মিলি ঘোষ
বাঁকুড়ার দরিদ্র গ্রাম যোগীপাড়া। সেখানকার এক অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে রামকিঙ্করের জন্ম। একেবারে ধুলোবালি মেখে বেড়ে ওঠা যাকে বলে। কুমোর পাড়ায় গিয়ে মাটির হাঁড়ি, কলসি, গ্লাস বানানো দেখতেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তেমন হয়তো অনেকেই দেখেন। কিন্তু রামকিঙ্করের দৃষ্টি ছিল সুদূরপ্রসারী। সে দৃষ্টিতে স্বপ্ন ছিল না। কিন্তু খিদে ছিল। নেশা ছিল। নিজের হাতে মাটি দিয়ে এটা ওটা বানাতেন। তাঁর কাজের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু ছিল। তাই প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রমানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের চোখে পড়েন। তিনিই রামকিঙ্করকে শান্তিনিকেতনে পাঠান নন্দলাল বসুর কাছে। সেটা ১৯২৫ সাল। বাঁকুড়ায় নিজের গ্রামের বাইরে যিনি পা দেননি কোনওদিন, তিনি কী করে শান্তিনিকেতন চিনবেন? অনেক ঘুরে শেষমেশ পৌঁছেছিলেন নন্দলাল বসুর কাছে। শান্তিনিকেতনে কলাভবনে তিনি ভর্তি হন। নন্দলাল বসু নাকি রাম কিঙ্করের কাজ দেখে বলেছিলেন, তুমি তো সবই শিখে এসেছ। এখানে কী করতে? আসলে তিনি ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী। কিন্তু শান্তিনিকেতনই তাঁর কাজ করার আদর্শ জায়গা হয়ে উঠল। সেখানে উন্মুক্ত পরিবেশে কিঙ্কর নিজের শিল্প চর্চা করে গেছেন অক্লেশে। সিমেন্টের সঙ্গে কাঁকর মিশিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর বেশিরভাগ সৃষ্টির কেন্দ্রে থেকেছে গ্রামীণ জীবন। সাঁওতালদের জীবনযাত্রা তাঁকে খুবই প্রভাবিত করেছিল। মাটির কাছাকাছি মানুষদের তিনি পছন্দ করতেন। ওদের পরিশ্রম, ঘামকে তিনি মর্যাদা দিয়েছেন। অলস, সুখী জীবনের কাহিনী তাঁর সৃষ্টিতে কখনও স্থান পায়নি। এতটাই প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন যে, খোলা আকাশের নিচে গাছপালার মধ্যে বসে কাজ করেই আনন্দ পেতেন। গাছের শিকড় আর কাণ্ডই ছিল তাঁর প্রথম পছন্দ। পাথর খোদাই, তেল রঙ, জল রঙ সবেতেই তিনি পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। পাশ্চাত্যের মতো মডেল পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। যা তৎকালীন সমাজে তাঁকে সমালোচনার শীর্ষে রেখেছিল।
🍂
বহু প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ রামকিঙ্করকে মানসিক শক্তি যুগিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ দেখছিলেন কিঙ্করের সৃষ্টিকে। তাঁর অসামান্য প্রতিভাকে। তাঁর নিজস্ব শিল্পীসত্তাকে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা বোঝেনি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন কিঙ্করকে, যখন যে কাজটা করবে, একদম বাঘের মতো ঘাড় মটকে ধরবে। ওটা শেষ করে তবে অন্যটাতে হাত দেবে।
ছন্নছাড়া বেখেয়ালি রাম কিঙ্কর আজীবন দরিদ্রই থেকে গেছেন। খাটের তলায় পাহাড় প্রমাণ চিঠি। খুলেও দেখেননি কোনওদিন। কত গুণমুগ্ধের ভালোবাসা মিশে ছিল হয়তো সেই চিঠিগুলিতে। কিন্তু রামকিঙ্কর এরকমই। গতানুগতিকতায় অবিশ্বাসী এক মানুষ। যিনি সবার থেকে আলাদা। তবু নিজেকে কখনও দরিদ্র ভাবেননি। তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই জীবনের প্রতিটি রূপ রস নিহিত ছিল। তাঁর সৃষ্টিই তাঁকে মহান করেছিল। জাগতিক চাওয়া পাওয়া এসব তো নিতান্তই মূল্যহীন।
আজও মানুষ শান্তিনিকেতনে 'হাটের পথে এক সাঁওতাল পরিবার'কে দেখে অবাক হয়। 'সুজাতা' দেখে মুগ্ধ হয়। অথচ সেই সময় এই সুজাতাই নিন্দার ঝড় তুলেছিল।
সাহিত্যিক সমরেশ বসুর লেখা অসমাপ্ত উপন্যাস 'দেখি নাই ফিরে', সে তো রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়েই লেখা। দুঃখের বিষয় রমরেশ বসু সেটি শেষ করে যেতে পারেননি। পারলে হয়তো আমরা আরও অনেক অজানা তথ্য পেতাম। জানতে পারতাম এক অসামান্য ভাস্করের জীবন গাঁথা।
আজ ২৫মে রামকিঙ্কর বেইজের জন্মদিন। তাঁর প্রতি রইল আমার অশেষ শ্রদ্ধা।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments