বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
৩৩ তম পর্ব
স্বয়ংবর সভার দিন প্রাতঃকালে রুক্মিণী দেবীমন্দিরে পুজো দিয়ে যে মুহূর্তে রাজ অন্তঃপুরের দিকে পা বাড়িয়েছেন সেই সময়ে অতর্কিতে শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম চার অশ্ববাহিত গরুড়ধ্বজ রথে রুক্মিণীকে তুলে নিলেন। এই দৃশ্য দেখে সমবেত রাজন্যবর্গ তাদের সৈন্যবাহিনী নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের পশ্চাৎদ্ধাবন হলেন। শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম তাঁদের রণনৈপুণ্যে সকলকে পরাজিত করে এগিয়ে চললেন। এমন সময়ে রাজপুত্র রুক্মি তার সেনাবাহিনী নিয়ে পথিমধ্যে নর্মদা তীরে ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ একাকী রুক্মিকে পরাজিত করে যখন তাকে বধ করতে যাচ্ছিলেন সেই সময়ে রুক্মিনী শ্রীকৃষ্ণকে অনুনয় করে বললেন "প্রভু, ভ্রাতৃহত্যার দায়ে আমি কলঙ্কিত হতে চাই না। আপনি আমার দাদা রুক্মিকে ক্ষমা করুন"। রুক্মিণীর অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিকে ক্ষমা করে ছেড়ে দিলেন। কিন্তু রুক্মি এক ভীষণ প্রতিজ্ঞায় নিজেকে আবদ্ধ করলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যতদিন পর্যন্ত না তিনি রুক্মিনীকে উদ্ধার করতে পারছেন ততদিন তিনি কুন্দিনাপুরীতে প্রত্যাবর্তন করবেন না। ভাগ্যের পরিহাসে রুক্মি কোনদিনই রুক্মিণীকে উদ্ধার করতে পারেননি এবং শেষ পর্যন্ত এই অপমানের জ্বালা তাকে সারা জীবন বহন করতে হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীকে নিয়ে দ্বারকায় প্রত্যাবর্তন করে তাঁকে বিবাহ করে পাটরানীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। কিন্তু রুক্মিণী পাটরানীর মর্যাদা পেলে কি হবে শ্রীকৃষ্ণের অন্তরের ভালোবাসা হয়তো কোনদিন পাননি। কারণ এরপরে শ্রীকৃষ্ণ আরো আটজন নারীকে এবং পরবর্তীকালে মা বসুন্ধরার পুত্র নরকাসুরের প্রাসাদে বন্দিনী ষোল হাজার নারীকে বিবাহ করে তাঁদের নারীত্বের মর্যাদা দিয়েছিলেন। অবশ্য শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীকে কোনদিন অবহেলা করেননি কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে পরবর্তীকালে দুর্বাসা মুণির অভিশাপে রুক্মিনীর সাথে শ্রীকৃষ্ণের একত্রে বসবাস করা সম্ভব হয়নি। শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণী, সত্যভামা এবং জাম্ববতীকে বিবাহ করার পরে নগ্নজিতা, মিত্রবিন্দা, সুশীলা, লক্ষণা, রোহিনী ও কালিন্দীকে বিবাহ করেছিলেন। এছাড়াও বিষ্ণুপুরাণের চতুর্থ অংশে উল্লেখ আছে প্রাগজ্যোতিষপুরে বসুন্ধরার দুর্বিনীত পুত্র নরকাসুরকে বধ করে তার কাছে বন্দী ষোল হাজার নারীকে উদ্ধার করে সত্যভামার উদ্যোগে তাদের নারীত্বের মর্যাদা স্বরূপ তাদেরকেও বিবাহ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ বিলক্ষণ জানতেন যে ষোল হাজার নারীকে তাঁর বিবাহ সমাজ স্বাভাবিক চোখে দেখবে না। এমনিতেই কৃষ্ণের ব্রজগোপীসঙ্গ কারো কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সহস্র সহস্র নারীকে মহিষী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তাঁর চারিত্রিক সচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু অসহায় নারীদের আশ্রয়দান তাঁর কাছে প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হয়ে ওঠে। এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ প্রকৃতই এক সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা পালন করেছিলেন।
🍂
আমরা ফিরে আসছি ধর্ম সংস্থাপনার জন্য অধর্মকে পৃথিবী থেকে দূর করার জন্য কৃষ্ণের পদক্ষেপ সম্বন্ধে আলোচনায়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে তাই তিনি অর্জুনকে বলেছিলেন " যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত/ অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনং সৃজাম্যহম্/ পরিত্রানায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্/ ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে"।। তাঁর মুখনিঃসৃত সেই বাণীসকল নিয়ে বেদব্যাস রচনা করেছিলেন সর্বকালের সেরা ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবত গীতা। যে গীতার বাণী আজ সমগ্র পৃথিবীকে শান্তির পথে চালিত করতে পারে।
মহাভারতে আমরা দেখতে পাই পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের রাজপ্রাসাদে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম। সেখানেই তাঁদের সাথে প্রথম দেখা পান্ডবদের সাথে। যদিও পঞ্চপান্ডবেরা তাঁর পিতৃষ্বসা কুন্তীর পুত্র ছিলেন তথাপি এ যাবৎকাল তাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ ঘটেনি অথবা বিভিন্ন কারণে যোগাযোগ সম্ভব ঘটে নি। অর্জুন লক্ষ্যভেদ করার পরে সমবেত রাজন্যবর্গের সঙ্গে তা'র বিবাদ শুরু হয়েছিল। সমবেত রাজারা আশা করেননি, একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ লক্ষ্যভেদ পূর্ণ করে, ক্ষত্রিয়ের অহঙ্কার চূর্ণ করে অসামান্য সুন্দরী কৃষ্ণাকে নিয়ে চলে যাবেন। তাই তারা নিজেদের অস্ত্র নিয়ে অর্জুনকে বাধা দিয়েছিলেন। ভীম সেই সময়ে অর্জুনের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ আদর্শ ধার্মিক। যা বিনা যুদ্ধে সম্পন্ন হবে তার জন্য তিনি কখনো যুদ্ধে প্রবৃত্ত হননি বা কাউকে যুদ্ধ করার জন্য উৎসাহিত করেননি। তিনি বিবদমান রাজাদের বলেছিলেন "এই ব্রাহ্মণ ধর্মতঃ রাজকুমারীকে লাভ করেছেন, সুতরাং অযথা আপনার যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছেন"। শ্রীকৃষ্ণ এমন একজন পুরুষ ছিলেন যার মুখনিঃসৃত বাক্য সমবেত রাজন্যবর্গ চিন্তা করে মেনে নিয়েছিলেন। এরপরে পঞ্চপান্ডব দ্রৌপদীকে নিয়ে মাতা কুন্তীর কাছে যখন গেলেন তখন শ্রীকৃষ্ণ বলরাম তাদের সমভিব্যাহারে সেখানে পৌঁছেছিলেন এবং কুন্তীর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তখনো পর্যন্ত পঞ্চপান্ডব দূর্যোধনের ভয়ে বনবাসী এবং অপরের আশ্রিত, তাই তাদের জন্য তিনি যৌতুকস্বরূপ মনি মুক্তা, রত্ন, পোশাক পরিচ্ছদ, শয্যাদ্রব্য ইত্যাদি অসংখ্য জিনিস তাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। সংসার করার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তাদের কাছে ছিল না। এইভাবে তিনি যে দরিদ্র, হীন অবস্থাপন্ন আত্মীয়দের অনুসন্ধান করে নিজের সময় ও কার্যের ক্ষতি করে তাদের উপকার করলেন এর দ্বারা তাঁর আদর্শ চরিত্রের এবং কুটুম্ব প্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। এইভাবে পান্ডবদের সাথে তার যোগাযোগের সূত্রপাত।
পরবর্তীকালে দ্বারকা থেকে অর্জুন সুভদ্রাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণের সম্মতিতে। সুভদ্রা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের শক্তি। নর ও নারায়ন ঋষিদ্বয় ভগবান কৃষ্ণ এবং অর্জুন হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পীত শক্তিরূপিনী সুভদ্রাকে তাঁরই অর্ধ অঙ্গ হিসেবে অর্জুনের হস্তে সমর্পন করেছিলেন। কিন্তু বলরাম চেয়েছিলেন সুভদ্রার সাথে দুর্যোধনের বিবাহ দিতে। কৃষ্ণের সম্মতিতে সুভদ্রাকে হরণ করে অর্জুন যখন বিবাহ করলেন তখন বলরাম ক্রুদ্ধ হয়ে কৃষ্ণকে প্রশ্ন করেছিলেন " আমার মনে হয় তুমি অর্জুনের সাথে সুভদ্রার বিবাহ দিয়ে সঠিক কাজ করলে না। রাজা দুর্যোধনের সাথে সুভদ্রার বিবাহ হলে তো সে রাজরানী হত"। শ্রী কৃষ্ণ তখন বলরামকে এই বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন "অর্জুন যদি আগে দেহত্যাগ করে তাহলে আমরা দুজনে মিলে সুভদ্রাকে পালন করব"। পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পাই শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রতিশ্রুতিমত পরবর্তীরূপে কলিযুগের জগন্নাথ মূর্তিতে জগন্নাথ ও বলরামের মধ্যস্থলেই সুভদ্রার অবস্থিতি।
এর পরবর্তীকালে অর্জুনের খান্ডববন দাহন করে অগ্নিদেবের তৃপ্তি সাধন, যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের প্রাক্কালে তাঁর সদর্থক বিচরণ আমরা দেখেছি। পান্ডবদের প্রভূত ধনসম্পত্তি ও রাজ ঐশ্বর্য দেখে শকুনির পরামর্শে দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেই পাশা খেলায় সর্বস্ব হারিয়ে এমনকি প্রানাধিক ভার্যা দ্রৌপদীকে হারিয়েছিলেন যুধিষ্ঠির। প্রকাশ্য রাজসভার মাঝে যখন দুর্যোধন, দুঃশাসন প্রমুখ দ্রৌপদীকে নারীত্বের চরম লাঞ্ছনা করেছিলেন তখন ভীমসেন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যুদ্ধে দুর্যোধনের উরুভঙ্গ করবেন এবং দূঃশাসনের রক্তপান করবেন। দ্রৌপদীর প্রতিজ্ঞা ছিল দুঃশাসনের রক্ত দিয়ে তিনি নিজের কবরী পুনরায় বন্ধন করবেন। পরবর্তীতে ধৃতরাষ্ট্রের সম্মতিতে পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদী দুর্যোধনের দাসত্ব থেকে মুক্ত হন। পুনরায় পাশা খেলায় হেরে যেয়ে পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদী দ্বাদশ বৎসর বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাসের শাস্তি মেনে নিয়েছিলেন। এত করেও ফিরে আসার পরে তাদের রাজ্যপাট দুর্যোধন ফিরিয়ে দিলেন না। ফলস্বরূপ কৌরব পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধের সূচনা ঘটল। উভয়ের মধ্যে যখন সম্মুখ সমর আসন্ন তখন উভয় পক্ষের আত্মীয় স্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ দৌত্যকার্য করে দুর্যোধনকে বলেছিলেন পান্ডবদের পাঁচটি গ্রাম দেওয়ার কথা। সে কথাতেও দুর্যোধন মান্যতা দেয়নি। শ্রীকৃষ্ণ উভয়েরই আত্মীয়স্বরূপ দৌত্যকার্য করেছিলেন যাতে উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব বজায় থাকে। কারণ তিনি সর্বদা যুদ্ধের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু অযথা যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হলে তিনি সেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে দুর্জনের বিনাশ ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এই দৌত্যকার্য দুর্বুদ্ধি দূর্যোধন মেনে নেননি। অনিবার্যভাবে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ উপস্থিত হয়েছিল।
পরবর্তী অংশ ৩৪তম পর্বে...............
0 Comments