ভোলগাগ্রাদের থিয়েটার
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫২
বিজন সাহা
ভোলগাগ্রাদের ইতিকথা
এখন যখন ভোলগাগ্রাদ সম্পর্কে লিখছি ঠিক সেই মুহূর্তে রুশ দেশে উদযাপিত হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ের ৭৯ বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। তাই লিখতে গিয়ে বার বার মনে পড়ছে শত শত মুভিতে ধরে রাখা সেই যুদ্ধের কাহিনী, মনে পড়ছে মহান পিতৃভূমির যুদ্ধের উপর লেখা শত শত বইয়ের গল্প।
ভোলগাগ্রাদ –স্বপ্নের ভোলগাগ্রাদ। কতবার যে এই শহরের নাম শুনছি। বিশেষ করে এই শহরের মামায়েভ কুরগান – যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান মেমোরিয়াল। এক সময় মনে করা হত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই শহরে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে, তবে কয়েক বছর আগে জানা গেছে ভোলগাগ্রাদের চেয়েও বেশি মানুষ মারা গেছে রঝেভে। সে গল্প আমরা পরে বলব। উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই শহরের নাম ছিল ৎসারিৎসিন। বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে বিভিন্ন শহরের নাম পরিবর্তনের করার হিড়িক পরে যায় আর সেই সূত্র ধরে ১৯২৫ সালে কমরেড স্তালিনের সম্মানে ৎসারিৎসিনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় স্তালিনগ্রাদ। আর সে কারণে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই যুদ্ধ স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ নামে পরিচিত। স্তালিনের মৃত্যুর পরে খ্রুশেভের (আমাদের দেশের তিনি ক্রুশ্চেভ নামেই অধিক পরিচিত) শাসনামলে যখন ব্যক্তি পূজার সংস্কৃতি বিশেষ করে স্তালিনের কাল্ট ধ্বংস করা শুরু হয় তখন ১৯৬১ সালে স্তালিনগ্রাদ নতুন নাম পায় – ভোলগাগ্রাদ। এটা করা হয় ১৯৬১ সালের ১০ নভেম্বর সুপ্রিম সোভিয়েতের এক নির্দেশ অনুযায়ী। এ নামটি অবশ্য কৃত্রিম কেননা রুশ ইতিহাসে এভাবে সরাসরি নদীর নামে জনপদের নাম রাখার ঐতিহ্য নেই। দশ লক্ষাধিক (২০২৩ সালের হিসেবে ১০২৫৬৬১ জন) জনসংখ্যার এই শহর ভোলগা নদীর তীরে বৃহত্তম শহরগুলোর একটি।
ভোলগা তীরের সিঁড়িএই শহরের উৎপত্তি ১৫৫৫ সালের দিকে ভোগলার বাম তীরের অনতিদূরে একটি দ্বীপে। পরে এই জনপদ ভোলগার দক্ষিণ তীরে ৎসারিৎসা নদীর মোহনায় স্থানান্তরিত করা হয় এবং এই নদীর নামেই জনপদের নাম রাখা হয় ৎসারিৎসিন। ৎসারিৎসা শব্দটি এসেছে তুর্ক শব্দ সারী-সু থেকে যার অর্থ হলুদ জল। এছাড়াও ধারণা করা হয় যে দ্বীপের নাম থেকে শহরের নাম ৎসারিৎসিন রাখা হয়। অন্তত চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতকের বিভিন্ন মানচিত্রে ৎসিৎসিরা নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হল এতদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল ৎসারিৎসা মানে সম্রাজ্ঞী থেকে ৎসারিৎসিন নামটি এসেছে। যদি ভোলগা নদীর ভ্রমণ কাহিনী লিখতে না বসতাম তাহলে সারা জীবন এ ব্যাপারে গাধাই থেকে যেতাম।
বর্তমানে যেখানে ভোলগাগ্রাদ অবস্থিত সেখানে সুখাইয়া ও মক্রাইয়া বা শুকনো ও ভেজা মেচেতকা নামক দুই নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় গোল্ডেন হোর্ডদের বসতি ছিল। তবে সেই জনপদের নাম জানা যায়নি। রুশ অভিবাসীরা এই জনপদের ধ্বংসাবশেষ মেচেত দুর্গ নামে ডাকত। এখানে ১২৭৪ থেকে ১৩৭৭ সাল পর্যন্ত উলুসা জুসির মুদ্রা পাওয়া গেছে। তবে বর্তমান ভোলগগ্রাদ এই জনপদের উত্তরাধিকারী নয়। এই জনপদ ৎসারিৎসিনার ১৮ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ছিল এবং এই শহর প্রতিষ্ঠার ২০০ থেকে ২৫০ বছর আগেই ধ্বংস হয়ে যায়। তাছাড়া ৎসারিৎসা নদীর মোহানায়ও গোল্ডেন হোর্ডদের বসতি ছিল।
ভোলগাগ্রাদের ভোলগা তীরে
১৭০৭ – ১৭০৮ সালের কৃষক যুদ্ধের সময়ও ৎসারিৎসিন এর কেন্দ্র স্থলে পরিণত হয়। পিওতর দ্য গ্রেটের রাজত্বকালে (১৬৮২ - ১৭২৫) রুশ দেশে বিশাল বিশাল সব পরিবর্তন ঘটতে থাকে – রাশিয়া কৃষ্ণ সাগর থেকে বাল্টিক পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে, মস্কো থেকে রাজধানী সাঙ্কত পিতেরবুরগে স্থানান্তরিত হয়। এসব পরিবর্তনের ফলে কৃষকদের উপর খাজনার চাপ বাড়ে, বাড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার চাপ। ফলে প্রচুর কৃষক দন (ডন) ও ভোলগার ভাঁটি এলাকায় পালিয়ে যেতে শুরু করে। রুশ দেশের অধীনে থাকলেও সে সময় এসব এলাকায় প্রশাসন তেমন শক্তিশালী ছিল না। সেখানে ছিল মূলত স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন। মস্কোর সাথে বিভিন্ন স্বার্থ সংক্রান্ত যোগসাজশ থাকলেও এসব এলাকা সরাসরি মস্কো দ্বারা শাসিত হত না। পিওতর দ্য গ্রেট পলায়নকারী কৃষকদের ফিরিয়ে দেবার জন্য আল্টিমেটাম দিয়ে যুবরাজ দলগোরুকিকে সেখানে পাঠান। কিন্তু সে আদেশ না মেনে কসাকরা অগ্রবাহিনী ধ্বংস করে। এই বিদ্রোহের নেতা কন্দ্রাতি বুলাভিন সমস্ত এলাকা জুড়ে অভ্যুত্থান গড়ে তোলার চেষ্টা করে। দীর্ঘ কনফ্রন্টেশনের পর দলগোরুকির ৩০ হাজার সেনাবাহিনী দ্মিত্রিয়েভস্ক, ৎসারিৎসিন ইত্যাদি জনপদ দখল করেন। বুলাভিনের বিদ্রোহ, পরবর্তীতে সুইডেনের সাথে যুদ্ধে সেনাবাহিনীতে যোগদান ইত্যাদির ফলে ভোলগা-দন এলাকা দুর্বল হয়ে পড়ে যার সুযোগ নিয়ে ক্রিমিয়ার খান এই এলাকায় লুটতরাজ চালায় যা কুবান পোগ্রোম নামে পরিচিত। ১৭১৭ সালের এই পোগ্রোমে ক্রিমিয়ার তাতার ছাড়াও নোগাই, চেরকাস – এরা অংশ গ্রহণ করে ও অনেক যুদ্ধবন্দীকে অটোমান সাম্রাজ্যে বিক্রি করে। এসব ঝটিকা আক্রমণ বন্ধ করার জন্য ১৭১৮ সালে ৎসারিৎসিন বর্ডার লাইন তৈরি শুরু হয়। দনের কসাকদের সাহায্যের জন্য অশ্বারোহী বাহিনী পাঠানো হয়। কসাকরা আগে নিজেদের সর্দার নিজেরাই নির্বাচন করত, এখন রাজধানী থেকে সর্দার মনোনীত হতে শুরু করে। ভোলগা অঞ্চলে যুদ্ধ ও অভ্যুত্থানের শেষ যুগ ছিল ১৭৭৩ থেকে ১৭৭৫ সাল। খাজনা ও দাস প্রথার অত্যাচারে জর্জরিত কসাকরা এমিলিয়ান পুগাচেভের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়। পুগাচেভ নিজেকে তৃতীয় পিওতর হিসেবে ঘোষণা করে। জেনারেল সুভরভের নেতৃত্বে রুশ বাহিনী পুগাচেভের বাহিনী ধ্বংস করে, পুগাচেভকে মস্কো নিয়ে আসা হয়, যেখানে ১৭৭৫ সালের ১০ (২১) জানুয়ারি তাঁকে ফাঁসি দেয়া হয়।
ভোলগাগ্রাদের ভিডিও
https://www.youtube.com/watch?v=QZDUvUSbRkk&t=28s
ভোলগাগ্রাদের ছবি
http://bijansaha.ru/album.php?tag=261
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments