বুদ্ধপূর্ণিমার আর এক নাম ‘ভেসাক’ উৎসব
পি.শাশ্বতী
এক বুদ্ধপূর্ণিমা থেকে আর এক বুদ্ধপূর্ণিমা পর্যন্ত সময়কে বৌদ্ধরা এক বৌদ্ধ বর্ষ বলে।
আজ সেই পবিত্র বুদ্ধপূর্ণিমা। দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বুদ্ধপূর্ণিমা সাড়ম্বরে উদ্যাপন করবে। ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’— এই অহিংস বাণীর প্রচারক ভগবান অবতারে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব। বোধিপ্রাপ্তি আর মহাপরিনির্বাণ-এর এই স্মৃতি বিজড়িত দিনটিকে বুদ্ধপূর্ণিমা হিসেবে পালন করেন বৌদ্ধ ভক্তরা।
গৌতম বুদ্ধের শুভজন্ম, বোধিজ্ঞান ও নির্বাণ লাভ এই ত্রিস্মৃতি বিজড়িত বৈশাখী পূর্ণিমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বিশ্বের সব বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি বুদ্ধপূর্ণিমা নামে পরিচিত। বৌদ্ধ ধর্ম মতে, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে এই দিনে মহামতি গৌতম বুদ্ধ আবির্ভূত হয়েছিলেন। অদ্ভুত ভাবে তাঁর জন্ম, বোধিলাভ ও মহাপ্রয়াণ এক দৈব-অলৌকিক ভাবে বৈশাখী পূর্ণিমার দিনেই হয়েছিল বলে এই বৈশাখী পূর্ণিমার অপর নাম ‘বুদ্ধপূর্ণিমা’ হিসাবে জগতে খ্যাত হয়ে আছে।
বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যায়, পূর্বজন্মে বোধিসত্ত্ব সব পারমি পূরণ করে সন্তোষকুমার নামে যখন স্বর্গে অবস্থান করছিলেন, তখন দেবগণ তাঁকে জগতের মুক্তি এবং দেবতা ও মানুষের নির্বাণ পথের সন্ধান দেবার জন্য মানুষের মধ্যে জন্ম নিতে অনুরোধ করেন। দেবতাদের অনুরোধে বোধিসত্ত্ব সব দিক বিবেচনা করে এক আষাঢ়ী পূর্ণিমায় স্বপ্নযোগে মাতৃকুক্ষিতে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী এক শুভ বৈশাখী পূর্ণিমায় জন্ম নেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল লুম্বিনী কাননের শালবৃক্ষ ছায়ায় উন্মুক্ত আকাশের নীচে। নাম হয় সিদ্ধার্থ।
জ্ঞান হবার পর থেকেই সিদ্ধার্থর মধ্যে দেখা দিতে থাকে এক অপার দিব্য চেতনা। তাঁর চারপাশের কোনো মানুষের মধ্যেই তিনি কোনো প্রভেদ রেখা টানতে শেখেননি। রাজ পরিবারের বৈভবের মধ্যে বেড়ে উঠলেও ক্রমেই তাঁর মধ্যে দেখা দিয়েছে সেই সাজানো বৈভবের প্রতি অজাগতিক এক উদাসীনতা। তাঁর কাছে জাতি, শ্রেণি ও গোত্রের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। তিনি মানুষকে মানুষ এবং প্রাণীকে প্রাণী রূপেই জানতেন এবং প্রতিটি জীবের প্রাণসত্তার মধ্যেই যে কষ্টবোধ আছে, তা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘সবেব সত্তা ভবন্তু সুখীতত্তা’--- জগতের সব প্রাণী সুখী হোক। বুদ্ধ বলেছেন, ‘জগতে কর্মই সব। মানুষ তার কর্ম অনুসারে ফল ভোগ করবে। ভালো কাজ করলে ভালো ফল এবং খারাপ কাজের জন্য খারাপ ফল পাবে। কর্মানুসারে মানুষ অল্প আয়ু, দীর্ঘ আয়ু, জটিল ব্যাধিগ্রস্ত, নীরোগ, বিশ্রী-সুশ্রী, সুখী-দুঃখী, উঁচু-নিচু, জ্ঞান-মূর্খতা ইত্যাদি প্রাপ্ত হয়। মানুষ কর্মের অধীন।'
তখন আকাশে বৈশাখী পূর্ণিমার চাঁদ। আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত। অনন্ত আকাশের তলে যুগ্ম শালবৃক্ষের নীচে সমবেতশিষ্যগণ। বুদ্ধ উচ্চারণ করেন মহাবাণী, "উৎপন্ন দ্রব্য মাত্রেরই বিনাশ অবশ্যম্ভাবী, অপ্রমত্ত হয়ে কর্তব্য সম্পাদন করো।” ৮০ বছর বয়সে বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমাতেই লাভ করেন মহাপরিনির্বাণ।
কোথাও কোথাও বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে উদযাপিত এই উৎসবকে ‘ভেসাক’ উৎসবও বলা হয়। ‘বুদ্ধ জয়ন্তী’ নামেও এই উৎসব বেশ পরিচিত অনেক দেশে। এটি একটি পালি ভাষা। পালি ভাষায় বৈশাখ ‘ভেসাক’ বলা হয়।
বুদ্ধবর্ষ বলে যা চালু আছে, সেটি বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লাভের পর থেকে গণনা শুরু হয়েছে।
কপিলাবস্তু থেকে শ্রাবস্তী, বৈশালী, চুনার, কৌশাম্বী, কনৌজ, মথুরা, আলবী (বর্তমান নেপাল, ভারত, ভুটান, পাকিস্তান,আফগানিস্তান) প্রভৃতি বহু জায়গায় বুদ্ধ ৪৫ বছর ধরে ধর্মপ্রচার করেন। জীবনের শেষ অধ্যায়ে তিনি রাজগৃহ থেকে কুশীনগর জন। কুশীনগরের কাছে পাবা নগরে গিয়ে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি মল্লদের শালবনে শালগাছের নীচে শেষ শয়ন নেন।
এখানে উল্লেখ্য, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক উত্থান এবং তার প্রসার ছিল অন্যান্য ধর্মের কাছে ঈর্ষণীয়। বৌদ্ধধর্মের দার্শনিক চিন্তাধারা যুক্তিবাদের সৌধের ওপর গড়ে উঠেছে। একবিংশ শতাব্দীতে সংশয়াচ্ছন্ন মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞান এক নতুন বিপ্লব ঘটিয়েছে। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন সর্বব্যাপী বিস্তার লাভ করে।
সম্রাট অশোক, সম্রাট কণিষ্ক, রাজা অজাতশত্রু, হর্ষবর্ধন এবং পালবংশীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই ধর্মের যে ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল, পরবর্তীতে তাঁদের আনুকূল্য হারাবার পরই বিভিন্ন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়ে এই দর্শন। একই সঙ্গে তৎকালীন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধদের সামাজিক অবস্থাও শৌর্য-বীর্যহীন হয়ে পড়ে।
সেই সময় বহু প্রথিতযশা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যাবার কারণে ত্যাগের ভারতবর্ষে রচিত বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিও স্থানান্তরিত হয়ে যায়। যেগুলির বেশির ভাগই সংরক্ষিত হয়েছিল নেপাল, তিব্বত ও চীনে। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবার থেকে আবিষ্কার করেন সেই সব বৌদ্ধ গ্রন্থের আকর। এদেশের সিদ্ধাচার্যদের রচিত বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন বৌদ্ধ গান ও দোহা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই উপমহাদেশে বৌদ্ধ সংস্কৃতি এক সময় বিস্ময়কর সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। পাহাড়পুর সোমপুরী মহাবিহার, বাসু বিহার, বগুড়ার মহাস্থানগড়, ইলোরা, গান্ধার প্রভৃতি আমাদের অতীত ইতিহাসের উজ্জ্বলতায় চিরভাস্বর।
১৯৫০ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড ফেলোশিপ অফ বুড্ডিস্ট’-এর প্রথম কনফারেন্সে বৈশাখ মাসের এই পূর্ণিমা দিনটিতে বুদ্ধের জন্মদিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীগণ এই দিনে স্নান করে শুচিবস্ত্র পরিধান করে মন্দিরে বুদ্ধের বন্দনা করেন। ভক্তরা প্রতিটি মন্দিরে বহু প্রদীপ জ্বালান, ফুলের মালা দিয়ে মন্দিরগৃহ সুশোভিত করে বুদ্ধের আরাধনায় নিমগ্ন হন। এ ছাড়া বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা এই দিনে বুদ্ধ পূজার পাশাপাশি পঞ্চশীল, অষ্টশীল, সূত্রপাঠ, সূত্রশ্রবণ, সমবেদ প্রার্থনাও করে থাকেন।
সারাবিশ্বের বুদ্ধ অনুসারী ভক্তরা আজ বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভক্তিতে পালন করছেন এই দিনটি। শ্রীলঙ্কায় ‘ভেসাক’ প্রায় এক সপ্তাহব্যাপী পালন করা হয়ে থাকে। এই এক সপ্তাহ শ্রীলঙ্কায় মদ, মাংস-সহ অন্যান্য বেশি কিছু খাদ্যদ্রব্য বিক্রি বন্ধ থাকে। এমনকি কসাইখানাগুলোকেও বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। দুঃস্থদের মধ্যে ভিক্ষা দান করার এক প্রচলিত রীতিও নেবে চলে হয় এই সময়ে। এইদিন সাধারণত বন্দি পশু-পাখিদের ‘মুক্তি’ করে দেওয়ার রেওয়াজ আছে এখানকার মানুষদের মধ্যে।
নেপালে একমাত্র এইদিনটিতেই স্বয়ম্ভূ মন্দিরের প্রধান ফটকটি খোলা হয়। ‘ভেসাক’ বা বুদ্ধ পূর্ণিমা এখানে ‘বুদ্ধ জয়ন্তী’ হিসেবেbপালিত হয়।
জাপানে বুদ্ধ পূর্ণিমা ‘হান্মাতসুরি’ নামে পরিচিত। চাইনিজ ক্যালেন্ডারের চতুর্থ মাসের অষ্টম দিনটিকে জাপানে ‘বুদ্ধ পূর্ণিমা’ হিসেবে পালন করা হয়। প্রচলিত উপকথা অনুসারে বুদ্ধের জন্মদিনের দিন আকাশ থেকে এক ড্রাগন আবির্ভূত হয়ে বুদ্ধের মাথায় ‘সোমরস’ ঢেলে দেয়। বর্তমানে এই সোমরসের জায়গা দখল করেছে ‘হাইড্র্যানজিয়া মাইক্রোফিলিয়া’ গোত্রের এক বিশেষ শ্রেণির ফুলের গাছ থেকে প্রাপ্ত চা, যা ‘আমাচা’ নামে পরিচিত। এই ‘আমাচা’ বুদ্ধের প্রতিকৃতির ওপর ঢেলে দেওয়া হয়ে থাকে এইদিন।
ভারতে বুদ্ধগয়ার ‘মহাবোধি’ মন্দিরে এইদিন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপক সমাগম ঘটে। দিল্লিতে এইদিন ন্যাশনাল মিউজিয়ামে, ১৮৯৮ সালে উত্তরপ্রদেশের পিপ্রাহা জেলা থেকে প্রাপ্ত বুদ্ধের দেহাবশেষ, যা প্রকৃতপক্ষে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধের বলে মনে করা হয়, তার প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়।
সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বুদ্ধপূর্ণিমার দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতি বছরই পালিত হয়। বৌদ্ধধর্মের উৎসব হলেও ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে সর্বসাধারণের জন্য এই দিনটি সরকারি ছুটি থাকে। প্যাগোডায় চলতে থাকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দিবস উদযাপনের যাবতীয় কার্যক্রম। এছাড়া বিভিন্ন গ্রাম ও বিহারে এই দিনে মেলা বসে। সবচেয়ে বড় মেলাটি বসে চট্টগ্রামের বৈদ্যপাড়া গ্রামে, যা ‘বোধিদ্রুম মেলা’ নামে পরিচিত। মানবজাতির সর্বাঙ্গীণ শান্তি ও মঙ্গল কামনায় এই দিনটিকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা চিরভাস্বর করে রেখেছেন।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments