জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ /পর্ব-১৯/স্বপন কুমার দে

 চিত্র- শুভদীপ ঘোষ
এক মুঠো রোদ
পর্ব-১৯

স্বপন কুমার দে

না, রূপসা কথা রাখেনি। সম্পূরককে কথা দেওয়ার পর চার পাঁচ দিন কেটে গেলেও রূপসা সম্পূরককে সময় দিতে পারল না। সম্পূরক দেখতে পায়, রোজ পাঁচটায় রূপসা ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে আর তার দেড় ঘণ্টা পর সম্পূরক ছুটি পায়। দিনের শেষে ক্লান্তি আর অবসাদ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। মনে কষ্ট হয়, অধিকার হারানোর ভয় তাকে সদা সন্ত্রস্ত রাখে। একদিকে রূপসার প্রতি অন্ধ ভালোবাসা, অন্যদিকে জীবনের আলোছায়াময় অজানা রহস্য মনের মধ্যে বাসা বাঁধে। মনটাকে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকে। তবে,আর কিছুদিন পরেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল।

রবিবারের ছুটি কাটিয়ে সোমবার অফিসে গেল সম্পূরক। কাজের পাহাড় জমে থাকে তার টেবিলে, মুখ তোলার সময়টুকু পায় না। টিফিনের সময় যা একটু সময় পায়। তার মধ্যেও কেউ এসে কাজের তদ্বির করে, কেউ এসে বিশেষভাবে রিকোয়েস্ট করে। সবকিছুই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নম্রভাবে প্রত্যুত্তর দেয়। কাজের অগ্রাধিকারকে বরাবরই প্রাধান্য দেয় সম্পূরক। কখনও কখনও উপরমহলের চাপ থাকে। এসব নিয়েই চলতে হয়।

টিফিন হয়েছে, সবাই যে যার টিফিন বক্স খুলে খেতে শুরু করেছে, এমন সময় বড়সাহেব, ছোটসাহেব এবং রূপসা এসে তাদের সামনে হাজির হল। ছোটসাহেব অসীমবাবুর হাতে বড় বড় দুটো মিষ্টির প্যাকেট। একটু ভূমিকা করেই অসীমবাবু বলতে লাগলেন," মাই ডিয়ার কলিগস্, আই অ্যাম গ্ল্যাড টু সে ইউ, দ্যাট মি অ্যান্ড মাই সুইট হার্ট রূপসা চক্রবর্তী আর গোয়িং টু ম্যারি নেক্সট মান্থ। সো আই অ্যারেঞ্জ সাম সুইট ফর এনজয়িং আস। আই থিঙ্ক ইউ আর অল হ্যাপি উইথ দিস গুড নিউজ।"
সকলে হাঁ হয়ে চেয়ে রইল অসীমের মুখের দিকে। সম্পূরক যেন নিজের কান দুটোকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এতবড় প্রতারণা কখনও তার জীবনে ঘটেনি। আকস্মিক আঘাতে দিশাহারা হয়ে পড়ল। একটা গুঞ্জন উঠল। সে বিস্ময়ে আবিষ্কার করল যে অনেকে আড় চোখে দেখছে। সম্বিত ফিরেই তার মনে হল, অসীমের গালে দুটো ঠাস্ ঠাস্ করে চড় কষিয়ে দেয়। কিন্তু সেটা তার ভদ্রতার সঙ্গে মানানসই নয়। কিন্তু রূপসা কী করে এটা পারলো। সে এতটাই ফ্রড। তলে তলে জল খাচ্ছিল আর সম্পূরকের সঙ্গে ছলনা করছিল। তার এতদিনের ভালোবাসা মিথ্যে।মানুষ এতটাও নিষ্ঠুর হতে পারে? সম্পূরকের চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। মরে যেতে ইচ্ছা করছিল তার।

অফিসের অন্য সকলে এতক্ষণের ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা সরিয়ে কিছুটা অপ্রস্তুতভাবে কথা বলতে শুরু করেছে। আগে যে তারা ঘূণাক্ষরেও এটা বুঝতে পারেনি তাও জানাল। অসীম আবারও বলতে লাগল, " রূপসা আমার ছোটবেলার বন্ধু, আমাদের দুই পরিবারের মধ্যেও যোগাযোগ আছে। তাই দুই পরিবারের গার্জেনরাও আর দেরি করতে চাইছে না। গতকালই দুই পরিবার একসঙ্গে বসে ডিসিশন নিয়েছে, সামনের মাসের পনেরো তারিখ আমাদের বিয়ে। আমি এখনই আপনাদের মৌখিক নিমন্ত্রণ জানালাম, পরে কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করবো। আপনাদের প্রত্যেকের কিন্তু অবশ্যই আমাদের বিয়েতে যাওয়া চাই।"
সম্পূরকের আর খেতে ইচ্ছা করছিল না, বমি পাচ্ছিল। টিফিন বক্সটা ঢাকা দিয়ে এক কাপ চা নিয়ে চুমুক দিতে লাগল।

সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরে মুখ হাত ধুয়ে নিজের রুমে শুয়ে পড়ল সম্পূরক। মায়ের মনে আশঙ্কা হল। ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন," তোর শরীর খারাপ নাকি?"
চোখ না খুলেই ছেলে জবাব দিল," না"।
" তাহলে এই সময় শুয়ে পড়লি?"
" না তেমন কিছু নয়। অফিসের ধকল। এই আর কী?"
মা ফিরে বৌমাকে বললেন," যাও তো বৌমা একবার সমুর কাছে। রূপসার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে নাকি খবর নেবে।"

🍂

বৌদি এসে দেওরের পাশটিতে বসল।
" কি গো ভাই, তোমার আবার হল কী?"
" কিছু হয়নি বৌদি। এমনই শুয়ে আছি।"
" হয়নি মানে? হয়েছে। এত পরিশ্রম করে আসার পর যদি কেউ বৌয়ের আদর যত্ন না পায় তবে তো শরীর খারাপ হবেই। দাঁড়াও মাকে বলতে হবে খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের ব্যবস্থা করতে।"
" ওঃ বৌদি, তুমি না..."
" রূপসার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে? আমাকে ওর নাম্বারটা দাও।"
" না বৌদি কিছু হয়নি। ঠিক আছে তুমি চলো, আমি যাচ্ছি।"
" এসো, আমি সবার জন্য গরম গরম পাঁপড় ভাজছি।"
একটু পরেই সম্পূরক যথারীতি টেবিলে এলো।বিশেষ কথা না বললেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। বেশ কিছুক্ষণ টিভি দেখল। সবার সঙ্গে বসে খবর অথবা কখনও বাংলা সিরিয়াল দেখল, কিন্তু কোনো কিছুতেই স্বাদ পেল না। জীবনের স্বাদটাই কেমন যেন বিস্বাদ ঠেকল। ভেতরের তোলপাড় করা বিষাদের তপ্ত লাভা গুমরে গুমরে ভেতরেই ঠোক্কর খেতে লাগল। সেখান থেকে উঠে গিয়ে কিছুক্ষণ ছাদে পায়চারি করল,শেষমেষ রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।

রাত্রি কখনও কখনও ভয়ংকর হয়ে মানুষকে গিলতে আসে। চোখের পাতা দুটো এক হতে দেয় না। রাগ, যন্ত্রণা, ভয় হতাশা,অভিমান তার মনটাকে ভেঙে চুরে ধূলিস্যাৎ করে দেয়। মনের সঙ্গে যুদ্ধ চলতে চলতে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টার কাঁটা এক একটা স্টেশন ছেড়ে যায়, সে টেরও পায় না। রাত্রি গভীর হয়, ভোর হয়, অবশেষে দিনের আলো দেখে নিদ্রাহীন চোখ।

আজ সম্পূরকের জীবনে সেই রাত। এই রাত মধুচন্দ্রিমা যাপনের মিষ্টি মধুর রাত নয়। এ রাত সহস্র গোলাপের পাঁপড়ির সুগন্ধে মাতোয়ারা নবদম্পতির নিশিযাপনের মধুক্ষণ নয়। এ রাত সর্বনাশের রাত।এ রাত তার জীবনে কখনো আসেনি। আজ বিষাক্ত সাপের ছোবলের জ্বালা বুকে নিয়ে এসেছে এই রাত। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে থাকে, ঘুম আসে না। মনের মধ্যে কাটাছেঁড়া চলতেই থাকে। আজ তার এই অবস্থার জন্য কে দায়ী, -- রূপসা,..অসীম..না, সে নিজে? এ প্রশ্ন তার মস্তিষ্কের শিরা উপশিরায় জ্বালা ধরিয়ে দেয়। রূপসাকে সে সত্যিকারের ভালোবেসেছিল, তাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেছিল সুখী দাম্পত্যের। মাঝখানে কোথা থেকে কালবৈশাখী ঝড়ের মত অসীম এল,তার জীবনখানাকে তছনছ করে দিল। এতটাই কুচক্রী, স্বার্থপর, শয়তান অসীম! আর রূপসা, সেই বা কতটা সৎ? সম্পূরকের সারল্যকে নিয়ে ছেলেখেলা করছে, তাকে দিনের পর দিন ঠকিয়েছে  তার যদি অন্য কিছু মতলব ছিল, তবে তা আগে বলেনি কেন? কেন তার সঙ্গে অভিনয় করে গেছে? তাকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে দিল। এভাবে অপমান করার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? এত কেনর মাঝে সম্পূরকের মনে হল, সে নিজেও দায়ী। নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছা করল। তার মত হাবাগোবা মাথামোটার এটাই হওয়া উচিত। কেন সে মানুষকে এতটা বিশ্বাস করে? এই অন্ধ বিশ্বাসের আজ খেসারত দিতে হল। কেন সে রূপসাকে আগে থেকে বুঝতে পারল না? বুঝলে আজ এই অবস্থা হত না। সে কোনদিনই মানুষ চিনতে পারেনা, অল্পতেই বিশ্বাস করে নেয়। অনেকবার ঠকেছে, সাবধান হয়নি, আজ একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গেল।
ঘুম আসে না।তার বিনিদ্র চোখ সকালের আলো দেখে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে।  
আরও পড়ুন 
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

0 Comments