জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা /পর্ব- ৪৩/গৌতম বাড়ই

চিত্র- মণিদীপা দাস 
সিংহপুরের  সুসীমা
পর্ব- ৪৩
গৌতম বাড়ই


সুসীমা এসে দাঁড়ালো সেই নিবিড় অন্ধকার রাতে মুখোমুখি তার সেই বিরাট পুরুষাকার, স্বপ্নপুরুষ। তার অন্তরের দেব, সেই তার কামালোক আর সেই তার আদি ও আদিম শক্তি। সুসীমা বুড়িয়ে যায়নি, জীবন নদীতে শৈবাল দাম জমে- জমে গতিপথ রূদ্ধ হয়ে এসেছিল। সেই নদী যেন গতিপথ আবার খুঁজে পেয়েছে, ও নদী তোমার এত উন্মাদনা এলো কোথা থেকে? ভরা শ্রাবণের ধারায় শত সহস্র শৈবাল দাম সরিয়ে দিয়ে সে আবার পাগলপারা, সে এগিয়ে চলেছে। তার গতিপথেই আলোর চেতনা, এক ভবিষ্যতের দিশা। সুসীমা যেন আবার জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় বেঁচে উঠেছে। এতদিন বাঁচা ছিল মৃত অথচ দুঃসহ বেঁচে থাকা জীবন, আজ রাতের অন্ধকারেও উজ্জীবিত প্রাণের আলোক লোক। দুটি বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় তার হাত দুটো ধরা দিল। সেই রাতের আঁধারে মিলিয়ে গেল তারা নক্ষত্রের আলোতে। চারিদিক নিশ্চুপ , অন্ধকারে বেজে উঠলো আলোর ফুলকি, তারাবাজির মতন সংগীত। মিলনের সংগীতের সুরতানে মুগ্ধ হল ছোটো রাজমহল। যে প্রতীক্ষা ছিল অবিকল অবিচল শত আশা নিয়ে বহুকাল, বহুকাল। 

তারপর, সাক্ষী রইলো মধ্যযাম আর তার আকাশে জ্বলজ্বলে নক্ষত্ররা। বাইরে শালবিথীর গভীর জঙ্গল এখন ঘুমন্ত। ঘুমন্ত বৃক্ষ সাক্ষী হতে পারে না। শিবালিকার দল দূরে দহের পারে কলরবে মত্ত। হয়ত কোনও শিকার এখন ভাগাভাগি করে ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। রাতের গভীরে সেনাপতি অনুর তার কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করলেন এবং  তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে এসে সুসীমাকে হাত পাততে বললেন। সুসীমা বুঝল সেনাপতি আগেই প্রস্তুতি নিয়েছিল। ঘরের ভেতরে বস্তুগুলি গুছিয়ে রেখেছিল একদম সুবিধাজনক স্থানে। সুসীমা এই সুদীপ্ত পুরুষের কাছে তার সবকিছু অর্পণ করে দিতে পারে। জানুপেতে চাইতে পারে, তার কথামতন  করপেতে গ্রহণ করা তো আরও সহজ। সুসীমা দুইহাতের করতল পেতে দিল। 

--- " এই তিনটি তীর রাজকন্যা তোমার কাছে অর্পণ করলাম। ধনুর বিদ্যায় সিংহবাহু অল্প সময়েই অসম্ভব পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। এই তিনটি তীর ভবিষ্যতে সিংহবাহুরই প্রাপ্য। এই তিন তীর, তাদের বিশেষত্ব হল,  প্রয়োজনে পৃথিবীকে রক্ষা করবে, রক্ষা করবে তোমাকে আর বঙ্গদেশকে। অতি প্রয়োজনীয় মুহূর্তে এর ব্যবহার করতে হবে। এই নাও....।" 

🍂

সেনাপতি অনুরের এইকথা  শেষ হতে না হতেই যেন আলোর দুন্দুভি বেজে উঠল । কার কন্ঠ! এ কার বাণী ঘোষিত হল রাতের ওই আলোর দুন্দুভিমাখা আকাশে। সেই মায়াবী আলোর স্পর্শে সুসীমা আর অনুরের মুখ স্পষ্ট হল। দুজন দুজনকে অপলক চোখে অবাক হয়ে দেখছে। বিস্ময় তাদের সারা শরীর জুড়ে। মূক ও স্থবির হয়ে আছেন তারা। 

-- " আমি তাতুলি। সুসীমা এই তিন তীর তোর তিন বংশের। দেব বংশের অর্থাৎ তোরা তো শৈব উপাসক, বঙ্গরাজের বংশের, মানে তোর পিতৃ বংশের  আর কলিঙ্গরাজ বংশ অর্থাৎ মাতুল বংশের। এর প্রথমটি ও দ্বিতীয়টি উত্তরাধিকার সূত্রে তোর পাওয়া, আর তৃতীয়টি মাতুল বংশের সূত্রে পাওয়া। বিপদের সময় তোদের রক্ষা করবে। অনুরকে দিয়েছে বঙ্গরাজ । তোর কাছে দেবার জন্য। খুব যত্নে তিনটি তীর রেখে দে। খুব শীঘ্রই এর প্রয়োজন হবে। আমি তোদের বিপদে আপদে সবসময় আছি মাথার ওপরে। " 

আলোর উজ্জ্বলতা ক্রমশ কমে গিয়ে নিষ্প্রভ হল। আবার অন্ধকারে ভরে উঠল গভীর কালো সেইরাত। সেনাপতি সুসীমাকে তার কক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়ে নিজে তার আপন কক্ষে ফিরলেন। 

পুরোটাই যেন এক স্বপ্নঘোর। সুসীমা নিজের অস্তিত্ব আর অবস্থান বুঝে নিতে চাইল, কিছুক্ষণ। বিমূঢ়, সেই রাত। মানুষের জীবনে এইরকম মুহূর্তে নিজেকে যেন এক ঘোরের মধ্যে চলে যেতে হয়, অথবা মহাজাগতিক কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে নিক্ষেপ করে সেই মহাক্ষণে। তবে বঙ্গেশ্বরের দুহিতা বুঝতে পারলেন সম্মুখে এক দূর্বার পরিবর্তন হতে চলেছে। এই রকম পরিবর্তন, এরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে দৃঢ় সংকল্প চিত্তে, এবং এক সুস্থির চিন্তায় মগ্ন থাকতে হয়। 

সুসীমা আজ সেই অদৃশ্য শক্তিতে কী পরম বলবান হয়ে উঠল মানসিকভাবে? বঙ্গরাজ্যের ইতিহাস কী স্থায়ী হয়ে রয়ে যাবে , অযোধ্যার বর্ণিত রাজা দশরথ বা মহাভারতের কৌরব- পান্ডবদের মতন? তবে এগিয়ে চলুন সিংহপুরের সুসীমার সাথে। 

ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments