জ্বলদর্চি

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন ও তাঁর দেশপ্রেম (প্রথম পর্ব)/তনুশ্রী ভট্টাচার্য


মহাকবি মাইকেল মধুসূদন ও  তাঁর দেশপ্রেম 
(প্রথম পর্ব)
তনুশ্রী ভট্টাচার্য

এক অপার বিস্ময়। প্রতিভার বিস্ফোরণ। প্রতিভার বিচ্ছুরণ। অধ্যবসায়ের  পরকাষ্ঠা তিনি । বাংলা সাহিত্যের এক কান্ডারী, মহীরুহু।প্লাবনসম বেগে মাত্র সাত বছরের সাহিত্য সৃষ্টির সংক্ষিপ্ত সময়কালে  বাংলা ভাষাকে নতুন করে গড়ে তুলেছেন। ভাষার জমিতে নবীন পলি জমিয়েছেন। সেই  উর্বরপলিতে  জন্ম নিয়েছে নতুন ভাষা- বৃক্ষ, শাখা, কিশলয় ফুল ফল। অমিত্রাক্ষর ছন্দ, চতুর্দশপদী কবিতাবলী, নাটক, প্রহসন  খন্ডকাব্য গীতিকবিতা বা লিরিক আর  মহাকাব্য। তাঁর লেখনি এক আলোকবর্তিকা। তিনি এক টর্চবিয়ারার। এক পাথফাইন্ডার। এক প্রিকার্সার অফ নিউ থট,নিউ আউটলুক অফ মডার্নিজম, নিউ এ্যাটিটিউড। বাংলা সাহিত্যের ভাষা  আঙ্গিক গঠন চিন্তা ভাবনা থট প্রসেসে আধুনিক  চিন্তনে, মননে ,তার ফর্মকে যিনি হাতে ধরে সাবালকত্বে পৌঁছে দিয়েছেন বাংলার  রেনেসাঁসের সেই বর পুত্র,সেই ভগীরথ কপোতাক্ষনদের তীরের  সাগরদাঁড়ি র দত্তকুলোদ্ভব শ্রী মধুসূদন দত্ত। তাঁর দ্বিশত জন্ম বৎসরের স্মরণে  একবিংশ শতকে ফিরে দেখা ,শ্রদ্ধা ও বিস্ময়াবিষ্ট  হওয়া।
ভারতচন্দ্র থেকে রামমোহন হয়ে বিদ্যাসাগরের পরেই  আবির্ভাব  শ্রী মধুসূদন দত্তের। তাঁর হিরন্ময় স্পর্শে বাংলা সাহিত্য ক্রমশ সম্পদশালী হয়ে উঠেছে-- গঠনে ভাষার ব্যবহারে চিন্তার অভিনবত্বে দৃষ্টিভঙ্গিতে।সংস্কৃতের উপনিবেশ থেকে মুক্ত করছেন বাংলা ভাষাকে। পয়ার থেকে মুক্তি দিচ্ছেন। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য থেকে প্রায় ১০০ বছর পরে আমরা পেয়েছি মেঘনাদবধ মহাকাব্য ।ইয়ংবেঙ্গলের অন্যতম বেঙ্গলী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে আধুনিকতার স্বর্ণস্পর্শ  দিচ্ছেন।

🍂

  বস্তুত দেশপ্রেম একটি চেতনা, একটি বোধ। মনে হয় নির্দিষ্ট এই শব্দবন্ধটি দেশপ্রেম-- কথাটির জন্ম গত শতকের বা তার আগের শতকের সম্ভবত শেষ দু দশক অর্থাৎ ১৮৮৫ জাতীয় কংগ্রেস এর গঠনকালের থেকে  দেশ বলতে কি বুঝায় তার সঙ্গে দেশপ্রেম কতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেই ধারণা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। দেশকে ভালোবাসি এই ঘোষণা করার সময় তখনো আসে নি। যখন থেকে  ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন উত্তাল হয়েছে, তখন থেকেই জাতীয়তা বোধ দেশপ্রেম স্বদেশ চেতনা স্বদেশ প্রীতি জন্মভূমি প্রীতি মাতৃভূমি অনুরাগ এই শব্দগুলো আমাদের তাড়িত করেছে । বস্তুত ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গ বা ১৯০৮ এর ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির পর থেকেই সাধারণ মানুষের কাছে দেশপ্রেমের ধারণাটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে ।  দেশ গৌরব বা দেশ ভক্তি দেশ চেতনা যাই বলি না কেন এক উদগ্র  ঝাঁঝ, এক তীব্র আবেগ একটা শিহরণ   আবার একটা লাবণ্যময় আকর্ষণ এই শব্দটির মধ্যে মিশে যায়। এর উৎপত্তির সময় কাল  থেকে দেশাত্মবোধক সংগীত কবিতা  উপন্যাসে এর বিস্তার ঘটেছে। সেই ১৯০০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বলা যেতে পারে যে সকল পরিকল্পনা করা হতো সে সাহিত্য কেন বাজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের  হিন্দু কেমেষ্ট্রী বই লেখা কেন,  সাবান কারখানা স্থাপন  কেন, জাতীয় শিক্ষাপরিষদ কেন----   সবই দেশপ্রেমের বীজ থেকেই উদ্ভূত। ইংরেজের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে যা আমাদের শক্তি যুগিয়েছিল সেই সময়ে তাই ছিল দেশপ্রেম। তবে এসবের আগে রামমোহন বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখায় আমরা সেভাবে দেশ বা দেশপ্রেম কথাটা পাইনি বরং পেয়েছি সমাজ গঠন, তার শ্রীবৃদ্ধি, চরিত্র গঠন, সমাজের কুসংস্কার দূরীকরণ এইগুলো। বিবেকানন্দের লেখাতেও দেশগঠনের, ভারতগঠনের কথাই বারবার বলা হয়েছে।দেশহিতৈষী কথাটি বরং চালু কথা হচ্ছে সেই সময়ে। দেশপ্রেমের ধারণা তখনো তেমনভাবে দানা বাঁধে নি।বঙ্কিমচন্দ্রও লিখেছেন দেশের শ্রীবৃদ্ধি প্রবন্ধ।আনন্দমঠ উপন্যাসেই  প্রথম দেশ এবং দেশপ্রেমের একটি ধারণা সুস্পষ্ট পাওয়া গেছিল। সেটি ১৮৮৬ সাল। ১৮৮৫ তে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময় টি স্মরণে রাখতে হবে।১৯০০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত যে দেশপ্রেমের ধারণা আমরা মনের মধ্যে লালন করি, ইতিহাস যেমনটা বলে, আজকের দেশপ্রেম কিন্তু অনেকটাই আলাদা এটা আমরা স্বীকার করি বা না করি। তবে আজ এই ২০২৪ এ শ্রীমধুসূদন দত্তের জন্মের ২০০ বছর পরে আমরা সামান্য আলোচনা করব মধুসূদনের দেশপ্রেম বিষয়ে বস্তুত তার দেশপ্রেম তার সাহিত্য কৃতি ও জীবন কৃতির মধ্যেই আমরা খুঁজে নেব তাঁর স্বদেশ চেতনা।

দেশপ্রেম একটি শাশ্বত চিরন্তন বোধ যা মনের মধ্যে অন্ত:সলিলা ফল্গু ধারার মতো প্রবাহিত হয় কম বেশি প্রতিটি মানুষের মনেই ।বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সেটি জেগে ওঠে। ইংরেজদের এদেশে আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু আমরা তার বিরোধিতা শুরু করিনি বরং তখন তাদের প্রতি আমাদের প্রেম হয়তো খানিকটা ছিল। ছিল শ্রদ্ধা। কিন্তু যখনই তাদের লোভী অত্যাচারী লুণ্ঠনকারী রূপটি আমাদের সামনে নগ্ন ভাবে উন্মোচিত হতে লাগলো তখনই আমাদের দেশপ্রেম জেগে উঠলো। সুতরাং একটা বিপরীত অবস্থান থেকেই এই সদর্থক মনোভাবের উন্মেষ ঘটে। আমরা এখন ডিজিটাল সিটিজেন  গ্লোবাল ভিলেজে বাস করি, হাতের মুঠোয় পৃথিবী। দেশ এর সীমা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। বিশ্ব নাগরিকের  দেশপ্রেম তার  রূপ ও বিস্তারের বদল ঘটাচ্ছে। স্বাধীনতা এবং পরাধীনতার চরিত্র ও বদলে হচ্ছে। তবে মধুসূদনের সেই কালে ফিরলে বুঝবো আঠেরোশো তিরিশ  চল্লিশ পঞ্চাশ ষাট সত্তর  সালের দেশপ্রেমের রূপ বিস্তার কেমন ছিল। বেশ একটু কঠিন কাজ। আমরা ফিরে যাবো ১৮৬১সালে যখন মেঘনাদ বধ কাব্য প্রকাশিত হলো। তার আগেই ১৮৫৭ হয়ে গেছে সিপাহী বিদ্রোহ। সেটা কতখানি প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ ব্যর্থ কি সফল সে তর্ক রয়েছে। ১৮৬০ সালে আমরা পাচ্ছি মেঘনাদ কে নায়ক করে রাবণের দীপ্ত দৃপ্ত  মানসিকতাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে হিন্দু আরাধ্য মহামহিমদেব  রামকে  কিছুটা আগ্রাসী চিত্র অঙ্কন করে মধুসূদন মেঘনাদবধ কাব্য লিখছেন।  রাজনারায়ন বসুকে  বলছেন--- I despise Ram and his rabble,but the idea of Ravana kindles my imagination ,he is a grand fellow.ধর্মীয় কাহিনীকে দিয়েছেন মানবিক রূপ। দেবতাকে মানুষ করেছেন। বর্তমান অর্থে স্বাধীনতা চেতনার তেমন কোনো  লক্ষণ হয়তো ছিল না। তবুও মেঘনাদবধ কাহিনীতে স্বদেশ চেতনার ছাপ আছেই-- মধুসূদনের ভাষ্যকার  গোলাম মুর্শিদ তেমনটাই বলছেন।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments