তনুশ্রী ভট্টাচার্য
রবীন্দ্রনাথ কি ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন? উত্তরটি জানার জন্য গুগল সার্চ করতে হয় না। শুদ্ধ জীবনাচরণের অনুশীলনের মধ্যে বেড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিবেচক বিবেকবান প্রাজ্ঞ একজন ব্যক্তি। এবং এই ধরনের মানুষকেই আমরা বলি ধার্মিক। তাহলে ধার্মিকতার সঙ্গে ধর্মের কি সম্পর্ক? আর রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধে ধর্ম কথাটির অর্থই বা কি? নীতি-নিষ্ঠতা সত্যবাদিতা কর্তব্যে অবিচল থাকা প্রভৃতি মানবিক গুণাবলীর অনুশীলন করা ধর্মের সংজ্ঞা হতেই পারে।। ধর্ম ও রবীন্দ্রনাথ বিষয়টির কোন মামুলি ব্যাখ্যা হয় না। যে জীবন বোধ সুন্দরের আরাধনা করতে শেখায় যে অনুভূতি সুরের সাধনা করতে শেখায় যে উপলব্ধি মানবতার মঙ্গল করতে শেখায় যে চেতনা প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়াতে শেখায় যে প্রেম মানুষের মিলনের ঐকতান গেয়ে ওঠে যে ভালোবাসা বিশ্ব প্রেমের জয়ধ্বজা ওড়াতে চায়--- তাই রবীন্দ্রনাথের কাছে ধর্ম।
রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্মে বিশ্বাস করতেন। নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার শিক্ষা তিনি তার পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি। দেবতাত্মা হিমালয়ের পাদদেশে যখন মহর্ষি ধ্যানে বসতেন সেই ধ্যান গম্ভীর পরিবেশের স্বর্গীয় সুষমার অপরূপ মূর্চ্ছনায় বালক রবীন্দ্রনাথের হৃদয় ঈশ্বরমুখী হয়ে উঠতো।
সেই নির্জনতা বয়ে আনতো গভীর ঈশ্বর চেতনা। একেই কি বলব ধর্ম? ধর্মচারণা? তিনি আমাদের শিখিয়েছেন --- নিভৃতে নীরবে গোপনে সেই পরম পিতার মহিমা উপলব্ধি করার নামই ধর্ম। ঝাণ্ডা উড়িয়ে স্লোগান দিয়ে পেশির আস্ফালন করে, অস্ত্রের ঝনঝনানিতে চারিদিক ব্যস্ত করে তোলার উচ্চকিত রূপ কোন ধর্ম নয়। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন-- ধর্ম মানে বিনয় ধর্ম মানে নম্রতা ধর্ম মানে পরমত সহিষ্ণুতা ধর্ম মানে শুদ্ধ হৃদয়বেত্তা।
ব্রাহ্ম মুহূর্তে শয্যা ত্যাগ করে উদীয়মান রক্তিম সূর্যের স্তবধ্যান করে হৃদয়ের শক্তি ও শৌর্য সঞ্চয় করে সৃষ্টির সাগরে অবগাহন করার যে অভ্যাস তিনি
আয়ত্ত করেছিলেন তাই -ই-ধর্ম । তাঁর ধর্মের কোন নির্দিষ্ট অবয়ব নেই। সেই অনন্ত শক্তি আত্মস্থ করার প্রক্রিয়াই হল ধর্ম। যে ঈশ্বর সর্ব ব্যাপ্ত রবীন্দ্রনাথের শুদ্ধ হৃদয়ের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে তার দীপ্তিময় অবস্থান। সেখানে ধর্মের নামে কোন বর্ম লাগে না। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর মতোই তিনি প্রকৃতির মধ্যেই ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করতেন। পাহাড় থেকে পারাবার ,বায়ু থেকে বৃক্ষ-- সর্বত্রই তিনি ঈশ্বরের স্নেহময় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হতে চেয়েছেন। তাঁর লেখায় বারে বারে তা ধরা দিয়েছে। গীতাঞ্জলির ভাষ্যই তার ধর্ম।
🍂
ভারতবর্ষের মতো সুপ্রাচীন ঐতিহ্যশালী দেশে ধর্মের কোন একমাত্রিক ব্যাখ্যা হতে পারেনা । ধর্মের স্বরূপ এখানে বহুমাত্রিক । তাতে যেমন বৈচিত্র্য এসেছে তেমনি এসেছে ভেদাভেদ। এই ভেদাভেদ যখন বিদ্বেষে পরিণত হয় তখনই দেখা দেয় সংকট, সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব ।ধর্মের নামে সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দেওয়া মোটেই রবীন্দ্রনাথের পছন্দ ছিল না। যেখানে বৃহৎ ঈশ্বরত্ব থেকে ক্ষুদ্র আমিত্ব বড় হয় সেখানে ছিল কবিগুরুর প্রবল অনীহা। এ জন্য সেই সময় অনেকের সঙ্গেই তাঁর মতানৈক্য হয়েছে। কিন্তু তিনি ছিলেন স্থির প্রতিজ্ঞ। বৃহতের আরাধনাই ছিল কবির সাধনা ।সেটাই তাঁর কাছে ধর্ম। ধর্ম মানে বাহ্যিক আড়ম্বর নয় কোন পুতুল পুজো নয় কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের বেড়াজালে আটকে থাকা কূপমন্ডুকতা নয়। এ এক ধর্মীয় চেতনা, যা মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলবে দেশ কাল পাত্রের সীমারেখা মুছে দেবে আর বিশ্ব প্রেমের জয়গাথা লিখবে--- রবীন্দ্রনাথ তাকেই ধর্ম মানতেন।
0 Comments