জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে /তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী /৩৫তম পর্ব

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে              
তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব               
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী      
৩৫তম পর্ব


তবে কৃষ্ণ চরিত্রের মধ্যে এমন একটা সম্মোহনী শক্তি লুকিয়ে আছে যে কেউ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহস করে না। কিন্তু কতদিন তিনি এইভাবে অবক্ষয়কে রোধ করে যাবেন। আগের মতো তাঁর কর্মের মধ্যে উদ্যম আর নেই। তিনি যেন এখন এক নির্লিপ্তির জগতে পৌঁছে গেছেন। তিনি বুঝতে পারছেন যে তাঁর পৃথিবীতে অবস্থানের মেয়াদ হয়তো বা শেষ হয়ে এসেছে। তার মনে যন্ত্রণার এক সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সব কিছু চিন্তা করে তিনি শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন তীর্থ ভ্রমণে বের হবেন। কিন্তু এই সময় এক ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ হস্তিনাপুর থেকে তার কর্ণে প্রবেশ করল। বনবাসে যেয়ে মহাত্মা বিদূর পরলোক গমন করেছেন। বিদূরকে বরাবর শ্রীকৃষ্ণ যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর চোখে বিদুর এমন এক স্বর্গীয় চরিত্র যিনি কখনো কোন কর্মের বা সিদ্ধান্ত গ্রহনের মাধ্যমে অথবা বাক্যের প্রয়োগবিন্যাসে কলঙ্কিত হননি। তিনি সর্বদা ধর্মপক্ষকে সমর্থন করেছেন। বিদুরের মৃত্যু সংবাদ সাময়িকভাবে শ্রীকৃষ্ণকে জীবন সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করে তুলল। কিন্তু তখন পর্যন্ত কৃষ্ণ জানতেন না যে তার জন্য আরও অনেক বড় শোক অপেক্ষা করে আছে। পুনরায় কিছুদিন বাদে হস্তিনাপুর থেকে বার্তাবাহক সংবাদ নিয়ে এলো বনবাসে থাকাকালীন ভয়ঙ্কর দাবানলে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী সমেত কুন্তি দেহত্যাগ করেছেন। এই সংবাদ কৃষ্ণের মনে এক আলোড়ন তুলল। তিনি বুঝতে পারলেন এই পৃথিবীতে কোন কিছুই চিরস্থায়ী বা অনিত্য নয়। এই মহামৃত্যুর মিছিলে তাঁকেও হয়তো একদিন অংশ নিতে হবে। 

🍂

মনের সমস্ত নৈরাশ্য দূর করে শ্রীকৃষ্ণ স্থির করলেন তীর্থ ভ্রমণে তিনি যাবেন এবং শেষ অবধি দ্বারকার রাজসভায় তিনি সকলের সামনে তার এই মনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। রাজসভায় সকলে কৃষ্ণের মনের অবস্থা চিন্তা করে মহারাজ উগ্রসেন তাঁকে তীর্থ ভ্রমণের অনুমতি দিলেন। কৃষ্ণের অন্তরের বেদনা সকলে যেন উপলব্ধি করতে সমর্থ হলেন। অনুমতি পাওয়ার পরে কৃষ্ণ তাঁর রথের সারথি দারুককে নিয়ে গরুড়ধ্বজ রথে আরোহন করে দ্বারকা ত্যাগ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ যতদিন দ্বারকায় ছিলেন ততদিন দ্বারকার যুব জনতা গোষ্ঠী কিছু পরিমানে সংযত ছিল। কিন্তু তিনি যখন তীর্থযাত্রায় দ্বারকা ত্যাগ করে চলে গেলেন তখন এই যুবসমাজ ক্রমশ যেন অসংযমী ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠলো। দ্বারকা থেকে যে সমস্ত নারায়নী সেনা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন তাদের বিধবা পত্নীদের কিছু অংশ পুরুষ সঙ্গলাভে বঞ্চিত হয়ে ব্যভিচারিনী হয়ে উঠলেন। প্রকাশ্য রাজপথে দ্বারকার যুব সমাজ সুরা পান করে নানা ধরনের অসংযমী আচরণে লিপ্ত হয়ে পড়ল। অবাধে চলতে থাকলো নারীসংসর্গ। রাজসভায় যখন এই সমস্ত সংবাদ পৌঁছালো তখন কিন্তু বিভিন্ন গোষ্ঠীর বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারা এই অনৈতিক কাজকর্মে রাশ টানতে পারলেন না। কারণ পরিস্থিতি তখন তাঁদের হাতের বাইরে চলে গেছে। 

এই সময় স্বর্গ থেকে নারদ মুণি কৃষ্ণবিহীন দ্বারকার সংবাদ নিতে দ্বারকায় নেমে এলেন। সভায় প্রবীণেরা দ্বারকার বর্তমান পরিস্থিতি মুণিকে সমস্ত অবগত করালেন। সমস্ত ঘটনাবলী জ্ঞাত হয়ে নারদ মুণি বললেন দ্বারকায় শুভ অনুষ্ঠান এবং যজ্ঞ শুরু করতে হবে, না হলে দ্বারকার যুব জনসমাজ আরও বিপথে চালিত হবে যা কখনোই কাম্য নয়। নারদ মুনির কথা শুনে প্রবীণেরা বললেন কিন্তু কৃষ্ণবিহীন দ্বারকায় কিভাবে যজ্ঞানুষ্ঠান করা যাবে। তাঁদের বক্তব্যের যথার্থতা অনুধাবন করে নারদ মুনি শ্রীকৃষ্ণের অনুসন্ধান করতে বেরিয়ে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত তিনি দুর্গম বদরিকাশ্রমে যেয়ে শ্রীকৃষ্ণের সন্ধান পেলেন। তিনি কৃষ্ণকে দ্বারকার পরিস্থিতি সবিশেষ বুঝিয়ে বললেন। দেবর্ষির মুখে দ্বারকার এই শোচনীয় অবস্থার কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। তিনি তাঁর রথের সারথি দারুককে বললেন “শীঘ্র আমাকে দ্বারকায় নিয়ে চল। কিছু মাত্র বিলম্ব হলে দ্বারকার যুবশক্তিকে আমি আর বাঁচাতে পারবো না”। তখনো পর্যন্ত তাঁর নিজের উপরে সম্পূর্ণ আস্থা ছিল পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের। কিন্তু তিনি অনুধাবন করতে পারেননি দ্বারকার যুব সমাজ কি পরিমান অবক্ষয়ের পথে নেমে গেছে। দ্বারকাতে প্রত্যাবর্তন করে তিনি সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন।

নারদের মারফত দ্বারকাবাসীরা জানতে পারলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ দ্বারাবতীতে ফিরে আসছেন। এই সংবাদ শুনে সকলেই আনন্দিত হলেন বিশেষতঃ মহারাজ উগ্রসেন এবং তাঁর রাজ্যসভার অন্যান্য সদস্যেরা। তাঁদের মনে তখন একটাই আশা জাগলো এই উচ্ছৃঙ্খল যুব সমাজের হাত থেকে দ্বারকাকে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণই বাঁচাতে পারবে। দ্বারকাধিপতি শ্রীকৃষ্ণ দ্বারাবতীতে এসে দেখলেন যজ্ঞের আয়োজন প্রায় সম্পূর্ণ। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, হিমালয় ও বিন্ধ্যাচলের দুর্গম গিরিগুহা থেকে বিশিষ্ট মুনিঋষিরা সকলেই এসেছেন সেই যজ্ঞকে সম্পূর্ণ করতে কারণ শ্রীকৃষ্ণের আহুত যজ্ঞে তাঁরা দূরে থাকতে পারবেন না। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর রথ থেকে নেমে সমগ্র মুণিঋষিদের চরন বন্দনা করতে মুণিঋষিরা সকলেই কৃষ্ণকে মানবশ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করলেন। কারণ কৃষ্ণ জীবনব্যাপী সাধনার দ্বারা যে স্তরে উন্নীত হয়েছেন তা এক কথায় অসাধারণ।                                        

প্রাসাদে যাওয়ার পথে তিনি অগ্রজ বলরামকে রথে তুলে নিয়ে পথিমধ্যে জিজ্ঞেস করলেন "দ্বারকার যুব সমাজ কিভাবে এত উচ্ছৃংখল হয়ে গেল অগ্রজ? প্রশাসনের আধিকারিকেরা কি তাদের উপরে ন্যাস্ত দায়িত্ব পালন করতে সমর্থ্ হননি?" বলরাম সংক্ষেপে তাঁকে দ্বারকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করালেন। ঘটনাবলী শুনে কৃষ্ণ নিজেকে অপরাধী বলে মনে করলেন কারণ তিনি যদি দীর্ঘদিন দ্বারাবতীতে অনুপস্থিত না থাকতেন তাহলে হয়তো এই ঘটনাকে এড়ানো যেত।    

পরের দিন উষালগ্নে যজ্ঞ শুরু হবে। প্রাসাদে প্রবেশ করে সমস্ত রানীদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে তিনি রুক্মিনীর কক্ষে শয়নকালে জানালেন আগামীকাল উষালগ্নে যজ্ঞ শুরু হবে এবং সেই যজ্ঞের ঋত্বিক তিনি। কিন্তু বিধির নির্বন্ধে পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে তিনি সেই রাত্রিতে গাঢ়ঘুমে মগ্ন হয়ে রইলেন। পরের দিনে ঊষালগ্ন অতিক্রান্ত হতে চলেছে অথচ কৃষ্ণ তখনও শয্যাত্যাগ করেননি দেখে রুক্মিনী অধৈর্য হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। কৃষ্ণ শশব্যাস্ত হয়ে নিদ্রাত্যাগ করে রুক্মিনীকে প্রশ্ন করলেন "রুক্মিনী, উষালগ্ন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে তাহলে কি যজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে? যদি শুরু হয়ে থাকে তাহলে যজ্ঞের ধুম কেন আকাশকে সমাচ্ছন্ন করে নি?" তাঁর কথা শুনে রুক্মিণী শঙ্কাতুর কণ্ঠস্বরে বললেন "নাথ, দ্বারকাতে আর কখনোই কোন যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে না।" রুক্মিণীর মুখনিঃসৃত এই বাক্য শুনে কৃষ্ণের মনে হল ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হয়েছে। তিনি জীবনে কোন ঘটনায় এতখানি বিস্মিত হন নি। জীবনের চলার পথে তাকে অনেক বেশি প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। রুক্মিণীর মুখনিঃসৃত এই কয়েকটি শব্দ শুনে তাকে যেন একেবারে বিমূঢ় করে দিল। তিনি আর্তনাদ করে রুক্মিণীকে বললেন " রুক্মিনী, আমি তোমার কথার অর্থ অনুধাবন করতে পারছি না"। রুক্মিনী সমস্ত উত্তেজনা প্রশমিত করে সংযমী কণ্ঠস্বরে বললেন " আপনার জন্য অগ্রজ বলরাম, সাত্যকি, কৃতবর্মা প্রভৃতি সকলে রাজসভায় অপেক্ষা করছেন। আপনি তাঁদের কাছ থেকে সমস্ত ঘটনা জানতে পারবেন। তবে একটা কথা আমার মনে হয়েছে এক সর্বনাশা সংকেতের দিকে আমরা এগিয়ে চলেছি। জানিনা দ্বারকাকে এই পঙ্কিল আবর্ত থেকে কিভাবে আপনি মুক্ত করবেন।"        
                                            পরবর্তী অংশ ৩৬তম পর্বে..............

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments