ষষ্ঠবিংশ পরিচ্ছেদ
আবীর ভট্টাচার্য চক্রবর্তী
বাইরে তখন বৈশাখী চাঁদের আলো গলে গলে পড়ছে নির্মেঘ আকাশময়,ঐ দূরে দেখা যাচ্ছে আকাশগঙ্গার ধোঁয়া ধোঁয়া আলোপথ।এমন সব রাতে কতো কথাই যে মনে ভাসে… লৌকিক, অলৌকিক। এই যে হঠাৎ করে বৌদিদির সঙ্গে তার বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে অনেকদিন পরে তার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া দাদার সঙ্গে সাক্ষাৎ,তাদের মা অর্থাৎ পিসিমার তাকে নিয়ে তীর্থে আসার পরিকল্পনা,সবাইকে অবাক করে এতো দূরে বেড়াতে আসা,তার মতো একলা মেয়ের… সবই তো বড়ো আকস্মিক, হওয়ার কথাই ছিল না। অন্ধকার মাটির বাড়ির এককোনে পড়ে থাকা দেরাজের মধ্যের বইগুলিতে ছাপা হয়ে থাকা মেঘ-স্বপ্নগুলিকে নিজের চোখে দেখার ভাগ্য হতো না, তবু তো হয়েছে। সাধারণ জীবনেও কতো কতো অসাধারণ গল্প থাকে। তাই জন্যেই তো জীবন এতো সুন্দর, এতো আঘাত-দুঃখ সত্ত্বেও বেঁচে থাকা মহার্ঘ্য।
যদিও বাইরে ভীষণই ঠান্ডা, তবু বাংলোর বারান্দাতেই বসে বসে এসব ভাবছিলেন বিরজা,পাশে ছিলেন দলের কমবয়সী সবাই,সবার হাতেই ছিল ধর্মশালার রান্নাঘর থেকে আনা ঘন দুধের এলাচ দেওয়া গরম চায়ের গ্লাস। ভেতরে ছিলেন বড়োরা। চলছিলো এলোমেলো গল্পগাছা, পরের দিনের যাত্রার পরিকল্পনা,সারাদিনের বেড়াবার কথা। দাদা তাঁর আগের বারে এই পথে আসার গল্প শোনাচ্ছিলেন,কতো কতো মানুষের কথা; তাদের ভক্তি,ভালোবাসা… ফুলচট্টির ছোট্টো বারান্দায় তখন যেন হাজার মুখের ভিড়;কেউ তীর্থযাত্রী,কেউ বা দাদার মতো নেহাতই ভ্রামনিক।
তাঁর গল্পে শোনা গেল, আগামীকাল তাঁরা যাবেন বারকোট হয়ে উত্তর কাশী,মানুষের তৈরি এক অপূর্ব স্হাপত্য দর্শনে। সম্পুর্ন পাথরে প্রস্তুত শক্তপোক্ত কাঠামোর সেই মন্দিরটি নাকি উত্তর ভারতের ভগবান শিবের জন্য নিবেদিত প্রাচীনতম মন্দিরগুলির মধ্যে একটি,ভারতবর্ষের বিখ্যাত দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম।প্রভাতী এবং সায়াহ্নের আরতি নাকি অপূর্ব সুন্দর, দর্শনার্থী মাত্রেই বিশ্বাস করেন,এ জন্মের শুধু নয়, পরের জন্মের পূণ্যও নাকি সঞ্চিত হয় ঐ অপরূপ দৃশ্য অবলোকনে। শুনতে শুনতে কিশোর ভাইয়ের প্রশ্ন,
-’আচ্ছা দাদা, ঐ দৃশ্য কি হরিদ্বারের গঙ্গা আরতির চাইতেও সুন্দর?’
🍂
দাদার আগেই গঙ্গাজল সইয়ের বর বলে উঠলেন,
-’আহা!ওভাবে কি কোন কিছুর বিচার হয়, ভাই?এ পৃথিবীর প্রতিটি দৃশ্যই আপনার মতো সুন্দর।’
বলেই তাকালেন বিরজার দিকে।
কি এক অজানা শিহরণে সে কথা শুনেই বিরজার গালে লজ্জার টোল…মনে পড়ে গেল সেদিনকার দুপুরবেলার কথা। সদ্য পুজো সেরে, যমুনা কুন্ড থেকে উঠছিলেন বিরজা,সই ডাকছিল, গঙ্গাজল পাতানোর পুজোর জন্য।অতো খেয়াল করেননি,সারা গায়ে লেপ্টে থাকা ভিজে কাপড় হয়তো খানিক সরেও যেতে পারে, সাদা থানের মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল হয়তো দেহাবয়ব বিভাজিকা; কুন্ডে আরও অনেক নারী পুরুষের ভীড়, বিভিন্ন বয়সী।সবাই পূণ্যার্থী। কেউ কারো দিকে তেমন খেয়াল করছিল না।তবু তারই মধ্যে একটি পুরুষদৃষ্টির মোহিত চাহনিতে যেন শিরশিরিয়ে উঠেছিল বিরজার অনাঘ্রাত কৌমার্য!
কে না জানে, মেয়েদের এই এক সহজাত বৈশিষ্ট্য, যে কোন বয়সী অথবা যে কোন সম্পর্কেরই হোক না কেন, কোন পুরুষ তাদের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালে তারা সেটা ঠিক বুঝতে পারে, পুরুষের সে ক্ষমতা নেই। তাই হয়তো আলাপ হওয়ার পর থেকেই কি যেন এক অজানা ঔৎসুক্যে তাঁর দিকে তাকালেও তিনি সম্ভবত কিছুই বোঝেন নি।
আজ যখন কোমর সমান জলে দাঁড়িয়ে অরুন্ধতীর সঙ্গে গঙ্গাজল পাতানোর পুজোয় ব্যস্ত ছিলেন, হঠাৎই চোখ পড়ে ধারে দাঁড়িয়ে থাকা তার বরের দিকে, ওমা! উনিও তাকিয়ে আছেন তার দিকেই! সে চোখে সৌহার্দ্য ছিল, স্নেহ প্রশ্রয় ইত্যাদিও ছিল, তবে তার চেয়েও বেশি ছিল মুগ্ধতা।
পরে পরে আরও অনেকবার দেখা হয়েছে, সম্পর্ক সহজ;রসিকতার, বন্ধুত্বের। তবু কখনোই দুজনের কেউই আলোচনা করতে পারেননি সেদিনকার কথা, কেন কে জানে, হয়তো সাধারণ জীবনেও কিছু অসাধারণ মুহুর্ত থাকেই সবার জীবনে,সঙ্গোপনে, অবচেতনে… যা আলোচনা করা যায় না, ভাগ করা যায় না নিজেদের মধ্যেও,শুধু জিইয়ে রাখা যায় মনে মনে।
চারিদিকে ইতিউতি এলোমেলো গল্পের মধ্যেই বারান্দার বাইরের তারা ভরা সেই অনন্ত আকাশের দিকে অন্যমনস্ক তাকিয়ে সেদিন এসব ভাবতে ভাবতেই হয়তো ডাক এসেছিল খাওয়ার। বিরজা আর গঙ্গাজল সই দুইজনে গিয়ে সবাই জন্যই খাবার নিয়ে ঘরে এসে পরিবেশন করেছিল। আয়োজন সামান্য, ঘী মাখানো রুটি এবং ডাল।
বাইরের তুমুল ঠান্ডা, সারাদিনের পথশ্রমের ক্লান্তির মধ্যে তা যেন দেবভোগ্য মনে হয়েছিল। সুতরাং তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে পিসিমা ও নতুন কাকীমাকে হটওয়াটার ব্যাগ এবং কম্বলের মধ্যে জড়িয়ে অন্য বিছানায় দুই সখী শোওয়ার ব্যবস্থা করলেন। একে তো তুমুল ক্লান্ত, তায় পরের দিনে পাহাড়ি পথে প্রায় দুশো কিমি যাওয়ার কথা;বারকোট হয়ে উত্তর কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির হয়ে হারসিল… বেশীর ভাগটাই গাড়িতে হলেও খানিক চড়াই-উৎরাই হাঁটা পথ, পিসিমার বাতের শরীর, দলে আরও দুজন বৃদ্ধ মানুষ। অগত্যা সেদিন বেশীক্ষণ গল্পগাছার ইচ্ছে দুজনের কারোরই ছিলনা।তবু তারই মধ্যে সই বলে বসলো,
-’সই! ঘুমোলি নাকি?’
-’না। বল… ‘
-’তোর একা লাগে না?’
-’মানে!’
-’না, মানে আমার উনি আজ বলছিলেন, হতেই পারেন বামুন বাড়ির বিধবা, তবু তোমার সইয়ের বয়েস তো খুব কম! আজকাল তো বিধবাদের আবার বিয়ে হয়। কলকেতার ঠাকুরবাড়ির রবীঠাকুরও তাঁর ছেলের সঙ্গে বিধবার বিয়ে দিয়েছেন…’
আজন্ম মুখরা বিরজার মুখে এসে গিয়েছিল,
-’সতীন আনতে চাস সোনার সংসারে?’
অবশ্য পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বলে বসলেন,
-’না রে সই। একা লাগে না।বিয়েটা আমার কাছে এখন ধোঁয়া হয়ে গেছে,অনেকদিন আগের কথা তো। তাছাড়া মাত্রই তো কয়েকটা বছর, তাও বেশির ভাগ সময় বাবার বাড়িতেই থেকেছি। এখন আমার ভরা সংসার, দাদা বৌদি ভাইপো ভাইঝি নিয়ে। সময় হয়না নিজের কথা ভাবার…
বলেই পাশ ফিরে শুলেন। সই বুঝলে, আজ আর গল্প এগুবে না, খানিকক্ষণ পরে, গভীর শ্বাসের শব্দ শুনলেন, নিদ্রা দেবী তাকে দয়া করেছেন, পাশে বিনিদ্র তরুণী তার দেহ ভরা যৌবন নিয়ে তাকিয়ে রইলেন কাঁচের জানলার ওপারে গহন রাত্রির দিকে… (ক্রমশঃ)
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী
0 Comments