদিন না দেখলে এমন হয়? ঝাঁঝিয়ে উঠল যেন সে।

-আমার মতামত জানতে চাইলে, তাই জানালাম। মানা না মানা তোমার ইচ্ছে। একটু গম্ভীর শোনালো আমার গলা। বিষয়টা তিক্ত হয়ে গেল বুঝলাম। কিন্তু বাক্য বেরিয়ে গেলে ফেরাবার উপায় থাকে না। আমি চুপ করে রইলাম। বোধহয় বিষয়টা বুঝে অহনা বলল- স্যরি! ওভাবে বলতে চাইনি মিহিরদা।

     আমিও গলাটা যতটা সম্ভব মৃদু করা যায় সেই ভাবে বললাম- বুঝেছি তোমার কথা। তুমি চিন্তা ক’রো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

-তোমার আনন্দ হচ্ছে?

-কেন? নির্মল আসছে বলে!

- হুঁ।

-হ্যাঁ, খুব আনন্দ হচ্ছে। বহুদিন পর ছেলেটা আসবে। ওর তো ওখানে সম্বর-টম্বর খেয়ে অবস্থা খারাপ। তাছাড়া বহুদিন বাড়ী ছাড়া।

-তা ঠিক।

 আমি বললাম- কিছু বলবে বলছিলে?

- বললাম তো! তুমি তো নিদানও দিয়ে ফেলেছ।

     আবার চুপচাপ অনেকক্ষন। রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে পরস্পর পরস্পরের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে লাগলাম। একসময় বললাম -কিছু আর কি বলবে অহনা?

- একই কথা যদি আমি তোমায় জিজ্ঞাসা করি?

    একটু চুপ থেকে পরিষ্কার গলায় বললাম- না, আমার কিছু বলার নেই। গলার স্বর যতটা দৃঢ় করতে চেয়েছিলাম, দেখলাম ততটা দৃঢ় শোনালো না নিজের কানেই। ও বলল- ‘আচ্ছা গুড নাইট’। আমিও বললাম-  ‘গুড নাইট। কাল ঠিক সময়ে দাঁড়াবো’।

      ফোনটা রেখে শুতে গেলাম যখন, রাত প্রায় বারোটা। আমাদের হোস্টেল জীবনে এটা এমন কিছু রাত নয়। তবে আজ হঠাৎ করে যেন রাত্রির গভীরতা এসে ছুঁয়ে গেলো মনে। যেন কত রাতের তপস্যা এসে ব্যর্থ  হল গহণ নির্জনে। মনে মনে ভাবলাম, সত্যি কি কোনও কথা বলার ছিল না আমার? অহনার খারাপ লাগার রেশটুকুও তো লালন করা যেত কিছুক্ষণ! জীবন তো একটাই। আজ যদি সত্যি তার মনে নির্মলের সাথে বাকী জীবনটা কাটানো নিয়ে কোনও ধন্ধ এসে থাকে, তার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে অন্তত আলোচনার সুযোগটুকু দেওয়াটা কি ওর প্রাপ্য ছিল না? আমি কি শুধু নিমিত্তের ভাগী হবো না বলেই হৃদয়ে পাথর চাপিয়ে দিই নি? এরকম নানারকম চিন্তায় ভোরের আলো ফুটল। চোখেমুখে জল দিয়ে হোস্টেলের ছাদে এসে দাঁড়ালাম। বহুদিন তো ভোর দেখিনি। মহালয়ার দিনেও রেডিওটা চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি আজ বহু বছর। অদ্ভুত নীল এক আকাশের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে শুকতারা। ঠিক যেন, চোখ মেলে চেয়েছে আমার দিকে! চারপাশের গাছপালায় শুরু হয়েছে ব্যস্ততা, পাখিদের ঝটপটানি। দিনমণির জেগে ওঠার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে পূব আকাশে। এই আকাশটা আজ শুধু নির্মলের।     

      বেলা তিনটে বাজার কিছু আগে পাঁচমাথার মোড়ে গোলবাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু বাদে অহনা এল। একটা হালকা হলুদ রঙের চুড়িদার, উপরে নীলের উপর জরি দেওয়া কুর্তি। চোখে হালকা কাজল, কপালে ছোট্ট একটা কালো রঙের টিপ। লিপ্‌স্টিক ও সাধারনত মাখে না। আজ গ্লসি লিপ্‌বাম্‌ টাইপের কিছু একটা লাগিয়েছে ঠোঁটে। খুব সাধারন সাজ, তবু বড় অপূর্ব লাগছে আজ ওকে। অনেক সাধাসাধির পর একটা ট্যাক্সি যেতে রাজী হল হাওড়া স্টেশন। পেছনের সিটেই বসলাম দুজনে। সারা রাস্তায় বিশেষ কথা ছিল না কারও মুখে। কিছুটা অস্বস্তি এড়ানোর জন্য বললাম- ‘তোমাকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, অহনা।‘

-ওঃ। মেয়ে পটাতেও পারো তুমি?  

-সত্যি! সিরিয়াসলি বলছি।

-আসলে আগে কখনও তোমার মুখে প্রসংশা শুনিনি কিনা! গত ন’মাসে আমাকে বুঝি একদিনও সুন্দর লাগেনি?

-কখনও বলিনি বুঝি?

      কিছু বলল না অহনা। ফর্সা দুটো হাত নিয়ে ওর হাতব্যাগের থেকে বেরিয়ে থাকা একটা সুতো নিয়ে খেলতে শুরু করল। খুব ইচ্ছে হল, আমার হাতটা দিয়ে ওর হাতটা ছুঁয়ে দেখি। সংবরন করলাম নিজেকে। কী লাভ?

- তারপর? অনেকক্ষণ পরে কথা বলল কুহু।

- তার আর পর নেই। না বলা কথার পথ শেষ হ;ল। আর আমার কথাটাও ফুরোলো।

-তবে একটা কথা মানতেই হবে মিহির, অহনাদিকে দেখলে কখনোই কিন্তু মনে হয় না- এমনটা কখনও তোমাদের রিলেশান ছিল।

- অহনা এরকমই। ডিগনিফায়েড।  

-দ্যাখো, একটা সময় তো ওরা প্রায়ই আমাদের বাড়ীতে আসতো বা আমারা যেতাম ওদের বাড়ী। সত্যি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল ওর উপর।

-আর আমারটা বললে না তো? আমাকে দেখে কি কখনও তোমার মনে হয়েছে কিছু? কপট কৌতুক করলাম আমি।

-তুমি তো ছুপারুস্তম! এ বিষয়ে তুমি মহামোহপাধ্যায়। তবে একটা কথা শ্রোতা হিসেবে মনে হ’ল আজ। বড় নির্দয় ব্যবহার তুমি করেছো অহনাদি’র সাথে।

-না হলে তুমি আজ কোথায় থাকতে সোনা? বলে হালকা হাতে কুহুর হাতটা চেপে ধরলাম আমি।

      কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার হাতের মুঠি থেকে হাতটা সরিয়ে নিল কুহু। বলল, ‘আজ তোমার স্পর্শে আমি নেই মিহির। আজ তুমি অন্য কারও আছো। তুমি বোসো, আমি বরং দেখি, চা টা এখনও দিল না কেন।‘ বলেই আস্তে আস্তে হাঁটা দিল কুহু। হঠাৎ এক ঝাপ্‌টা জোলো হাওয়া এসে আছড়ে পড়ল ঘরে, ওর গায়ে। শাড়ীর আঁচলটাকে কোনও ক্রমে দুহাত দিয়ে বাগে আনল সে। এখন আর ওই আঁচলে একটাও জোনাকি বসে নেই।
🍂


Post a Comment

0 Comments