বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে              
তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব               
লেখক - দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী      
৩৪তম পর্ব


সেই যুদ্ধে তিনি যদিও পান্ডবদের পক্ষ নিয়েছিলেন তথাপি তিনি দুর্যোধনকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন যে তিনি নিজে এই যুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবেন না। অর্জুনের অনুরোধে তিনি তাঁর রথের সারথি হবেন এবং তার পরিবর্তে তিনি দুর্যোধনকে অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী নারায়নী সেনা দিয়েছিলেন। এই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৃষ্ণ কোনদিন অস্ত্র হাতে ধারণ করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। একমাত্র ব্যতিক্রম হয়েছিল যুদ্ধের নবম দিনে যখন কৃষ্ণ কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে ভীষ্মকে হত্যার উদ্দেশ্যে সুদর্শন চক্র নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু সখা অর্জুনের পরামর্শে তিনি সেই কাজে নিবৃত্ত হন। অষ্টাদশব্যাপী কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে দেখা গেল দুর্যোধনের শত ভাইয়ের সাথে ভারতের ক্ষত্রিয়বর্গ প্রায় সকলেই নিঃশেষিত। আঠারো দিন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হওয়ার পরে ভারতবর্ষ সম্পূর্ণ রূপে অধর্ম মুক্ত হয়েছিল। যুদ্ধের শেষে গান্ধারী শ্রীকৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধিতে যেমন গান্ধারী তাঁর শত পুত্র এবং সমস্ত আত্মীয়স্বজনকে হারালেন যুদ্ধের ছত্রিশ বছর পরে সেই শোকাঘাত কৃষ্ণকেও সহ্য করতে হবে।   

দেখতে দেখতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ষষ্ঠদশ বর্ষ অতিক্রম করল ইতিমধ্যে রাজচক্রবর্তী রাজা যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পূর্ণ করেছেন। মানুষের মন থেকে সেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ভয়ঙ্কর স্মৃতি অনেকখানি অবলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে মাঝেমধ্যে কোন কোন মানুষ অশ্রু পূর্ণ নয়নে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কথা চিন্তা করেন। বিশেষ করে যে সমস্ত নারীরা ওই যুদ্ধে তাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছেন তারা এখনো মধ্যরাত্রে নিদহারা হয়ে চোখের জলে বুক ভাসান। তাদের সিঁথির সিন্দূর মুছে গেছে। অনেক জননী তার প্রিয়তম পুত্রকে বা ভাইকে হারিয়েছেন। অনেক নারী হারিয়েছেন তার প্রেমিককে। তাদের আর্তনাদে নৈশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। তবু দিন এগিয়ে চলে। সমগ্র ভারত ভূমিতে এখন বিরাজ করছে অপরিমেয় শান্তির বাতাবরণ। যুদ্ধ-বিগ্রহের ভয়ঙ্করতা থেকে সাধারণ মানুষ মুক্তি পেয়েছে। ভারতবর্ষের মতো এক বিশাল ভূখণ্ডে যে শান্তি স্থাপিত হয়েছে, অধর্মের অবসান ঘটেছে এর জন্য অবশ্যই সমস্ত কৃতিত্ব প্রাপ্য পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের। তিনি যদি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাণ্ডবদের সাহায্য না করতেন তাহলে প্রবল পরাক্রমশালী কৌরবদের পরাস্ত করা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। 


🍂

শ্রীকৃষ্ণ নরদেহে মর্তভূমিতে এসেছিলেন অধর্মকে বিনাশ করার জন্য। শৈশব থেকে তিনি দেখে এসেছিলেন ভারতের সর্বত্র রক্তাক্ত সংগ্রামের পরিস্থিতি ও পরিবেশ। রাজ্য লোভে সকলেই উন্মত্ত। সেখানে প্রিয়জনদের উপেক্ষা করে তাদের হস্তগুলি রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। তিনি তখনই এক অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছিলেন ভবিষ্যতে এক পরম ধার্মিক রাজাকে সাহায্য করবেন যে রাজার রাজত্বে সারা ভারতের বুকে এক অখন্ড শান্তি বিরাজ করবে। সেই রাজ্যের কোথাও অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার থাকবে না, ধনী-দরিদ্রের বিভাজন থাকবে না, নারীরা তাদের প্রাপ্য মর্যাদা পাবেন। সর্বগুণসমন্বিত পরম ধার্মিক রাজা যুধিষ্ঠিরের মধ্যে তিনি এই সমস্ত গুণাবলী খুঁজে পেয়েছিলেন।                          

ইতিমধ্যে শ্রীকৃষ্ণ হস্তিনাপুর থেকে দ্বারকায় ফিরে গেছেন। কিন্তু সেখানে যেয়েও তিনি মনে শান্তি পাচ্ছেন না। কারণ তার শারীরিক অবয়ব দ্বারকাতে আছে কিন্তু মন পড়ে আছে হস্তিনাপুরে। অনেকদিন যাবৎ হস্তিনাপুর থেকে কোন খবর পাননি। কিছুদিন বাদে হস্তিনাপুর থেকে এক ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদের খবর পেলেন। অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্র তাঁর সতী সাধ্বী স্ত্রী গান্ধারী, পান্ডব জননী কুন্তি এবং বিদুরকে নিয়ে শান্তিলাভের আশায় বনগমন করেছেন। তাঁর মনে হল ধৃতরাষ্ট্র হলেন জীবননাট্যের এক অত্যন্ত বিয়োগাত্মক চরিত্র। হয়তোবা তিনি ভবিতব্যের হাতের পুতুল। ভারতবর্ষে যে এক মহাযুদ্ধ সংঘটিত হবে তা আগে থেকেই নির্দিষ্ট ছিল। 

মহাভারতের ঘটনাবলী চিন্তা করলে আমাদের মনে হয় এই যুদ্ধকেও এড়ানো যেত যদি ধৃতরাষ্ট্র শক্ত হাতে তাঁর অবাধ্য, দুর্বিনীত পুত্রদের অন্যায়ের লাগাম টেনে ধরতেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রকে অযথা দোষারোপ করেও লাভ নেই। কারণ বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে মহাভারতের পূর্বের বা পরবর্তীকালের ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই আমরা বুঝতে পারব যে প্রতিক্ষেত্রেই একজন করে মানুষ নিমিত্ত থাকে। মহাভারতেও ধৃতরাষ্ট্র সেই নিমিত্ত মাত্র। আবার কুন্তির মনোগত বেদনা সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কুন্তি জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সানন্দিত চিত্তে বনবাস বেছে নিয়েছেন। আসলে জ্যেষ্ঠপুত্র কর্ণের মৃত্যুকে তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। জীবন যুদ্ধে নানা ধরনের জটিল সমস্যার সামনে তাকে দাঁড়াতে হয়েছিল। এইসব সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে কুন্তি নিজেকে নিঃস্ব, রিক্ত করে ফেলেন। জ্যেষ্ঠপুত্র কর্ণের জন্মরহস্য জনসমক্ষে প্রকাশ করতে না পারার জন্য তার মনের মধ্যে যে অন্তর্দাহণ হয়েছিল সেটা শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন।

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মনের অবস্থা সম্পর্কেও শ্রীকৃষ্ণ সম্পূর্ণ অবগত। ভারতবর্ষের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়া সত্ত্বেও যুধিষ্ঠিরের মনের মধ্যে শান্তি নেই। তিনি আজ মানসিকভাবে নিঃসঙ্গ। শুধু তাই নয় এই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের স্মৃতি তাকে মাঝে মাঝে নিদ্রাহীন করে দেয়। তবুও তিনি মনের সাথে লড়াই করে রাজদরবারে উপস্থিত হয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের দ্বারা অনেক সমস্যার সমাধান করেন। 

চোখ বন্ধ করলেই শ্রীকৃষ্ণের মনের মধ্যে একের পর এক ছবিগুলি ভেসে ওঠে। দ্রৌপদীর স্বর্গীয় ভালবাসা তাঁকে প্রতি মুহূর্তে মুগ্ধ করেছিল। হস্তিনাপুরবাসীরা তাঁকে দেবতার আসনে আসীন করেছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় দ্বারাবতী ছেড়ে হস্তিনাপুরে যেয়ে একবার সব কিছু নিজের চোখে দেখে আসবেন। কিন্তু এখন এক আশ্চর্য নির্লিপ্ততা কৃষ্ণের সমস্ত চরিত্রকে গ্রাস করেছে। আগের মত কোন কাজ করতে তাঁর আগ্রহ নেই। নিজের চরিত্রের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে কৃষ্ণ অবাক হয়ে যান। মাঝে মাঝে দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি ফেলে আসা অতীতের নানা স্মৃতিচারণ করেন। প্রথম শৈশব থেকেই কৈশোর পর্যন্ত বৃন্দাবনের দিনগুলি তার মনে যে আনন্দের অনুরণন জাগায় তা' আর কোনদিন ফিরে এল না। যৌবন থেকে বিভিন্ন যুদ্ধের স্মৃতি তার অন্তরকে দগ্ধ করে তোলে। কিন্তু এই যুদ্ধ না হলে পৃথিবী থেকে অধর্মের অপসারন হয়ে শান্তির বাতাবরণ ফিরে আসতো না। তিনি জানেন এই পৃথিবীতে তার আবির্ভাব 'যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত অভ্যুত্থান  অধর্মস্য তদান্তনম্ সৃজাম্যহম। পরিত্রানায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে’। অর্থাৎ পৃথিবীতে যখনই অধর্ম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তখনই যুগে যুগে ভগবান এই পৃথিবীতে শান্তির বাতাবরণ পরিয়ে দিতে আবির্ভূত হয়েছেন। কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ সংগঠিত না হলে অশুভ শক্তির সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটতো না। যুদ্ধ ছাড়া কখনও ধর্মরাজ্য স্থাপিত হতে পারত না। 

আবার মাঝে মাঝে দুর্যোধনের কথা মনে পড়ে যায়। দুর্যোধনের হঠকারিতা এবং ঔদ্ধত্যকে তিনি ক্ষমা করতে পারেননি। কিন্তু দুর্যোধনের জীবনের শেষ পরিণতি তাঁর মনকে বিষন্নতায় ভরিয়ে তুলেছিল। মধ্যমপাণ্ডব ভীমসেন অন্যায় ভাবে দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে যেভাবে তার উরুভঙ্গ করে হত্যা করেছিল সেই কথা চিন্তা করলে তাঁর মন বিষন্নতায় ভরে ওঠে। যে যাদব গোষ্ঠী সারা ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিশালী গোষ্ঠী হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল বর্তমানে সেই যাদব বংশ ক্রমশঃ অবলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। নানা দ্বিধা দ্বন্দ্বে তারা একের বিরুদ্ধে অপরে বিদ্বেষ নিয়ে চলেছেন। 
                                           পরবর্তী অংশ ৩৫তম পর্বে...............

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇