সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ৪২
গৌতম বাড়ই
এবার ঘরে ফেরার পালা আর গান
বসন্তসেনার ভালোমামা আর মামি বেরিয়ে যেতেই রিসোর্ট ছাড়লেন ওরাও। সবে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করেছে, এমন সময় রাম- লখনের সেই তরুণ ম্যানেজারটি জোরে হাঁক দিলেন, ড্রাইভারকে উদ্দেশ করে - " এই ভাই দাঁড়াও, দাঁড়াও । " ড্রাইভার দাঁড়িয়ে যেতেই ছেলেটি ছুটে এলেন গাড়ির কাছে। সুশোভনের দিকে হাসিহাসি মুখ করে বাড়িয়ে দিলেন একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ। -- " নিন দাদা, এতে আমাদের রিসোর্টর বাগানের পেঁপে রয়েছে। আপনি ঘুরে-ঘুরে বাগান দেখছিলেন না? পেছনের সেই বাগানের। "
সুশোভন হাতে নিয়ে দেখল বেশ ভার লাগছে। গোটা চার- পাঁচেক বেশ ভালো সাইজের পেঁপে আছে ওতে। তবে সকালের দিকে দিলে, সবাইকে দেওয়া যেত। এইসব মনে করে ভাবতে ভাবতে সুশোভন ইতস্তত করে পকেটে হাত দিতে যাচ্ছিলেন, এই না দেখে সেই তরুণ ম্যানেজারটি বললেন--" দাদা রিসোর্টের তরফ থেকে এ আমাদের উপহার আপনাদের। তবে খুব সকালে আর সময় করে উঠতে পারিনি। দিতে তাই একটু বেলাই হয়ে গেল। সকালে দিলে আপনাদের সাথে আরও যারা এসেছিলেন তাদেরও দিতে পারতেন, এই যা ভুল হয়ে গেল। এ পেঁপে খেয়ে দেখবেন স্বাদ- ই আলাদা। একদম বাড়িয়ে বলছি না। বুঝলেন স্যার, এ হলো এখানকার মাটির কেরামতি। মাটিই তো আসল পৃথিবীতে। মাটির গুনেই দেখবেন শুধু গাছ নয়, সেখানকার মানুষজনও কত ভালো! এই আমাদের বীরভূম যেমন। "
ছেলেটি কখনও দাদা বলছে, কখনও স্যার। স্যার বললেই যেন কেমন প্রাণহীন বাণিজ্যিক সম্পর্ক মনে পড়ে। তবে ছেলেটি মনের কথাও বেশ ভালো পড়তে পারে তো দেখছি, ওই যাকে থট্ রিডিং বলে। তাহলে এই ম্যানেজারের পোস্টটি এই রিসোর্টের একজন উপযুক্ত মানুষের কাছেই ন্যস্ত আছে। তরুণ ম্যানেজার ছেলেটি আবার বললেন, "স্যার আবার এলে নিশ্চয় এখানেই এসে উঠবেন। আমাদের আতিথেয়তা আশা করি ভালো লেগেছে। তবে এই ভিজিটরস বুকে কিছু ভালোলাগা আর অভিজ্ঞতা লিখে দিয়ে যান। " এই বলে আর একটি হাতে ধরা, সে একটি লাল হার্ড কভারে মোড়া ভিজিটরস বুক সুশোভনের দিকে এগিয়ে দিলেন। আর আবারও বললেন," আমি স্যার এই রিসোর্টে ম্যানেজার হয়ে ঢুকেনি, রাম- লখনের মালিক আমার কাজে খুশি হয়ে আমাকে এই ম্যানেজারের পদটি আজ দু- বছর হল দিয়েছেন। জানেন, এই সোনাঝুরির এই রিসোর্টের বয়স খুব বেশি নয়, মেরেকেটে দশবছরও হয়নি। এই হাটের মাঝে অবশ্য এ ধরণের রিসোর্ট আমরাই প্রথমে করি। আজ তো অগুনতি আশপাশে মিলিয়ে। তবে এর সাথে আমার রোজগারের থেকেও বড় একটি ভালবাসার সম্পর্ক রয়েছে। আমি হোটেল ম্যানেজমেন্ট বা কোনও ম্যানেজমেন্ট পড়িনি, একজন সামান্য গ্র্যাজুয়েট। আপনাদের ভালোলাগা আমার পরম প্রাপ্তি। ঐ আলোদিদিকে বলবেন, এত সুরেলা কন্ঠ আমি অনেকদিন পর শুনলাম রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে। খুব সুন্দর গান গান। আমাদের এই রিসোর্টে কত কত নামী শিল্পী গায়ক এঁনারা এসে থাকেন, তবে কাউকে অমন কন্ঠ উজাড় করে দিয়ে বনরাতের নিস্তব্ধতায় গাইতে শুনিনি। চমৎকার! চমৎকার! " ভালোলাগাটা যে অকপট স্তুতি, তা তার চমৎকার শব্দের উচ্চারণের দ্বিত্বে বোঝা গেল। ওখানে থাকবার সময় বুঝিনি, ম্যানেজার ছেলেটির সংগীতের প্রতি এত অনুরাগও আছে।হয়ত সাহিত্যের প্রতিও থাকতে পারে।
🍂
আবার এর সাথে, এই তরুণ ম্যানেজারের কথা শুনে আবারও অবাক হলেন । মনের কথাটি ভালোই পড়তে পারেন ছেলেটি। সুশোভন ভিজিটরস বুকে পাতা ভরিয়ে তরুণ ম্যানেজারের অনেক সুখ্যাতি করে লিখে দিলেন। ম্যানেজার ছেলেটি হাত নাড়িয়ে তাদের বিদায় জানালেন। তারা এবারে বেরিয়ে পড়লেন বীরভূম ছেড়ে কলকাতার পথে। পথে পড়বে বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া জেলাও। তারপর কলকাতা। গাছে গাছে সবুজ কচিপাতায় ভরা। এই বসন্ত ঋতুতে যাদুর মতন ঘটে, সারারাতে গাছের মরা ডালে কেমন করে যেন সবুজ নবীন পাতা গজিয়ে ওঠে। এই নব বসন্তের জল হাওয়া পেয়ে তারা বেড়ে উঠছে, বোঝাই গেল। এত রঙ প্রকৃতিতে গাছের গায়ে! অভিজিৎ আর সুশোভন টুকটাক কথা বলে চলছিল। বাইরের প্রকৃতি মুগ্ধ হয়ে দেখছিল বসন্তসেনা। গাড়ি ছুটে চলছিল তার স্বাভাবিক গতিতে, দৃশ্যপট বদলে যায় বারবার গাড়ির কাচের বাইরে। তেমনি মানুষের মনের অন্তরের দৃশ্যপট বদলে যায় ক্ষণে- ক্ষণে এই তেপান্তরের মতন ভুবনে।
চারুদত্ত এসে দূরের শিমূলতলা থেকে হাত বাড়িয়েছে বসন্তসেনার দিকে। উজ্জয়িনী নগরীর নটী বা একটু বাঁকা ভাষায় সোজাসুজি বললে গণিকা । কামদেবের মন্দিরে চোখাচুখি, মদনদেবের পঞ্চশরে বিদ্ধ বাসবদত্তা। গণিকা বাসবদত্তা, বিদূষী বাসবদত্তা, সারাগায়ে স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা। ধূতা তো চারুদত্তের স্ত্রী, তরুণী ভার্যা। রোহসেন ফুটফুটে বালক। চারুদত্ত তার বাবা। সবজেনেও যে প্রেম, তা তো পরকীয়ার আধারে প্রাণ নিবেদন। পরকীয়াতেও মাধুর্য্য খোঁজে বাসবদত্তা। এ এক যুগোত্তীর্ণ এক নাটক। শুদ্রক নাট্যকার। মৃচ্ছকটিক, ইংরেজিতে অনুদিত নাম দ্যা ক্লে কার্ট। বাবার কাছে বসন্তসেনা শুনেছে, এই বসন্তসেনার কাহিনী । পড়ে বড় হয়ে তো পড়েছে সে নিজে, একবার নয়, অনেকবার। পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত। ভালবাসতে দোষ কোথায়? রাজার শ্যালক শকার ছিল এই উজ্জয়িনীর এই সুন্দরী গণিকা তথা মহীয়সীর প্রতি আদিমরসের জারণে অনুরক্ত। সেটা দেহভোগের বাসনা, প্রেম নয়। অনেক অনুনয় বিনয়, অনেক পটানোর চেষ্টা, সে নাকি মনুষ্যরূপী দেবকল্প কৃষ্ণ। বাসবদত্তা বললেন- "কিন্তু তোমার মতন গুনহীনদের আমি অপছন্দ করি। অনুরাগ জন্মায় গুণে, শক্তি প্রদর্শনের জন্য নয়।" শক্তি আর ক্ষমতার বলেও মানুষকে দখল করা যায় কিন্তু তাতে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে থাকে ক্রোধ, যা ভালবাসার বিপরীত, একদিন সুযোগ বুঝে তার লাভা ছড়িয়ে পড়ে , ছাই করে দেয় ক্ষমতাকে। আর আমাদের বাসবদত্তাও দূরে শিমূলতলায় হাত বাড়িয়ে দেয় চারুদত্তের দিকে, সেই গরীব সুদর্শন ব্রাহ্মণ সুপুরুষের দিকে। অথচ একদিন এই চারুদত্ত এই উজ্জয়িনী নগরীর ধনাঢ্য বণিক ছিলেন। লক্ষ্মী চিরদিন চঞ্চলা। ধনসম্পত্তি নিয়ে তাই অহঙ্কার করতে নেই!
আর রাঢ়ের প্রান্তরে দূর থেকে ছুটে আসছে কে? ঘোড়ার খুরের ধ্বনি। অনুর , সেনাপতি অনুর। এই বাসবদত্তা কাকে ভালবেসেছে? মন দিয়েছে উজাড় করে ঢেলেছে কাকে বেশি? দিবাস্বপ্ন? নাকি মন ছুটে চলে সেই সময়ের কালে? চমক ভাঙ্গল বাবার ডাকে- " হ্যা রে হাসনুমা তুই কি ঘুমিয়ে পড়লি?"
-" না ! না! এই চোখ জুড়িয়ে আসছিল কত কী ভাবতে ভাবতে তাই। "
সুশোভন বলল-" না মা তুই তো গাড়িতে ঘুমোস না কখনো। বাইরের দৃশ্যে মগ্ন থাকিস বেশি। ঠিক আমার মতন। তাই তোর চুপ করে থাকতে দেখে জিগ্গেস করলাম। আর দেখ তোর অভিকাকু নাকের ভেঁপু বাজিয়েই চলেছে। "
অভিজিৎ ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসলো, এবং বলে উঠলো - " একদমই নয়। আমি চারবার মাত্র নাসিকা গর্জন করেছি। সব টের পেয়েছি রে। খুব সকালে উঠেছি না! "
--" তাই তো এখন গর্জন। তর্জনে- গর্জনে চলুক আমাদের শুভ সফর। " সুশোভন বলেন।
এমন সময় ড্রাইভার ছেলেটি মোহিত বলে সুশোভন কে -" কাকু শক্তিগড় তো এসেই গেল। ল্যাংচামহলে দাঁড়াব তো? "
অভিজিৎ বলে--- " আরে তা আবার বলতে হবে! ল্যাংচার ভুবনধরে যাব, ল্যাংচা চেখে দেখব না তাই কী হয়? "
বসন্তসেনারা গাড়ি দাঁড় করিয়ে ল্যাংচামহলে ঢুকে গেল। তবে তার অর্থাৎ বসন্তসেনার এই কিম্ভুতকিমাকার মিষ্টিটি একদম পছন্দের তালিকায় নেই। তার মা দীপশিখা খুব ভালোবাসতেন। তার বাবা বর্ধমানের এদিক দিয়ে গেলে ল্যাংচার হাঁড়ি নিয়ে ঢুকতেন খুব মনে পড়ে। তখন এত ল্যাংচার দোকানগুলো এত ঝা চকচকে ছিল না। কিন্তু শক্তিগড়ের ল্যাংচার নামডাক বা সমাদর ছিল বরাবর। বিশ্বায়নের ছোঁয়া এখানেও লেগেছে। বড় বড় রাস্তার চারপাশে এখন যেমন চেকনাই দেওয়া ধাবা- রেস্তোরাঁ। সেই চিরপরিচিত ধাবা, সেই দড়ির খাটিয়া পাতা সাবেকী পাঞ্জাবী ধাবাগুলো হারিয়ে গেল বা যাচ্ছে সময়ের কালের স্রোতে। এইভাবেই তো পুরানো হারিয়ে গিয়ে নতুন তার জায়গা করে নেয়। লুচি- তরকারি আর ল্যাংচা এবং অন্যান্য কিছু মিষ্টি খেয়ে আবার কলকাতার পথে যাত্রা শুরু হল তাদের।
যেতে যেতে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ের ওপর একটা জায়গায় মোহিতকে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন সুশোভন। ডানহাতে বিঘাকে বিঘা কৃষিজমি দেখিয়ে বললেন অভিজিৎ-কে-" অভি বল এই পড়ে থাকা জমিগুলো কিসের? "
অভিজিৎ বলে-" কিসের মানে? কৃষিজমি। তো কী হয়েছে?
- আরে সে তো সবাই জানে। কিন্তু এ জায়গাটার নাম কী জানিস ?
- কেন? সিঙ্গুর কী? তবে টাটাদের প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়া সেই নির্মীয়মান গাড়ির কারখানাটা, যা অহরহ সব সংবাদমাধ্যমে দেখতাম, তা কোথায়?
-" এইজন্যই তো গাড়ি থামালাম। সে কারখানা ভেঙে গুঁড়িয়ে নিয়ে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এই জায়গাটি ভবিষ্যতে আরও একবার ট্র্যাজিক স্থান হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেবে। আর বাঙালির সমস্ত আশা আকাঙ্খা, ভবিষ্যতের সমৃদ্ধ এক বাঙলা গড়বার স্বপ্নও সেইসাথে জলাঞ্জলী দেওয়া হয়েছিল। "
দোষ কারও নয় কো মা! নিজের দোষে, নিজেই দোষী।বাঙালি স্বপ্ন দেখাতে নয়, স্বপ্ন ভাঙতে বড্ডো ভালবাসে। তবে সিঙ্গুর এই নামটি আরও যত্ন করে বুকের মাঝে লিখে রাখ। পরে একদিন তোকে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য দেব। অবিভক্ত বাংলার বঙ্গভঙ্গ রুখল বাঙালি,আন্দোলন করে ১৯০৫ সালে, কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রুখতে পারল কী? আর এর বদলা, ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরে গেল। গরীব কৃষকদের আরও ক্ষতিপূরণের দাবি উঠতেই পারত কিন্তু একটা প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়া কারখানাকে বিতাড়িত করে, এই রাজ্য থেকে শিল্পকেই তাড়ান হল। কে ভালো ? সরকার না বিরোধীপক্ষ? না আমাদের সুশীল সমাজ? এর থেকেও বড় প্রশ্ন একজন সৎ প্রশাসক বাংলার ক্ষয়িষ্ণু যুবসমাজের জন্য মুখ থুবড়ে পড়া শিল্পায়নের ফের পুর্নজন্ম দেওয়ার জন্য অন্তত ভেবেছিলেন । পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছি না, তবে তাকে সমূলে উৎপাটন করে দেওয়াটা যে ভবিষ্যতের এক অশনি সংকেত , আজ হাড়ে- হাড়ে টের পাচ্ছি। এই সিঙ্গুর এক ট্র্যাজিক স্থান, বিষাদগ্রস্ত স্থান। কেন? আমাদের হেঁটে যেতে হবে ইতিহাসের পথে সেই সুদূরে খ্রিস্টের জন্মের আগে। যখন ইতিহাস একটু একটু করে ইতিহাস হয়ে উঠছে।
বসন্তসেনা বলে - বাবা আজ শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকের কাহিনী বলবে তো। তোমার মুখে আবার শুনতে চাই। আমারও তো চারুদত্তকে যেমন ভালো লাগে , তেমনি ধূতার চরিত্রও মনে দাগ কেটে যায়। সাইলেন্ট লাভার বলে কোনও শব্দ আছে? থাকতেই হবে।
-"তবে রোহসেনকে মদনিকা যে খেলনা মাটির তৈরী গরুর গাড়ি এনে দিয়েছিল, তার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে শূদ্রকের দশ অধ্যায়ের পুরো নাটকটা। মৃচ্ছকটিক। অবশ্যই আজ সন্ধের আড্ডায় হবে।" অভিজিত বলে- " আর অবশ্যই তোদের সুসীমাকে নিয়ে উপন্যাসের কিছু কথা। "
বসন্তসেনাই তো আমার হাসনু-মা! সুশোভনের কথায় সবাই হেসে ওঠে একসাথে। কলকাতার দিকে গাড়ি এগিয়ে চলে।
0 Comments