মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১১২
বসন্তকুমার দাস (স্বাধীনতা সংগ্রামী, খেজুরী)
ভাস্করব্রত পতি
তিনি ছিলেন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার প্রথম সারির স্বাধীনতা সংগ্রামী, যোগ্য সংগঠক এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেজুরীর রামচক গ্রামে ১৮৯৮ এর ১ লা মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন ইন্দ্রনারায়ন দাস এবং মা সুধারাণী দাস।
কাঁথি হাইস্কুল থেকে ১৯২১ সালে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করে চলে যান কলকাতা। সেখানে প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রথম বিভাগে বিজ্ঞান বিভাগে (বি এস সি) স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। সেসময় থেকেই অনুপ্রাণিত হন গান্ধীজীর জীবনাদর্শতে। গ্রেপ্তার হয়ে গ্রামের বাড়িতে অন্তরীণ থাকতে হয়। একজন কংগ্রেস কর্মী হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন তখন থেকেই। পড়ালেখায় তুখোড় হলেও ব্রিটিশদের অধীনস্থ থেকে চাকরি করার ইচ্ছে, ভাবনা এবং প্রয়োজনীয়তা -- কোনওটাই ছিলনা তাঁর। আসলে বাড়ির অবস্থা ছিল যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। তাই চাকরি করতেই হবে এমন চাহিদা তৈরি হয়নি।
১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন এবং ইউনিয়ন বোর্ড বয়কট আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার দরুন গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। এজন্য প্রথমবারের জন্য কারাবরণ করেন তিনি। আবারও ১৯৩২ এ দ্বিতীয় পর্যায়ের আইন অমান্য আন্দোলনের দরুন গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেন। তখন অবশ্য তিনি ছিলেন জেলা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক। ১৯৪২ সালে গান্ধীজীর ডাকা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে তৃতীয়বারের জন্য তিন বছর মেয়াদের কারাবাস ভোগ করেন। রাজশাহী জেল থেকে ছাড়া পাবার পর সদস্য হলেন বাংলা কংগ্রেসের। তখন সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন কংগ্রেসের সভাপতি। তিনি দু'বার রাজসাহী জেলে এবং প্রায় ১০ বছর কাটান প্রেসিডেন্সি জেলে।
১৯৪৬ সালে কারামুক্তির আস্বাদন লাভ করেন। এরপর ভারত স্বাধীন হয়। তখন ১৯৪৭ সালে কাঁথির সাংসদ পদ লাভ করেন। তিনি বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি গান্ধীজীর আদর্শে নিজেকে ব্যাপৃত রেখে দেশের ও দশের স্বার্থে অনেক গঠনমূলক কাজে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। সাংসদ হিসেবে তিনি সংবিধান রচনার অন্যতম গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৫২-১৯৫৭, ১৯৫৭-১৯৬২, এবং ১৯৬২-১৯৬৭ পর্যন্ত ছিলেন নির্বাচিত সংসদ সদস্য। ১৯৫৮-১৯৬২ পর্যন্ত ছিলেন বিধান পরিষদ সদস্য। ১৯৬২ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিদর্শন করতে তাঁর নেতৃত্বে এক প্রতি নিধি দল যায়। লক্ষ্য ছিল সেখানকার কৃষি ও প্রযুক্তিবিদ্যা পরিদর্শন। কেন্দ্রের উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের চেয়ারম্যান পদে আসীন ছিলেন।
১৯৭৪ সাল থেকে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নিয়ে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। আত্মনিয়োগ করলেন মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনায়। এটি ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম মাইলস্টোন। তাঁর যোগ্য সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় 'স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর' নামে দু'টি মূল্যবান গ্রন্থ (প্রথম খণ্ড ১৯৮০ এবং দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৮২)। সেসময় তাঁকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় 'মেদিনীপুর স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাস' সমিতি। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর 1942 In the Contai Sub Division এবং A short History of the August Movement বই দুটি। ১৯৬৮ সালে জেলায় প্রবল বন্যা হয়। সেসময় জেলাব্যাপী ত্রানবিলিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি।
বসন্তকুমার দাস ছিলেন মেদিনীপুর ফ্রিডম ফাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক। ১৯৭৩ সালে তিনি খেজুরী আদর্শ বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গনে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উৎসব পালন করেছিলেন। মূল উদ্যোক্তা ছিল 'হিজলী তরুণ সংঘ'। বিদ্যাপীঠ হাইস্কুলের বহু সময়ের সম্পাদক পদ সামলান। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে তাঁর লেখা 'মেদিনীপুরে স্বাধীনতার গণসংগ্রাম, খেজুরী থানা' প্রকাশিত হয়। এলাকায় শিক্ষা প্রসারের জন্য জরারনগর সুভাষপল্লী ও উচ্চ বুনিয়াদী বিদ্যালয়, খেজুরী আদর্শ বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমটিতে ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং দ্বিতীয়টিতে ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং শিক্ষাবিস্তারে আরও জোর আনতে ১৯৩৬ সালে স্থাপিত হিজলী তরুণ সংঘের ভূমিকা' নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার জন্য তাঁকে দেওয়া হয় তাম্রপত্র। অনেক দিন অসুস্থ থাকার পর গত ১৯৮৪ সালের ১ লা ডিসেম্বর এস এস কে এম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
🍂
0 Comments