পর্ব -৬
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া
ঝাউবন... ক্যাসুরিনা...রাত মরুভূমি…
খেলি চলনা ছোড়দামণি,উঁহু,কাজ করছি। রোববার দুপুরবেলা ভয়ানক ব্যস্ত ছোড়দা ঘাড় গুঁজে উত্তর দিল।ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি মারলো ঝিনি। পুরোনো একটা খাতায় ডাক টিকিট সাঁটার মতো করে ক্রিকেটারদের ছবি কেটে আঠা দিয়ে লাগাচ্ছে ছোড়দা। খবরের কাগজ থেকে ছবিগুলো কাটে ওরা।স্কুল থেকে যে আগে এসে কাগজ হাতে নেবে সেদিনকার ছবি সব তার। এই নিয়ে মারামারি বেশি হয় বলে হেম এই নিয়ম করে দিয়েছে।সেজোমাসি মার সঙ্গেই স্কুলে পড়াতে যায়।মা হেম বলে আর বাপি তাকে সেজো বলে ডাকে। তাই মাসিকে ইচ্ছে মতো ঝিনিও হেম বা সেজো বলে।
ছবি নেওয়ার জন্য ছুটির পর বইয়ের বাক্স হাতে প্রায়ই রেস দেয় দাদারা। দিনকে দিন খেলোয়াড়দের এই ছবি কাটাকাটি নিয়ে দুই ভাইয়ের দাঙ্গা হাঙ্গামা বেড়েই যাচ্ছে দেখে হেম কিছুদিন হলো দিন ঠিক করে দিয়েছে।সোম বুধ শুক্কুর অরু নেবে আর মঙ্গল বেস্পতি শনি মিতু ছবি কাটবে। রোববারটা বাই রোটেশন এক একজনের।ঝামেলা তাও মেটেনি। কারণ আদ্দেক দিন মিতু আগে এসে ছবি কেটে লুকিয়ে ফেলে।
দ্যাখো দিকি পড়াই হলো না কাগজটা কেটেকুটে এর মধ্যেই কী করে রেখেছে শয়তানদুটো।মার গলা পাওয়া গেল মাঝের ঘর থেকে। এসব জরুরি কাজের সময় মার হাতের চড়থাপ্পড় খুবই অসুবিধে করে। সব সরঞ্জাম নিয়ে ছোড়দা চুপচাপ মেঝেতে গুড়ি মেরে খাটের কোনার দিকে সেঁধিয়ে গেল ।
ছবি কাটলি যে,আজ তো আমার নেওয়ার কথা! পেছন থেকে চাপা হুঙ্কার দিয়ে ছোড়দার ঘাড়ে এসে লাফ দিল দাদামনি। এমনিতে সে শান্ত ভালো মানুষ গোছের হলেও রেগে গেলে ছোড়দার সাথে মারামারিতে কম কিছু যায় না। পরপর তিন দিন সে ছবিও পায়নি। মা বাড়ি আছে বলে গোলমালে শব্দ যতটা কম করা যায় সেটাও খেয়াল রাখতে হচ্ছে তাদের।দুজনে তাই লড়ছে আর চাপা গলায় ঝগড়া করছে।জড়ামড়ি করে দুজন লাউ গড়গড়ির মতো মেঝেয় গড়িয়ে গেল খানিক। ঝটপট করে একে অন্যের পেটে চেপে বসল কতক বার। নাকই ফাটাবো গরগর করে উঠল একজন।ইঃ! কান ছিঁড়ে দেব তা'লে!এবার ধুপধাপ ঘুঁষোঘুঁষিও শুরু হলে ভয় পেয়ে ঝিনি ও মা,ও সেজো দ্যাখো না ওরা কী করছে।হযবরল -র উদোর মতো ঘ্যানঘেনে ঝিনি নাকি সুরের পোঁ ধরতেই হেম এল হন্তদন্ত হয়ে।মা আসার আগেই সে ছাড়িয়ে দিল দুজনকে। তখনও ফোঁস ফোঁস করছে তারা। দুজনকেই বেশ মোলায়েম করে কান পেঁচিয়ে ছেড়ে দিল হেম।
রোজ রোজ এই অশান্তির মানেটা কী? হেমও মা'র কান বাঁচিয়ে চাপা গলায় ধমক দিল।ফের তোরা পড়ার আগে কাগজ কেটেছিস?আবার মারপিট করছিস জানলে তো এক্ষুনি দিদির হাতে পাখার বাটের বাড়ি খাবি। বারে!আজ তো আমি ধরতেই পাইনি কাগজটা। কালও মিতু ছবি কেটেছে আগে;কানে হাত বুলিয়ে দাদামনি রীতিমতো ক্ষুদ্ধ।এই মিতুটাই যত নষ্টের গোড়া।তোর খাতা চার দিনের জন্য বাজেয়াপ্ত হলো বলে হেম তার ছবি সাঁটার খাতা নিয়ে চলে গেল।
🍂
নষ্টের গোড়া মানে কী রে? বিচার পেয়ে শরিফ মেজাজে খিকখিক করে হেসে উঠল দাদামনি আর ছোড়দা ধাঁই করে কিল বসিয়ে দিল ঝিনির পিঠে। রেগে ঝিনি চেঁচালো তুই একটা নষ্টের গোড়া। ক্ষতিকারক! ক্ষতিকারক! এটা আবার কোন ধরণের গাল আমদানি হলো ? দুই দাদাই ভুরু কুঁচকে বলল কোত্থেকে পেলি এটা। আমি জানি।মা সেদিন দাদামনিকে পড়াচ্ছিল আমি শুনেছি হারামি মানে ক্ষতিকারক! তাই না দানি? উত্তেজিত ঝিনি হাত নেড়ে দাদামণিকেই সাক্ষী মানে।
রুবিদির মাইনে সব নিয়ে গেলেই সে তার মাকে বলে হারামি অথচ তার মানে জিজ্ঞেস করে করে ঝিনি হয়রান।কেউই বলে না। নাকি এমন শব্দের মানে বড়রা কেউ জানেই না অথচ সেদিন সন্ধেবেলা মাকে দাদামণি জিজ্ঞেস করল যখন মা তাকে মানে বলে দিল। সেই ইস্তক ঝিনি মুখস্থ করেছে হারামি শব্দের মানে।
ওহোওওও !দানি চোখ বড়বড় করে ব্যাপারটা শুনছিল এতক্ষণ। এবার বিকট হাসতে শুরু করে। আরে গাধা শব্দটা ছিল হার্মফুল।তার মানে মা ক্ষতিকারক বলেছিল।দুজনেই তাকে ঘিরে হইহই করে এতো হাসে যে ভয়ানক রেগে সে বলে আমি খুব অপমান হচ্ছি।কী হচ্ছিস? অপমান!অপমান! আরো জোরদার হয় ওদের হাসি আর ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে সে।
তাকে কাঁদাতে পেরেই আপাতত দাদারা নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে নেয় তবু কাগজে ছাপা খেলোয়াড়দের ছবি জমানোর মারাত্মক নেশা তাদের।পরদিনই স্কুল থেকে ফিরে দড়াম করে দরজা দিল ছোড়দা। দরজা দিলি কেন রে?স্লেটে সে 'দ' গেল শ্বশুরবাড়ি বসতে দিল পিঁড়ে বলে ফেচো পাখি আঁকছিল।খিল দিলি কেন?কী করবি ছোড়দামনি? চুপ চুপ,অরু আসছে, তার চাইতে বছর দেড়েকের বড় দাদাকে ছোড়দা বরাবরই নাম ধরে ডাকে। দাদামনি আসলে কী হবে রে?চুপ কর না ঘ্যানঘেনেটা।ঘ্যানঘেনে বললি কেন তুই? এক্ষুণি বলে দেব আজকের কাগজ লুকোলি তোষকের তলায়। হঠাৎ জানলা দিয়ে একটা সরু কঞ্চি ঢুকে এল ঘরে। কাগজ নিয়ে দরজা বন্ধ করে পার পাবি না আজ। দাদামনির মুণ্ডু ভেসে উঠল জানলায় এবার।রোদে আর রাগে অল্প লাল হয়ে আছে মুখটা।মাঝে মাঝেই হুংকার ছাড়ছে।বেরো বেরো বলছি নয়তো পেট ফুটো করে দেব কঞ্চি দিয়ে।ঝিনিও ছোড়দার সাথে বিছানার উল্টো দিক সরে গেল। মজা পেয়ে ফিকফিক করে সে হাসছিল ছোড়দার সাথে। অনেক খোঁচাখুঁচি করেও নাগাল পেল না কঞ্চি।রাগমাগ করে বাইরে থেকে বড় ঘরের দরজায় শেকল তুলে দিয়ে ওবেলার তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে খেলতে চলে গেল।
রুবিদিকে ডাকাডাকি করে ছোড়দা দরজা খোলালো।জল দেওয়া ভাত খেয়ে সেও বেরোলো ক্রিকেট ব্যাট হাতে।
কেমন আউট দিলাম কান্তিদাকে বল।লোপ্পা বল ছিল পুরো। তুই তো ফাস্ট বোলার।আর বল কিন্তু তোর ভালো ঘুরছে ইদানিং।রোববার ম্যাচ আমাদের।বল নতুন হলে দেখিয়ে দেব সুইং বল কাকে বলে।পিচটা আর একটু জুতের হতো তো দেখতিস,সন্ধে নামার মুখে দুইভাই হাসতে হাসতে মাঠ থেকে ফিরল। বিকেলের ঝামেলার লেশ নেই কোনো।
মন্টু বিড়ির মুখটা দ্যাখ অবিকল হ য ব র লর ন্যাড়া লাগছে না?"ন্যাড়া ওল বেগুন তোল/কই মাছ দে লাগাও ঝোল "দুজনেই তাকে নিয়ে পড়ল।তার বা রুবিদির পেছনে লাগার সময় দু'ভাইয়ের বড্ডই মিলমিশ। ঝগড়া মারামারির পর ভাব হলেই দুজনে এ ব্যাপারে আরও একজোট হয়ে ওঠে।
চুল ঘন হবে এই মর্মে তার ঘোরতর আপত্তি বা কান্নাকাটি না মেনে প্রায় প্রায় মা ঝিনিকে ন্যাড়া করে দেয়। কোনও এক রোববার দেখে দেখে মা হাঁক ছাড়ে অরু বাজারে গিয়ে গুপিকে খবর দিয়ে আসিস।দাদামনি লাফাতে লাফাতে গিয়ে বলে আসে।সেলুন বন্ধ করে বাড়ি ফেরার পথে গুপিদাও এসে বেশ করে চেঁছে দিয়ে যায় তার মাথা। মা অবশ্য তার হাতে একখানা মাছ লজেন্স বা পুঁতির মালা কিনে দেয় গুপির ক্ষু্রের তলায় ধৈর্য্য ধরে মুণ্ড পেতে দেওয়ার জন্য।চান টান করে ন্যাড়া মাথায় সবুজ পুঁতির মালা পরে গম্ভীর মুখে মাছ লজেন্স খায় সে কিন্তু দাদারা কথায় কথায় ন্যাড়া মাথা টাকটুক বলে তার মাথায় তবলার বোল তুলতে এলেই তুলকালাম বাঁধে। বাবা বাড়ি থাকলে তাকে কাঁধে বসিয়ে নেয় আর বলে মন মনিয়া ঝিন ঝিনিয়া তুমি তো আমাদের লক্ষী ঠাকরুণ কিন্তু এত চ্যাঁ ভ্যাঁ করলে যে নাকের জলে চোখের জলে হয়ে পেঁচা ঠাকরুণ হয়ে যাবে। দাদারা বাপি আর তাকে ঘিরে হাততালি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে 'পাপুর ছবি সঙ্গে ছড়া' বই থেকে হেঁকে বলে "আরে চিনি চিনি চিনি/ইনি আহ্লাদিনী/বাবা ডাকেন ঝিনি সোনা/মা হেসে কয় ভেলকি/মাথায় তোমার তিন চক্কোর/নেড়ি কুত্তোর টোল কি/হাপুস হুপুস কাঁদছ কেন?/আ্যনুয়েলে ফেল কি?"শুনে বাপির কাঁধে অধিষ্ঠিত হয়েও দ্বিগুণ চ্যাঁ ভ্যাঁ শুরু হলো দেখে বাবা তাকে কাঁধে করেই দারুণ ভুলভাল সুরে হা রে রে রে রে রে আমায় ছেড়ে দে রে দে রে গানটা ধরে দেয়। সেই মহা ক্যাওম্যাও শুনে মা,হেম রুবিদি যে যার কাজ ফেলে ছুটে আসে আর পারিবারিক মহা সম্মেলনে সবাই হাসে এমনকি ধমক খেয়ে দাদারাও,কান্না ভুলে ঝিনিও।
অথচ ক্লাস টেনে সমুদ্র দেখতে গিয়ে খোলা চুলে দাঁড়াতেই মা বলল নামিস না এই বিকেলে শুকোবে না লম্বা চুল তোর তবু হাসতে হাসতে প্রবল বিস্ফারিত সেই পাথারের সামনে ছেলেখেলা ভেবে স্নানে নেমে সেবার আচমকাই ঢেউয়ের পেটের মধ্যে ঢুকে গেল সে যেই,পায়ের নীচে মাটি সরে গেল পলকে, হাত দিয়ে নোনা জল খাবলে খাবলে মরেইতো যেত যদি না আর একখানা ঢেউ তাকে আছড়ে ফেলতো সৈকতে। এতক্ষণ আওয়াজ হচ্ছিল যেন এতদিন ধরে শোনা সব শব্দ একসাথে ঝনঝন করছিল তার ভেতর আর নীল রোদে ভেজা আকাশের তলায়,জমাট বালির ওপর উঠে এল ঝিনি অন্য এক মানুষ হয়ে।বারণ করলাম নামিসনে তবু চান করলি অবেলায় এখন এই সন্ধেবেলা শ্যাম্পু করে ঠান্ডা লাগাবি।কী বকুনিটাই দিচ্ছিলো মা। কিচ্ছু হবে না। অনিয়ম না করলে আবার বেড়ানো কিসের? ঝিনুকের মালা হাতে বাপি হাসছিল।মার বকাঝকা,বাপির অভয় সব কিছুর মধ্যে সে বোবা হয়ে গেছিলো।
তার ভেতরের সব হইচই ভারি এক পাথরখন্ডের মতো তারই সঙ্গে ডুবে গেছিলো বলেই সে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল।
শির ওঠা খরখরে পাতা ঝরিয়ে রোগা সময় যেভাবে চুপ করে দাঁড়ায়। নিস্তব্ধ ভাটির গোণে একটা একটা করে ঘাটলার সিঁড়ি উঠে আসে জল থেকে যেভাবে।তেমন এক স্তব্ধতা হাঁ করে তার পুরোটা গিলে খেয়েছিল।
সেই থেকে প্রায় প্রায় সে স্বপ্ন দেখে হলুদ বালির পাড় ধরে একলা দৌড়োচ্ছে।সার সার শাঁখ আর ঝিনুকের পসরা ছাড়িয়ে বাদামি ঘোড়ায় চড়ে পালিয়ে যাচ্ছে প্রিয় সময়। পিঠে শঙ্কর মাছের চাবুক আছড়ানোর দাগ।কেশরেও শাদা ফেনা লেগে আছে।কালচে রক্তের ঢঙে লম্বা ঝুলের ফ্রকে কফির দাগ লেগে গেছে যেন। দুহাতে ঘসে ঘসে সেসব দুঃখদাগ ঝিনি তুলে ফেলতে চায় ভাবে হাওয়া এসে ধুয়ে দিক জামা।আঙুলে চটচট করে অন্য মনস্ক নীল মধু।
কোচড়ে কুড়িয়ে তোলা ঝিনুক ছিটিয়ে পড়েছে কবেই। ভাঙা ঝিনুকের মন বিঁধে গেছে খালি পায়ে। পেছন ফিরলেই দেখা যাবে ঢেউয়ের মুকুটে উঠে দাঁড়াচ্ছে স্বজন বন্ধুদের মুখ।
যেভাবে মাইল মাইল চরাচরে নিঃশব্দে জেগে ওঠে সন্নেসী কাঁকড়ার দল। অথচ ফিরে দেখার উপায় নেই।তাকালেই ভেঙে যাবে ফ্যামিলি আ্যলবাম। স্বপ্নদৃশ্যে ধু ধু করে রাত্তির যেন প্রাচীন আঁধার থেকে উড়ে এলো মহাজাগতিক কোনো ডানা।রাতের গ্লাস সে উঁচু করে ধরে আরও।বরফ দানা হয়ে খসে পড়ে তারা কুচি।টুকরো আইস কিউবের মতো গ্লাসে ভাসে বিচ্ছিন্ন সব দিন মাস বছর।
রুপোর বাসন আকাশে ভেসে উঠলে মনে পড়ে আর জন্মের কথা।ভেজা নাক ঘসে ও মাটি কামড়ায়। চাঁদে মুখ রেখে কেঁদে ফেলে নির্জন কুকুর! তাকে সুদ্ধু ডুব দেয় অন্ধকার সমুদ্র। নীল তিমির কঙ্কাল কাঁধে জেগে ওঠে ঝাউবন... ক্যাসুরিনা...রাত মরুভূমি…
0 Comments