জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫৬ / সালেহা খাতুন

মহিমা ও মানস, আমার সেই শিক্ষার্থীদ্বয় যাদের পর আর কাউকে আমি টিউশন পড়াইনি।

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫৬ / সালেহা খাতুন 

এম. ফিল.পড়া শুরু হয়ে গেল। আমার বাবা-ই এম. ফিল.- এর পড়াশোনার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করেন। এমনকি শান্তিনিকেতনে প্রায় এক সপ্তাহের যে ফিল্ড সার্ভেতে যাই তাও বাবার টাকাতেই সম্পন্ন হয়। এর আগে ডিসেম্বরের নেট পরীক্ষা দেওয়ার পর জুনের পরীক্ষার ফর্ম আর ফিলআপ করিনি। কেননা তখন ফর্ম ফিলআপের জন্য তিনশো টাকা খরচ করতে মন চাইছিল না। অবচেতনে একটি ঘটনা তখন মনকে তোলপাড় করতে থাকে। আংশিক সময়ের অধ্যাপনার জন্য সম্মান অসম্মান দুটোই পেতে থাকি। কন্যা সালেহার লড়াইটা ছিল সমাজের সাথে। জায়া সালেহার প্রতিপক্ষ হয়ে গেল নতুন পরিবারটি। শ্বশুরমশাই একদিন সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, “ কত টাকা মাইনে পাও?” সপ্তাহে ছটি করে ক্লাস নিয়ে মাসে মাত্র তিনশো টাকা মাইনে পাই, বলতে ইচ্ছা করলো না। বললাম এটা কনফিডেন্সিয়াল ব্যাপার।

আশ্চর্য! তিনি বসিরহাট কলেজে চলে গেছেন পার্ট টাইমারদের বেতন কত দেওয়া হয় তা জানতে। ওখানকার অধ্যক্ষের সঙ্গে তাঁর বিশেষ আলাপ ছিল। সে কলেজে তখন একশো টাকা দেওয়া হতো। বাড়ি ফিরে শ্বশুরমশাই সাহাপুরের ঠিকানায় একটি কড়া চিঠি লিখলেন আমাকে। “যা মাইনে পাও তাতে বাস ভাড়াই তো জোটে না” – এতো গর্ব কিসের? ওমা আমার সংকোচকে উনি গর্ব ভেবেছেন।

প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজে পার্ট টাইম পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে উলুবেড়িয়া কলেজে স্পেশাল অনার্স পড়ছে এমন চারজন শিক্ষার্থীকে বাড়িতে টিউশনও পড়াতাম। মানস,মহিমা আর ফুলমনি। একজনের নাম মনে করতে পারছিনা। ওদের পড়িয়ে সব মিলিয়ে মাসে হাজার টাকা পেতাম। ফলে নিজের খরচ মোটামুটি চালাতে পারতাম।
এম. ফিল.- এর আইডেনটিটি  কার্ড।

মানস মহিমার সঙ্গে যোগাযোগ আছে এখনও। মানস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেগুলারে এম. এ. পড়ে। নেটও পাশ করে। কলেজ সার্ভিস কমিশনে ইন্টারভিউ দেয়। কিন্তু কী অদ্ভুত নিয়ম! ওকে বলা হয় যেহেতু ও স্পেশাল অনার্স করেছে তাই কলেজে পড়ানোর যোগ্যতা ওর থাকলেও ও পড়াতে পারবে না।  মানস এস এস সি দিয়ে এখন স্কুলে পড়াচ্ছে। আর মহিমা একটি এনজিও-র নারী ও শিশু কল্যাণ বিভাগ সামলাচ্ছে। 

আটানব্বইয়ের নয় জুন বাড়িতে একটি চিঠি পাঠায় ইউজিসি। যে আমি নেট কোয়ালিফাই করেছি। আমি তখন শ্যামনগরে কোয়ার্টারে আছি। বাবা বোনকে পাঠায় আমাকে খবর দেওয়ার জন্য। যারপরনাই আনন্দিত সবাই। আমার কলেজের সমস্ত অধ্যাপক থেকে শুরু করে গুণমুগ্ধ জন সবাই। তখন পরিচিতদের মধ্যে নেট খুব কম জনই পেয়েছে।
ভাগ্যিস জুনের ফর্ম পূরণ করিনি। তিনশো টাকা বেঁচে গেল।

কিন্তু রাজ্যে উনিশশো আটানব্বইয়ে প্রথমবার যে  এস এস সি পরীক্ষা হয় তা দিয়েও চান্স পেলাম না। সেও এক ইতিহাস। এস এস সি পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপ করেছি। কিন্তু পরীক্ষার মাত্র দুদিন বাকি,অ্যাডমিট এলো না। যেতে হলো বর্ধমানের এক পলিটেকনিক কলেজে। না খেয়ে না দেয়ে সারাদিন রাত লাইনে দাঁড়িয়ে রাত দেড়টার সময় হাতে অ্যাডমিট পেলাম।  সঙ্গে ছিল ওবাই। আমার ভাই। আমার সংকটে বিপদে আপদে সব সময় যে পাশে থাকে। সালাউদ্দিন অফিস থেকে ছুটি পাবেন না তাই যেতে পারেন নি। রাত আড়াইটায় বর্ধমান স্টেশনে এসে ট্রেন ধরে হাওড়া ফিরি। ওখান থেকে সোজা বাউড়িয়া বাবা মা র কাছে ফিরলাম। সালাউদ্দিন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন, ভেবেছেন আমি সাহাপুরে ফিরেছি আর বাবা নিশ্চিন্তে আছেন ছেলে মেয়ে শ্যামনগরে ফিরেছে ভেবে। 

পরীক্ষা খুবই ভালো হয়েছিল। পাশ না করার কোনো কারণই তখন খুঁজে পাইনি। উলুবেড়িয়া হাইস্কুলে পরীক্ষার সেন্টার পড়েছিল। পরে হঠাৎই একদিন আমার সংগ্রহে থাকা পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকার মধ্যে স্কুল সার্ভিস কমিশন পরীক্ষার অ্যাডমিট দেখে অবাক হয়ে যাই। কাউন্টার পার্টটি  জমাই নেয় নি। তাহলে পরীক্ষায় আমার অনুপস্থিতি দেখানো হয়েছে নাকি? নাকি এটি দ্বিতীয় কোনো অ্যাডমিট, যা পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পরে এসেছিল?
সেদিন যে বেতনের কথা বলতে পারিনি, তা আজ সবার সামনে ...

নেট কোয়ালিফাই করেছি। ফলে কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করতে থাকি। এম. ফিল. এ ভর্তি হয়ে নরেশবাবুকে জানাই স্যার আমি স্কটিশ চার্চ কলেজে লেকচারার পোস্টের জন্য আবেদন করেছি। তিনি বললেন,"আমি বলছি ওখানে তোমার হবে না"। আমি "চিরকালের বোকা এবং সরল" মেয়ে। ভাবলাম দেখিই না কী হয়? ইন্টারভিউ এর চিঠি পাচ্ছি না, তাই স্কটিশ চার্চ কলেজেই চলে গেলাম। অফিসে বড়োবাবুর সঙ্গে দেখা করে জানলাম সাড়ে চারশো   অ্যাপ্লিকেশন পড়েছিল। তার  মধ্যে নির্বাচন করে নব্বই জনকে ডাকা হয়েছে। সে লিস্টে আমি নেই।

ঐ সময় আমি একদিনে তিন চারটি জেলা পরিক্রমা করতাম। সোম ও মঙ্গলবার প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজে ক্লাস নিতাম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে এম. ফিল. এর ক্লাস করতাম,বাড়িতে টিউশন পড়াতাম। ফলে শ্যামনগর থেকে 85 বাসে করে ব্যারাকপুর এসে নৌকায়  ধোবিঘাট পেরিয়ে শ্রীরামপুর থেকে ট্রেনে হাওড়া, আবার হাওড়া থেকে আর একটা ট্রেন ধরে আন্দুল এসে কলেজে ক্লাস নিয়ে সিটিসি বাস ধরে রবীন্দ্রসদন যেতাম। ওখান থেকে মেট্রো ধরে সেন্ট্রালে নেমে কিছুটা হেঁটে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছে এম . ফিল. এর ক্লাস করে শিয়ালদহ থেকে নৈহাটি লোকাল ধরে আবার শ্যামনগর ফিরতাম। শ্যামনগর থেকে সপ্তাহে একদিন আবার বারাসাত হয়ে বেড়াচাঁপা পেরিয়ে আগাপুরে শ্বশুরবাড়ি যেতাম সালাউদ্দিনের ছুটির দিনে। ফলে তখন আমার তিনটি থাকার জায়গার মধ্যে সোমবার রাত বাউড়িয়ার বাড়িতে আর বুধবার রাত আগাপুরের বাড়িতে এবং বাকিদিনগুলি শ্যামনগরে কাটতো।

(ক্রমশ)
আরও পড়ুন 
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

0 Comments