পর্ব- ১৫
স্বপন কুমার দে
পরদিন সকালে টিউশন পড়াতে গিয়ে তাদের বাড়িতে আর বলতে হল না। আজ মাসের ছ' তারিখ হয়ে গেছে বলে নিজেরাই গত মাসের বেতন দিয়ে দিল।
টিউশন পড়ানো হলে ওষুধের দোকানে ঢুকল মল্লিকা। ওষুধপত্র কিনে বাড়িতে পৌঁছে দেখল, গায়ে ঢাকা দিয়ে বাবা শুয়ে আছে। কপালে হাত দিয়ে বোঝা গেল, গায়ে বেশ জ্বর আছে। মল্লিকার চোখে মুখে উদ্বেগের ছায়া," এতো খুব জ্বর রয়েছে। বাবা, তুমি কিছু খেয়েছো?"
" মুখে যে কিছু রোচেনি মা।" মেয়ের দিকে করুণ চোখে চেয়ে রইল দিননাথ। চোখ দুটো ছল্ ছল্ করছিল। একটা টুল নিয়ে বাবার পাশটাতে বসল মল্লিকা। মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বলল," কিন্তু, ওষুধ খেতে গেলে সামান্য কিছু মুখে দিতে হবে তো বাবা। আমি বরং এক বাটি মুড়ি দিচ্ছি। খেয়ে নিয়ে ওষুধটা খেয়ে নাও দেখি। জ্বর না কমলে প্যারাসিটামল্ খেতে হবে।"
বাবার জন্য মুড়ি বাতাসা নিয়ে এসে মল্লিকা তাকে খাওয়াল, তারপর নিজেও খেল।
" তুই কখন ক্লাস করতে যাবি মা?"
" আজ আর যাবো না বাবা। তোমার এত জ্বর, তোমাকে একা রেখে আজ যাবো না।"
" না না, তুই যা। আমার কিছু হবে না।"
মল্লিকা যেতে চাইছিল না, তাকে প্রায় একরকম জোর করেই দিননাথ ইউনিভার্সিটি পাঠাল। তাও একটু দেরিতে মল্লিকা গেল। ফার্স্ট পিরিয়ডটা করতে পারেনি। তবে তাতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। অভিরূপ আছে, ক্লাসে কী হল জানতে পারবে।
ক্লাসে গিয়ে বাড়িতে মনটা পড়ে থাকে। বাবাকে একা বাড়িতে রেখে আসা উচিত হয়নি। বাবাই জোর করে পাঠিয়ে দিল, নইলে সে তো আসবে না বলেছিল। জানিনা, বাবা কী করছে? জ্বর ছাড়ল কিনা? জ্বর ছাড়লেও দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে ভাত বেড়ে খেতে পারল কিনা? এইসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়। অভি জিজ্ঞেস করে," তোর আজ কী হয়েছে রে? দেখছি, তুই যেন কী ভাবছিস।"
" হ্যাঁ, বাবার শরীরটা আজ খুব খারাপ, তাই চিন্তা হচ্ছে।"
" কেন, কী হয়েছে কাকুর?"
" আপাতত জ্বর হয়েছে। কিন্তু বাবা একটা জটিল রোগে ভুগছে। তোকে পরে বলবো।"
" আচ্ছা, ঠিক আছে।"
🍂
নিজের চোখের জল মুছল মল্লিকা।
" বাবা, আমাদের চাওয়া পাওয়া, আমাদের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি সবকিছু তো আমাদের আয়ত্বে নেই। তাই আমরা পেয়ে হারালাম। তুমি হারালে তোমার জীবনের পরম বন্ধুকে, আমি হারালাম জগতের আমার মর্ত্যের স্বর্গ, আমার মা।"
" আমার চেয়েও তোর কষ্টটা অনেক বেশিই মা। একজন সন্তানের কাছে সবচেয়ে বড় সম্পদ হল মাতৃস্নেহ। তার বেড়ে ওঠা, তার পরিচর্যা, শিক্ষা,সর্বোপরি তার ভালোবাসার যে জগৎ তার মূল শক্তি হল তার মা। আমি আর তোকে কতটুকুই বা দেখতে পারি বল্? এ আক্ষেপ কি আমার কম?"
" বাবা, তুমিই আমার সব। টাকা পয়সা না থাকলেও, আমি জানি তুমি তোমার সর্বাংশ দিয়ে আমাকে ভালোবাসো। "
এইভাবেই অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পর মল্লিকাকে উঠতে হয়, রান্নার জন্য।
মল্লিকা লক্ষ্য করেছে তাকে ঘিরে সহপাঠীদের মধ্যে থেকে হঠাৎ হঠাৎ বিদ্রূপ ভেসে আসে। তার সোসাইটি নিয়ে তির্যক কথাবার্তা হয়। মল্লিকা ওগুলোকে কোনো গুরুত্ব দেয় না। জানে, এক ধরনের ঈর্ষা থেকেই ওরা এরকম বলে। যেহেতু ওদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কোনও সম্পর্কই নেই, তাই অহেতুক ঝামেলায় না জড়িয়ে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
আবার উল্টো ঘটনাও ঘটে। অনেক অপরিচিত অযাচিত শুভাকাঙ্খী যেচে এসে সাহায্য করতে চায়। স্টুডেন্ট ইউনিয়নের কেউ কেউ নিজের থেকে বলে যায়," তোমার সাথে কেউ যদি খারাপ ব্যবহার করে তাহলে আমাদের বলবে।" মল্লিকা তাদের সঙ্গে হেসেই উত্তর দেয়, কিন্তু ভেতরে সতর্ক থাকে। সে এতদিনের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছে, বুদ্ধিবলে সবকিছু পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে।
অফিসের একজন মধ্যবয়সি ক্লার্ক, বছর বাহান্নর ব্যানার্জিবাবু তো একদিন এসে বললেন," আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, তুমি খুব গরিব পরিবার থেকে এসেছো। তোমার বাবা অসুস্থ। অনেক কষ্টে লেখাপড়া শিখছ। তোমাকে কিন্তু ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। আর ফিজ দিতে যদি কোনো অসুবিধা হয়, তাহলে আমাকে বলবে। লজ্জা করবে না কিন্তু। এই নাও আমার ফোন নাম্বার, আর তোমারটা দাও। আমি মাঝেমাঝেই তোমার পড়াশোনার খবর নেবো।"
মল্লিকা ভাবল, যাক, একজনকে অন্তত পাওয়া গেল-- সুবিধা অসুবিধায় পাশে পাওয়া যাবে। কোনো সেমিস্টারে ফিজ দিতে অসুবিধা থাকলে, ওনাকে বলে হয়তো কিছুদিন পরে দিলেও চলবে।
কিছুদিনের মধ্যে মল্লিকার অস্বস্তি বাড়তে লাগল। যখন তখন ফোন আসতে লাগল ব্যানার্জিবাবুর। টিউশন পড়াতে বসলে ফোন, রান্না করার সময় ফোন, রাস্তায় যেতে যেতে ফোন। ফোনে ফোনে জেরবার হয়ে যায় মল্লিকা। ফোনে অনেক জ্ঞান ট্যান দেয়," তোমাকে কিন্তু খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, পাঁচজনের একজন হতে হবে। হাল ছেড়ে দিলে চলবে না, আমি আছি তোমার পাশে ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রথম প্রথম এসব কথা হজম হচ্ছিল কিন্তু ক্রমশ ভালোবাসার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। ভাবতে লাগল, কী করা যায়। দরকার নেই উপকারের, ঘাড় থেকে নামলে বাঁচি। একদিন লোকটা বলল," ছুটির পর পার্কের সামনে চায়ের দোকানে এসো, একসঙ্গে চা খাওয়া যাবে।" ব্যাপারটা মল্লিকার ভালো লাগেনি।
মল্লিকা একদিন স্নান সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বাবার মুখ থেকে শুনল," তোদের ইউনিভার্সিটির কে একজন ব্যানার্জি স্যার ফোন করেছিলেন। আমার শরীরের খোঁজ নিচ্ছিলেন। বললেন, একদিন আমাকে দেখতে আসবেন। তুই নাকি বাড়ির সব কথা তাঁকে বলিস। তোকে এখন একবার ফোন করতে বলেছে।"
কথাগুলো শুনে গা জ্বালা করছিল মল্লিকার কিন্তু বাবাকে কিছু বলল না। আজ রবিবার, বাজার থেকে মাছ শাক সব্জি কিনে এনেছে মল্লিকা। তাই দিয়ে রান্না করতে বসল। বাবাকে যত্ন করে খাওয়াল,নিজে খেল। বিকেলে বাবা মেয়ে একটু দূরের মাঠটায় বেড়িয়ে এল। সন্ধ্যেবেলায় টিউশন পড়িয়ে বাড়ি ফিরল। সারাদিন তার আর কোনো ফোন আসেনি। মল্লিকা ভাবল, আজকের মত আপদ বিদায় হয়েছে।
রাত্রিবেলায় খাওয়া দাওয়া সেরে পড়তে বসেছে মল্লিকা। বাবা অন্য রুমে ঘুমাচ্ছে। এইসময় তাকে বেশিক্ষণ পড়াশোনা করতে হয়। এখন রাত বারোটা। আরও ঘন্টা দুয়েক সে স্টাডি করবে। এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল। এত রাতে কে ফোন করবে? কিছুটা কৌতুহলের সাথে ফোনটা নিয়ে দেখল,' ব্যানার্জিবাবু'! অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা রিসিভ করল মল্লিকা।
ওপ্রান্ত থেকে কথা ভেসে এল," কে মল্লিকা? এখনও ঘুমোও নি?"
" না, কী বলছেন বলুন। এত রাতে?"
" মল্লিকা, তোমাকে একটা কথা বলব বলব করেও বলতে পারিনি। তুমি যদি রাগ করো সেই জন্য।"
" এত রাতে কারও ওপর রাগ দেখাবার জন্য আমি বসে নেই। যা বলতে চান চটপট বলুন।" ভেতরে ভেতরে ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে তবু যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে কথাগুলো বলল মল্লিকা।
বেহায়ার মত ভঙ্গিতে ব্যানার্জি বলে চলল," তুমি যদি অভয় দাও তো বলতে পারি।"
খুব গম্ভীর গলায় মল্লিকা বলে," হ্যাঁ বলুন।"
অপর প্রান্তের লোকটা উৎসাহিত হয়ে বলল," আমি জানি, তুমি আমাকে না করতে পারবে না। মল্লিকা, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো নয়। আমি তোমার সঙ্গ চাই মল্লিকা।"
আর বেশি বলতে হল না। আগুনে ঘি পড়লে যেমন দপ্ করে জ্বলে ওঠে, তারপর দাউ দাউ করে সব পুড়িয়ে দেয়, তেমনই জ্বলে উঠল মল্লিকা।এতদিন কোমল, নম্র স্বভাবের যে মল্লিকাকে লোকে চিনত,সেই হঠাৎ ক্রুদ্ধা সাপিনীর মত ভয়ংকর চিৎকারে বলে উঠল, " লজ্জা করে না আপনার? নিজের মেয়ের বয়সী একজন মেয়েকে আপনি প্রেম প্রস্তাব দিচ্ছেন? আমি আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম, আর আপনি তার সুযোগ নিচ্ছেন? আপনাকে আমার কোনও উপকার করতে হবে না। আর যদি বাড়াবাড়ি করেন তাহলে ঠিক জায়গাতেই আপনার ব্যবস্থা করবো।" এই বলে ফোন কেটে দিয়েছিল মল্লিকা।
" কী হয়েছে রে মা? এত রাতে ?"
মল্লিকা রাগে হাপাচ্ছিল। বাবার দিকে একবার চেয়েই মুখটা নামিয়ে নিন। রাগে, লজ্জায় , অপমানে তখন স্বাভাবিক কথা বলার অবস্থায় ছিল না। বাবা এক গ্লাস জল নিয়ে তার হাতে দিল। বুঝতে পারল মেয়ের মনের অবস্থা।আরও বেশি চিন্তিত হল দিননাথ। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
" বাবার বয়সি একটা লোক.." কথাটা শেষ করতে পারল না, গলায় আটকে গেল।
দিননাথ বুঝতে পারল, সকালের ব্যানার্জিবাবু ঘটনার মূলে। রাগ হল সমাজের প্রতি, সমাজের লোভী ধূর্ত অমানুষগুলোর উপর। প্রকাশ্যে কিছু বলল না। শুধুমাত্র বলল, " এইবার ঘুমিয়ে পড় মা। অনেক রাত হয়েছে।"
" যাচ্ছি বাবা, তুমি যাও।"
" ওরকম অনেক বদ্ লোক তোর পিছু ধাওয়া করবে, তোর পথ আটকাবে। ওদের ভয়ে কখনও নিজেকে লড়াই থেকে সরিয়ে নিবি না। আর ওদের কথা ভাববিও না। ঐসব কুকুরদের বুঝিয়ে দিবি, যেন ভুলেও তোর দিকে না তাকায়।" মল্লিকা দেখল, রাগে তার বাবার হাত পা কাঁপছিল। সে বাবাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে তার রুমে পাঠাল। বাবা নিজের রুমে গেল।
মল্লিকা ভাবল, প্রয়োজনে আরও কঠোর হতে হবে। আজকের এই ঝাঁঝটার দরকার ছিল। ভবিষ্যতে ওরা ভয় পাবে।
আর পড়ায় মন বসাতে পারল না। বইপত্র রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments